(বাঁদিকে) রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি। —ফাইল চিত্র।
অফ স্টাম্প কোথায়, বুঝতে পারছেন না বিরাট কোহলি। প্রতি ইনিংসে আউট হচ্ছেন পঞ্চম বা ষষ্ঠ স্টাম্পের লাইনের বলে খোঁচা দিয়ে। গোটা অস্ট্রেলিয়া সফরে তাঁকে ভুগিয়েছে এই সমস্যা। সিডনিতে গুরুত্বপূর্ণ শেষ টেস্টের দু’ইনিংসেই একই ভাবে আউট হয়েছেন কোহলি। তিনি তবু পার্থে একটি শতরান করেছিলেন। রোহিত শর্মার অবস্থা আরও করুণ। শেষ ১৫টি টেস্ট ইনিংসের একটিতে ৫০ রানের বেশি করেছেন। ন’বার আউট হয়েছেন এক অঙ্কের রানে। স্বভাবতই জল্পনা তৈরি হয়েছে ভারতীয় দলের দুই সিনিয়র ব্যাটারের অবসর নিয়ে। শোনা যাচ্ছিল, অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরেই অবসর ঘোষণা করতে পারেন রোহিত এবং কোহলি। দু’জনেই অবশ্য জল্পনা উড়িয়ে দিয়েছেন।
এক সময় কোহলির মতো সমস্যায় পড়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকরও। ২০০৩-০৪ অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে অফ স্টাম্প কোথায় বুঝতে পারছিলেন না। সে সময়ও সচিনের ব্যাট থেকে এসেছিল ২৪১ রানের অপরাজিত ইনিংস। সিডনির ২২ গজে খেলা সেই টেস্টে একটাও ড্রাইভ মারতে দেখা যায়নি সচিনকে। যে শট খেলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছিলেন, সেটা নিজের ক্রিকেট অভিধান থেকেই মুছে ফেলেছিলেন সচিন। কোহলির ব্যাটিংয়ে সেই দৃঢ়তা দেখা যায়নি। একই ভুল করেছেন ইনিংসের পর ইনিংসে। সেরা ফর্মের কাছাকাছি নেই রোহিতও। ভারতীয় দলের দুই সিনিয়র ব্যাটারের পরিস্থিতিই বেহাল। অস্ট্রেলিয়ার কাছে টেস্ট সিরিজ় হারের পর ভারতীয় দলের কোচ গৌতম গম্ভীর বলে দিয়েছেন, তাঁর কাছে দলের সকলে সমান। কাউকে আলাদা গুরুত্ব দিতে রাজি নন। সে যে-ই হোক। দলে থাকার এক মাত্র শর্ত পারফরম্যান্স। গম্ভীর কি ঘুরিয়ে রোহিত-কোহলিকে বার্তা দিয়েছেন? ক্রিকেটমহলে জল্পনা তৈরি হয়েছে।
সিডনি টেস্টে রোহিত না খেলায় তীব্র হয়েছিল জল্পনা। খবর ছড়িয়ে পড়ে, মেলবোর্নেই শেষ টেস্ট খেলে ফেলেছেন রোহিত। প্রধান নির্বাচক অজিত আগরকর নাকি তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন, টেস্টের পরিকল্পনায় আর রাখা হবে না। দেশে ফেরার পর কোহলি এবং রবীন্দ্র জাডেজার কাছেও জানতে চাওয়া হবে তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে। তাতে মনে করা হচ্ছিল, দেশে ফিরে অবসর ঘোষণা করবেন রোহিত। ধীরে ধীরে একই পথে হাঁটতে পারেন কোহলি এবং জডেজাও। কিন্তু সেই জল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছেন রোহিত নিজেই। সিডনি টেস্টের দ্বিতীয় দিন মধ্যাহ্নভোজের বিরতির সময় রোহিত জানিয়ে দেন, অবসর নিচ্ছেন না। কারও কথাতেও অবসর নেবেন না। ঘনিষ্ঠ মহলে কোহলিও জানিয়েছেন, ২০২৭ বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলতে চান।
দুই ক্রিকেটার নিজেদের অবস্থান জানানোর পরও প্রশ্ন তুলছে ক্রিকেট মহলের একাংশ। বলা হচ্ছে, এক জন ক্রিকেটার কখন অবসর নেবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার তাঁর রয়েছে। আবার পারফর্ম না করতে পারলে দল থেকে বাদ দেওয়ার অধিকার রয়েছে নির্বাচকদের। অতীত রেকর্ড ভাঙিয়ে দিনের পর দিন জাতীয় দলে জায়গা আটকে রাখা যায় না। ব্যক্তি স্বার্থে দলের ক্ষতি করা যায় না। ফর্মে না থাকা রোহিত সিডনি টেস্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সেই বক্তব্যকেই আরও শক্তি যুগিয়েছেন। যেমন সঞ্জয় মঞ্জরেকর বলেছেন, ‘‘অবসরের সিদ্ধান্ত ওদের হাতে থাকলেও দেশের হয়ে খেলার বিষয়টি কারও হাতে নেই।’’ তাঁর বক্তব্য, কোনও ক্রিকেটার তাঁর ভবিষ্যৎ নিজে ঠিক করতেই পারেন। তাই বলে দলের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করার অধিকার তাঁর নেই। কোচ গম্ভীর বলেছেন, রোহিত-কোহলিরাই ঠিক করুক এর পর কী করবে।
আগামী সাড়ে পাঁচ মাস ভারতীয় দলের সূচিতে টেস্ট ম্যাচ নেই। এর পর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ টেস্টের সিরিজ় শুরু হবে ২০ জুন। সেই দলে কোন যুক্তিতে জায়গা হবে রোহিত, কোহলিদের। লাল বলের ক্রিকেটে বেশ কিছু দিন ধরে তাঁদের যা পারফরম্যান্স, তা দলে জায়গা ধরে রাখার মতো নয়। তাঁদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং অতীত সাফল্যের কথা মাথায় রেখেই খেলিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ভাবে কত দিন?
সিডনিতে না খেলার পক্ষে রোহিতের যুক্তি, ‘‘রান করতে পারছিলাম না। ব্যর্থ হলে তো মানতেই হবে। দলের স্বার্থে না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবসর নিইনি। শুধু এই ম্যাচটা না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ম্যাচে প্রভাব পড়ছিল। অধিনায়ক হিসাবে দলের কথা আগে ভাবি। কী করলে দলের লাভ ভাবি। সেই ভাবনা থেকেই সরে দাঁড়িয়েছি।’’
রোহিত নিজেই মেনে নিয়েছেন, তিনি ফর্মে নেই। আগামী ইংল্যান্ড সফরের আগে ভারতের টেস্ট ম্যাচও নেই। তা হলে কোন যুক্তিতে রোহিত লিডসে ভারতের প্রথম একাদশে থাকবেন? সাদা বলের ক্রিকেটে রান করে লাল বলের দলে ফিরবেন! নাকি রঞ্জি ট্রফি খেলবেন মুম্বইয়ের হয়ে? সেই পরিকল্পনার কথা জানাননি রোহিত। শেষ ১৫টি টেস্ট ইনিংসে রোহিতের সংগ্রহ ১৬৪ রান। শেষ চারটি টেস্টে কোহলি করেছেন ৮৫ রান। এই পরিসংখ্যান তাঁদের নামের পাশেই বেমানান। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শেষ ১০টি টেস্টের তিনটি জিতেছে ভারতীয় দল। ছ’টি ম্যাচ হেরেছে। বৃষ্টির জন্য ড্র হয়েছে একটি টেস্ট। ভারতীয় দলের বেহাল দশার অন্যতম কারণ ব্যাটিং ব্যর্থতা। বিশেষ করে রোহিত এবং কোহলির ধারাবাহিক ভাবে রান না পাওয়া।
রোহিতের বয়স এখন ৩৭। আরও দু’তিন বছর খেলার ইচ্ছা থাকতেই পারে তাঁর। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেটার সাইমন কাটিচ বলেছেন, ‘‘টেস্ট ক্রিকেটে শুরুর দিকে ব্যাট করার ক্ষেত্রে ৩৭ বছর বয়স আদর্শ নয়। টেস্টের ইতিহাস দেখলেই বোঝা যাবে। রোহিত কী করবে, সেটা অবশ্যই ওর ব্যাপার। তবে ওর রানগুলো দেখতে ভাল লাগছে না।’’ কোহলিকে নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। শেষ ৪০টি টেস্টে তাঁর গড় ৩২.২৯। ভারতের প্রথম সারির পরিচিত ব্যাটারদের টানা ৪০ টেস্টে এত কম গড় নেই। কেউই নিজেদের ক্রিকেটজীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়ের টানা ৪০টি টেস্টে এত কম গড়ে রান করেননি। যেমন চেতেশ্বর পুজারার ক্ষেত্রে এই গড় ৩৩.৩০। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে ৩৪.৩৮। দিলীপ বেঙ্গসরকারের ৩৫.৬৮। মহম্মদ আজহারউদ্দিনের ৩৬.৪৩। রাহল দ্রাবিড়ের ৩৮.৬৮। গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের ৩৯.৬৪। ভিভিএস লক্ষ্মণের ৩৯.৯৬। সুনীল গাওস্করের ৪২। সচিন তেন্ডুলকরের ৪২.৯৬। বীরেন্দ্র সহবাগের ৪৫.২৬। তবু খেলে চলেছেন কোহলি।
অস্ট্রেলিয়া সফরের শেষ দিকে তৈরি হওয়া অবসর বিতর্ক সামলাতে গম্ভীর, আগরকরেরা হয়তো রোহিত, কোহলিদের পরের টেস্ট সিরিজ়ের দলেও রাখবেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের মাটিতেও রান করতে না পারলে? দুই সিনিয়র ব্যাটারকে নিয়ে হয়তো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন কোচ, নির্বাচকেরা। লাল বলের ক্রিকেটে ফর্মে ফেরার জন্য রোহিত, কোহলিরা রঞ্জি ট্রফি খেলতে পারেন। এক মাসের রঞ্জি মরসুম বাকি রয়েছে এখনও। খেলবেন কি তাঁরা? কোহলি শেষ রঞ্জি খেলেছেন ২০১২ সালে। তাঁর পরেও এক বছর লাল বলের এই প্রতিযোগিতায় খেলেছিলেন সচিন। রোহিত শেষ রঞ্জি খেলেছেন ২০১৫ সালে। তাই প্রশ্ন থাকছেই।
ভারতীয় সাজঘরের প্রথম একাদশের সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন অভিমন্যু ঈশ্বরণ এবং সরফরাজ খান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দু’জনেই যথেষ্ট অভিজ্ঞ। ১০১টি প্রথম শ্রেণি ম্যাচে অভিমন্যুর রান ৭৬৭৪। গড় ৪৮.৮৭। শতরান ২৭টি। অন্য দিকে, ছ’টি টেস্ট খেলে একটি শতরান এবং তিনটি অর্ধশতরান করেছেন সরফরাজ। ৫৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে তাঁদের রান ৪৫৯৩। গড় ৬৫.৬১। শতরান ১৬টি। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন রোহিতের জায়গায় অভিমন্যু এবং কোহলির জায়গায় সরফরাজের সুযোগ পাওয়া উচিত। তাঁদের মতে, যোগ্য বিকল্প ক্রিকেটার থাকার পরও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না ভারতীয় দলের কোচ এবং নির্বাচকেরা।
সংশ্লিষ্ট দুই ক্রিকেটারের নাম রোহিত এবং কোহলি বলেই সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। ভারতীয় দলের প্রাক্তন ওপেনার আকাশ চোপড়ার মতে, নির্বাচকদের কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। অতীত দেখে লাভ নেই। তিনি নিজের ইউটিউব চ্যানেলে বলেছেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে কোহলির টেস্ট গড় ৩০.৭২। তিনটি শতরান করেছে। এই তথ্য কি যথেষ্ট উদ্বেগের নয়?’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘২০২০ সালে তিনটি টেস্টে কোহলির গড় ছিল ১৯.৩৩। ২০২১ সালে কোহলির গড় ১১টি টেস্টে ২৮.২১। কোনও শতরান নেই। ২০২২ সালে কোহলির ছ’টি টেস্টে গড় ২৬.৫০। কোনও শতরান নেই। তুলনায় ভাল ২০২৩ সাল। আটটি টেস্টে কোহলির গড় ৫৫.৯১। দু’টি শতরান করেছে। আর ২০২৪ সালে ১০টি টেস্টে কোহলির গড় ২৪.৫২। একটি শতরান। গত পাঁচ বছরে দেশের মাটিতে কোহলির ১৬টি টেস্টে গড় ২৯.৯২। এই সময় বিদেশের মাটিতে ২১টি টেস্টে গড় ৩১.৩৮। নিরপেক্ষ মাঠে দু’টি টেস্টে (টেস্ট বিশ্বকাপ ফাইনাল) গড় ৩০।’’ ভারতীয় দলের আর এক প্রাক্তন ক্রিকেটার ইরফান পাঠান বলেছেন, ‘‘যে কোনও তরুণ ব্যাটারও ২৫ গড়ে ম্যাচের পর ম্যাচ খেলতে পারে!’’ তাঁর মন্তব্যে সূত্র ধরে আকাশ বলেছেন, ‘‘সিদ্ধান্তটা নির্বাচকদেরই নিতে হবে। এর পর জুন মাসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট। যথেষ্ট সময় রয়েছে। ভবিষ্যতের রূপরেখা কোচ এবং নির্বাচকদেরই ঠিক করতে হবে।’’
টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক থেকে দু’জনেই অবসর নিয়েছেন। এক দিনের ক্রিকেটে তাঁদের পারফরম্যান্স এখনও প্রশ্নের মুখে পড়েনি। তবে টেস্টে দলে তাঁদের আর চাইছেন না অনেকেই। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সূত্রে খবর, জাতীয় নির্বাচকদেরও সায় রয়েছে। বিরক্ত গম্ভীরও। তাঁরা হয়তো চাইছেন, কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিবেকের ডাকে সাড়া দিন (সিডনিতে রোহিতের মতো) দুই সিনিয়র ব্যাটার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy