বিষাণ সিংহ বেদী। — ফাইল চিত্র।
ভারতীয় ফুটবলে এক সময় একত্রে উচ্চারিত হত তিন ফুটবলারের নাম। পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী এবং তুলসীদাস বলরাম। গত কয়েক বছরের মধ্যে তিন জনই চলে গিয়েছেন পৃথিবী ছেড়ে। ক্রিকেটেও তেমনই এক সময় এক ত্রয়ীকে নিয়ে মাতামাতি হত। তাঁরা হলেন বিষাণ সিংহ বেদী, এরাপল্লি প্রসন্ন এবং ভাগবৎ চন্দ্রশেখর। সেই ত্রয়ীর প্রথম জন, অর্থাৎ বেদী চলে গেলেন সোমবার। এই প্রজন্মের অনেকেই তাঁকে চেনেন না। খেলা দেখেননি। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন, বিশ্ব জুড়ে পেস বোলারদের দাপটের মাঝে কী ভাবে উঠে এসেছিলেন তিনি। বাকি দুই স্পিনারদের সঙ্গে নিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন আপামর বিশ্ব জুড়ে।
বেদী এমন একটা সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন গোটা দেশ জুড়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন চলছে। অহিংসার প্রতি বেদীর এই বিশ্বাস প্রভাব ফেলেছিল তাঁর বোলিং স্টাইলে। ফ্লাইট করানো ছিল তাঁর সহজাত ক্ষমতা। সেই সঙ্গে বলের বৈচিত্র এনে ব্যাটারদের ধোঁকা দিতেন। সেই সময়ে পেসারদের যুগ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের দাপুটে পেসারেরা খেলতেন। বাউন্সার এবং গতি তখন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের দেখে গোটা বিশ্ব অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। নিজ গুণে বেদী বাকিদের ছাপিয়ে যান। ভারত যে স্পিনের দেশ, সেটা পরের দিকে বেদীর বোলিং দেখেই বুঝতে শুরু করে বিশ্ব। পরবর্তী কালে অনেক স্পিনার উঠে এলেও শুরুটা হয়েছিল বেদীর হাত ধরেই।
পঞ্জাবের অমৃতসরে ১৯৪৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জন্ম বেদীর। মাত্র ১৫ বছর বয়সে উত্তর পঞ্জাব দলে তাঁকে নেওয়া হয়। রাজ্য দলের হয়ে নিজের প্রতিভা এবং দক্ষতার প্রমাণ দেওয়ার পরে তিনি দিল্লিতে চলে যান। ১৯৮১ সাল, অর্থাৎ অবসর নেওয়া পর্যন্ত খেলেছেন দিল্লির হয়েই। ভারতের হয়ে অভিষেক ২১ বছর বয়সে। কলকাতায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। পরের ১২ বছর বেদীকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কোনও ম্যাচেই প্রথম একাদশ তাঁকে ছাড়া ভাবা যেত না। ইংল্যান্ডের কাউন্টি দল নর্দ্যাম্পটনশায়ারের হয়ে দীর্ঘ দিন খেলেছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এখনও পর্যন্ত তাঁর উইকেট সংখ্যা যে কোনও ভারতীয়ের থেকে বেশি। ৩৭০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ১৫৬০টি উইকেট নিয়েছেন।
স্পিন বোলিংয়ের বিশেষজ্ঞ যাঁরা, তাঁরা বেদীকে অনেক উঁচুর দিকেই রাখতেন। হালকা গতিতে এগিয়ে এসে, আঙুল ও কব্জির বৈচিত্র এবং ফ্লাইট কাজে লাগিয়ে বল করতেন। যাঁরা বেদীর বোলিং কাছ থেকে দেখেছেন বা খেলেছেন তাঁরা বলতেন, বেদী শেষ মুহূর্তে বলের গতিপথে বদল ঘটাতে পারতেন। বল পিচে পড়ার আগের মুহূর্তেও ঘুরে যেতে পারত। তা ছাড়া, ফ্লাইটও ছিল নজরকাড়া। ব্যাটারের মনে হত, বল কয়েক মুহূর্ত যেন হাওয়ায় ভেসে রয়েছে। ঠিক যে মুহূর্তে ব্যাটার সামনের পায়ে এগিয়ে এসে বলটি খেলতে যেতেন, সেটি দিক বদলে স্টাম্প ভেঙে দিত। অথবা ব্যাটের কানায় লেগে জমা পড়ত উইকেটকিপার বা স্লিপের হাতে।
বলের প্রতি বেদীর নিয়ন্ত্রণ ছিল অসামান্য। তাঁর বোলিং সব সময় একটা ছন্দে বাঁধা থাকত। সব অধিনায়কই তাঁকে পছন্দ করতেন। একটানা অনেক ক্ষণ বল করে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর। সারা দিন বল করলেও ক্লান্ত হতেন না। বেদি, প্রসন্ন, চন্দ্রশেখরের সময় ভারতীয় দল এক পেসারে খেলত। তাতেও বিশ্বের বাকি দলগুলি তাঁদের ভয় পেত। এর সঙ্গে সুনীল গাওস্কর এবং দিলীপ বেঙ্গসরকরের পার্ট-টাইম বোলিং তো ছিলই।
এখনকার ক্রিকেটে বেদীর বোলিং হয়তো তাৎপর্য হারাত। শেষ যে বোলার দারুণ ফ্লাইট দিতেন, সেই শেন ওয়ার্নও কয়েক বছর আগে চলে গিয়েছেন। পাগড়ি মাথায় বেদীর এগিয়ে আসা যে কোনও ব্যাটারের কাছেই ত্রাস ছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পার্থে ১৯৭৮-৭৯ সালে ১৯৪ রানে ১০ উইকেট নেওয়াই তাঁর সেরা বোলিং ফিগার। মনে রাখতে হবে পার্থ এমন উইকেট, যা পেসারদের স্বর্গরাজ্য ছিল। ভারতের হয়ে ৬৭টি টেস্ট খেলে ২৬৬টি উইকেট নিয়েছেন। গড় ২৮.৭১। ১৯৭৮-৭৮ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে ৩১টি উইকেট নিয়েছিলেন।
বেদীর জীবনের আর একটি পর্যায় হল তাঁর অধিনায়কত্ব। ১৯৭৬ সালে মনসুর আলি খান পতৌদির পর ভারতের অধিনায়ক হন তিনি। পোর্ট অফ স্পেনে সে বছর চতুর্থ ইনিংসে ৪০৬ রান তাড়া করে জেতে ভারত। সেই রেকর্ড অক্ষত ছিল অনেক দিন। পরের টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় দলে নিয়েছিল চার পেসারকে। তাদের ভয়ঙ্কর বোলিংয়ে ভারতের কয়েকজন ব্যাটার আহত হন। বেদী ৩০৬ রানে ইনিংস ডিক্লেয়ার দিয়ে দেন। পরের ইনিংসেও একই ব্যাপার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের পেসারেরা একের পর এক বাউন্সার দিতে থাকেন। তখনও ভারতের কিছু ক্রিকেটার চোট পান। মাত্র ২টি উইকেট হারানোর পর বেদী ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের কৌশল মেনে নিতে পারেননি তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ় সহজেই সেই ম্যাচ জেতে।
সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। পরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি এক দিনের ম্যাচে জিততে ১৪ বলে ২৩ রান দরকার ছিল ভারতের। জেতার জন্যে পাকিস্তানের বোলারেরা একের পর এক বাউন্সার দিচ্ছিলেন। বিরক্ত বেদী খেলতে চাননি। দলকে মাঠ ছেড়ে উঠে যেতে বলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক যিনি মাঠ থেকে দল তুলে নিয়েছিলেন। আর একটি ঘটনা ঘটে ১৯৭৬-৭৭ সালে ইংল্যান্ড সিরিজ়ের সময়। মাদ্রাজ় (অধুনা চেন্নাই) টেস্টে ইংরেজ বোলার জন লিভারের বিরুদ্ধে বলে অবৈধ ভাবে ভেসলিন লাগানোর অভিযোগ এনেছিলেন বেদী। পরে দেখা যায় লিভার কোনও অনৈতিক কাজ করেননি। বেদীর বোলিং ভদ্র হলেও অধিনায়ক হিসাবে তিনি বেশ আগ্রাসী ছিলেন।
১৯৯০ সালে প্রথম বার ভারতীয় দলের কোচ হয়েছিলেন বেদী। সেই অধ্যায় অবশ্য ভাল কাটেনি। কিন্তু একটি সফরে ভারতীয় দল খারাপ খেলায় তিনি বলেছিলেন, গোটা দলকে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলা উচিত। তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। অনেকেই মনে করতেন, অধিনায়ক হওয়ার সুযোগ নিয়ে নিজে ম্যাচের পর ম্যাচে অতিরিক্ত বল করে গিয়েছেন।
ইদানীং ভারতীয় ক্রিকেটের হালচাল নিয়ে মোটেই খুশি ছিলেন না তিনি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে সহ্য করতে পারেন না। ঝামেলা লেগেছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। হরভজন সিংহেরও কড়া সমালোচনা করেছেন একাধিক বার। স্পিনারদের ১৫ ডিগ্রি হাত ভাঙার নিয়মকে কোনও দিন সমর্থন করেননি। যে কারণে মুথাইয়া মুরলীধরনকে একাধিক বার ‘বর্শাবাহক’ বলে কটাক্ষ করেছেন।
তবে ভারতীয় ক্রিকেটে কোনও দিনই বেদীর অবদান অস্বীকার করা যাবে না। ক্রিকেট ছাড়াও পরেও নানা কারণে খবরে থেকেছেন। সোমবার ভারতীয় ক্রিকেটে আক্ষরিক অর্থে এক নক্ষত্রের পতন হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy