টেম্বা বাভুমা। — ফাইল চিত্র।
উচ্চতা মাত্র পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। দলের প্রায় সব সতীর্থই তাঁর থেকে লম্বা। উইকেট পতনের পর ছ’ফুট ন’ইঞ্চির মার্কো জানসেনের সঙ্গে হাত মেলাতে গেলে সমস্যা হয় বইকি! সতীর্থেরা তার জন্য পিছনে লাগতেও ছাড়েন না। বিরলকেশ মস্তকে হাত বুলিয়েও দেন কেউ কেউ। তবে যতই মজা করুন, প্রত্যেকেই অধিনায়কের জন্য জীবন দিয়ে দেবেন। এটাই দক্ষিণ আফ্রিকা দলে টেম্বা বাভুমার জনপ্রিয়তা। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার ওঠার পিছনে যদি সবচেয়ে বেশি কারও অবদান থেকে থাকে, তা হলে সেটা বাভুমারই।
আলাদা করে নজরে আসার মতো কোনও বৈশিষ্টই নেই তাঁর কাছে। খাটো উচ্চতার কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল। বাভুমার না আছে জনপ্রিয়তা, না আছে বাহারি ব্যাটিং, না আছে সমাজমাধ্যমে ছবির মেলা। আছে শুধু ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালবাসা। বাভুমাকে কেউ যদি এসে বলেন সারা দিন ব্যাটিং করে যেতে, তিনি সানন্দে সেটাই করে দেবেন। কেউ যদি বলেন শুধু ক্রিকেট নিয়ে ভাবতে, তিনি সেটাই করবেন। আসলে ক্রিকেট ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না বাভুমা।
এই দক্ষিণ আফ্রিকা দলে কোনও তারকা ক্রিকেটার নেই। আলি বাখার, জন্টি রোডস, ল্যান্স ক্লুজ়নার, ডেল স্টেনের দেশে টেস্ট খেলার লোক এখন আর পাওয়া যায় না। গত বছরের শুরুর দিকে যখন নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সারির দল পাঠিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, অনেকেই ভ্রু কুঁচকেছিলেন। দ্বিতীয় সারির দল পাঠানোর কারণটা আরও অবাক করার মতো। দেশের প্রথম সারির সব ক্রিকেটার ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। নিউ জ়িল্যান্ড সিরিজ়ের সঙ্গে একই সময়ে পড়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা টি২০ লিগ। ফলে ফ্র্যাঞ্চাইজ়িগুলি কেউই ভাল ক্রিকেটারদের ছাড়তে রাজি হয়নি। এমন একজনকে দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক করেছিল, যাঁর দেশের হয়ে সেটাই ছিল প্রথম ম্যাচ! স্বাভাবিক ভাবেই কিউয়ি দেশে গিয়ে গো-হারা হারে দক্ষিণ আফ্রিকা। তার পরেও সেই দেশই কিনা টেস্ট বিশ্বকাপের ফাইনালে!
নিন্দকেরা বাভুমাকে ‘কোটার ক্যাপ্টেন’ বলতেন। এখনও হয়তো কেউ কেউ বলেন। কারণ অধিনায়ক হিসাবে তাঁর জায়গা কিছু দিন আগেও টলমলে হয়ে গিয়েছিল। ২০২৩-এর এক দিনের বিশ্বকাপে বাভুমা ব্যাট হাতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হন। দল সেমিফাইনালে উঠলেও বাভুমার অবদান সে ভাবে ছিলই না। স্বাভাবিক ভাবেই যাবতীয় সমালোচনার শিকার হতে হয় তাঁকে। বলা হয়, অধিনায়ক বলেই দলে জায়গা পেয়ে গিয়েছেন তিনি। পাল্টা বাভুমা বলেছিলেন, হারের দোষ তাঁর একার নয়। তার জন্যও সমালোচিত হতে হয়েছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রিকেট মূলত শ্বেতাঙ্গদেরই খেলা। তবে নির্বাসন কাটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার পর সে দেশের প্রথম একাদশে নির্দিষ্ট সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গকে খেলাতেই হয়। তবে বেশির ভাগ কৃষ্ণাঙ্গই বোলার। মাখায়া এনতিনি, ভার্নন ফিল্যান্ডার থেকে আজকের কাগিসো রাবাডা বা লুনগি এনগিডি, প্রত্যেকেই কৃষ্ণাঙ্গ। তার মাঝেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাভুমা। বোলার নন, তিনি আদ্যোপান্ত ব্যাটার। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসাবে শতরান, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক— দু’টি নজিরই তাঁর। মাত্র ৯টি টেস্টে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার মধ্যে জিতেছেন সাতটিতেই। চোট না থাকলে আরও অনেক বেশি টেস্টে দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন।
কেপ টাউনে লাঙ্গা এলাকা থেকে উঠে এসেছেন বাভুমা। লাঙ্গায় মূলত কৃষ্ণাঙ্গদেরই বসবাস। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশেরা লাঙ্গায় এসে থাকতে শুরু করে। অন্য অনেক জিনিসের পাশাপাশি লাঙ্গায় আমদানি হয় ক্রিকেটের। সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ জনজাতির মধ্যে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে খেলাটি। তবে বেশির ভাগেরই পছন্দ ছিল বোলিং। ধীরে ধীরে লাঙ্গা থেকে একের পর এক বোলার উঠে আসতে থাকে। কিন্তু ব্যাটার উঠে আসছিল না। সেই অভাব মিটিয়েছেন বাভুমা।
নেপথ্যে রয়েছেন তাঁর দুই কাকা। ছোট থেকেই বাভুমাকে ক্রিকেট শেখাতেন তাঁরা। মাত্র চার বছর বয়সেই ব্যাট হাতে ধরতে শিখে গিয়েছিলেন বাভুমা। ওই বয়সেই ক্লান্তিহীন ভাবে সারা দিন ব্যাটিং করতে পারতেন। দুই কাকা হাঁপিয়ে পড়তেন। ছোট্ট বাভুমার মধ্যে ক্লান্তির কোনও ছাপ দেখা যেত না। লড়াই করার জেদটা তখন থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাভুমার অভিষেক। প্রথম টেস্টে মাত্র ১০ এবং ১৫ রান করেছিলেন। পরের টেস্টে অর্ধশতরান করেন। ২০১৫-১৬ মরসুমে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শতরান করে দলে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেন বাভুমা। তবে তখন থেকেই একটা তকমা তাঁর নামের পাশে সেঁটে গিয়েছে। তিনি ভাল খেলেন, কিন্তু তারকা হওয়ার জন্য যে মশলা দরকার সেটা তাঁর মধ্যে নেই। আজও এই তকমা বয়ে বেড়াতে হয়। বাভুমা ক্রিজ়ে নামবেন, ধরে খেলবেন, আস্তে আস্তে রান করবেন— এটাই যেন পরিচিত দৃশ্য। তিনি বিরাট কোহলির মতো কভার ড্রাইভ মারতে পারেন না, রোহিত শর্মার মতো পুল করতে পারেন না, জো রুটের মতো র্যাম্প শট মারতে পারেন না। কিন্তু দলের দরকার হলেই তিনি খেলে দেন।
শ্রীলঙ্কা সিরিজ়ের কথাই ধরা যাক। চোট পেয়ে তার আগে বাংলাদেশ সিরিজ় থেকে বাভুমা ছিটকে যাওয়ার পর অনেকেই সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন। শ্রীলঙ্কা সিরিজ়ে ফিরে একার কাঁধে দলকে টানেন বাভুমা। চার ইনিংসে তিনটি অর্ধশতরান এবং একটি শতরান। একটি ম্যাচে প্রায় দেড় ফুট লাফিয়ে বাভুমার আপার কাট মারার দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে। অধিনায়ক হয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে বড় রান পাননি। দ্বিতীয় টেস্টে আবার শতরান। ১০০ পেরনোর পর লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাসের দৃশ্যও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথম টেস্টে যে ভাবে হারের মুখ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছে, তার প্রশংসা করেছেন প্রত্যেকে।
২০১৪ সালে বাভুমা যখন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলেছিলেন, তখন সেই দল ছিল তারকায় ভরা। একে একে সেই তারা খসে পড়তে থাকে। বাভুমার অভিষেকের পর থেকে এমন কোনও বছর যায়নি, যখন কোনও তারকা ক্রিকেটার অবসর নেননি। দু’বছরে তিন বার অধিনায়ক বদলেছে। হাশিম আমলা থেকে ডিভিলিয়ার্স থেকে ডুপ্লেসি। ব্যাটন বদলেছে বার বার। জোরে বোলারেরা বার বার চোট পাচ্ছিলেন। র্যাঙ্কিংয়ে ক্রমশ নামছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। টেস্টের মর্যাদা খোয়ানোর দশাও হয়েছিল।
অভিষেকের প্রথম আট বছরে বাভুমা মাত্র একটি শতরান করেছিলেন। ২০টি অর্ধশতরানের বেশির ভাগই এসেছিল কঠিন পরিস্থিতিতে। কিন্তু পরিসংখ্যান তো ভুল বলে না। কোহলি তো দূর, বাবর আজমের পরিসংখ্যানও তাঁর থেকে ভাল। ৬৩টি টেস্ট খেলে বাভুমার গড় মাত্র ৩৭.২৩। সেখানে স্টিভ স্মিথ, জো রুট, কেন উইলিয়ামসনদের গড় পঞ্চাশের উপরে।
২০২১ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে বাভুমা চোটের কারণে দশটি টেস্ট খেলতে পারেননি। আচমকা তাঁকে সাদা বলের অধিনায়ক বানিয়ে দেওয়া হয়। দু’টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। এক দিনের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে বিদায়। বার বার আলোচনা হতে থাকে ‘কোটার ক্যাপ্টেন’কে নিয়ে। সমালোচনার মুখে কখনও ভেঙে পড়েননি তিনি। বলেছেন, “আমি খুব একটা বলিয়ে-কইয়ে নই। আমি ব্যাটকে কথা বলাতে ভালবাসি। বোলার হলে বলকে কথা বলাতাম। এই মানসিকতা কখনওই বদলাব না।”
বাভুমা সমাজমাধ্যমে আত্মপ্রচারে হয়তো বিশ্বাসী নন। কিন্তু সমাজমাধ্যম তাঁর পিছু ছাড়ে না। মাঝেমাঝেই বিভিন্ন কারণে ‘ভাইরাল’ হয়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক। ২০২৩ বিশ্বকাপের আগে অধিনায়কদের যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে বাভুমার ‘ঘুমিয়ে পড়ার’ একটি দৃশ্য ছড়িয়ে পড়েছিল। বাভুমা নিজেই বলেছিলেন, তিনি ঘুমোননি। মন দিয়ে বাকিদের কথা শুনছিলেন। পাকিস্তান টেস্টেও জলপানের বিরতির মাঝে সতীর্থের পায়ে ভর দিয়ে তাঁর চোখ বুজে থাকার ছবি ছড়িয়ে পড়েছে।
১০ বছরের অধ্যবসায় অবশেষে সফল হয়েছে টেস্ট বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে। ফাইনালে না উঠলে তাঁকে নিয়ে কোনও আলোচনা আদৌ হত কি না সন্দেহ। কী বদলেছে এই দশ বছরে? বাভুমার কথায়, “আমার কয়েকটা চুল পড়ে গিয়েছে। আর কিছু বদলায়নি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy