দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে ধস নামানোর পর মহম্মদ সিরাজ। বুধবার কেপ টাউনে। ছবি: আইসিসি।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সাত ব্যাটারের ছ’জনই মহম্মদ সিরাজের ঝুলিতে। হায়দরাবাদের জোরে বোলারের আগুনে বোলিংয়ে ২৩.২ ওভারে ৫৫ রানেই শেষ ডিন এলগারদের ইনিংস। গত সেপ্টেম্বরে এশিয়া কাপ ফাইনালের পর কেপ টাউনের মাটিতে ভারতের সিরিজ় বাঁচানোর টেস্ট— আরও এক বার ক্রিকেট বিশ্ব দেখল সিরাজ কতটা ভয়ঙ্কর।
একটা সময় পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেটে জোরে বোলার তৈরি হত না। মিডিয়াম পেসারেরাই ছিলেন ভরসা। গত দু’দশকে সেই ছবি বদলে গিয়েছে। একের পর এক জোরে বোলার উঠে এসেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের আঁতুড়ঘরগুলি থেকে। বিশ্বের যে কোনও পিচে নিজেদের দিনে যাঁরা প্রতিপক্ষকে একাই শেষ করে দিতে পারেন। এই তালিকার শেষ উল্লেখযোগ্য সংযোজন সিরাজ। সেই সিরাজ যিনি বাবার মৃত্যুর খবর শুনেও অস্ট্রেলিয়া সফরের মাঝে দেশে ফিরতে চাননি। ২০২০ সালে মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্টে অভিষেকের সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। সদ্যপ্রয়াত অটোচালক বাবার স্বপ্ন সফল করতে থেকে গিয়েছিলেন দলের সঙ্গে। চোখের জল লুকিয়ে দেশের জন্য মাঠে নেমে ছিলেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চের সঙ্গে অবশ্য তার তিন বছর আগেই পরিচিত হয়েছিলেন সিরাজ।
দেশের হয়ে ছেলে টেস্ট খেলবে স্বপ্ন দেখতেন মহম্মদ ঘাউস। বাবার স্বপ্ন ব্যর্থ হতে দেননি সিরাজ। সেই তিনিই এখন ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের স্বপ্ন সফল করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। গত তিন দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে মাত্র চারটি টেস্ট জিতেছে ভারতীয় দল। এতটা করুণ রেকর্ড আর কোনও দেশের মাটিতে নেই। এ বারও সেঞ্চুরিয়নে প্রথম টেস্ট ইনিংস এবং ৩২ রানে হেরে গিয়েছিলেন রোহিত শর্মারা। কেপ টাউন টেস্ট ড্র হলেও ফ্রিডম ট্রফি হারতে হবে। এই পরিস্থিতিতে জিততেই হত রোহিতদের। প্রথম ২ ঘণ্টাতেই সেই জয়ের স্বপ্ন দেখালেন সিরাজ। স্বপ্ন দেখাল অ্যালান ডোনাল্ডের দেশে ২৯ বছরের জোরে বোলারের বিদ্যুৎগতি।
এশিয়া কাপ ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২১ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন সিরাজ। বুধবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্টে নিলেন ১৫ রানে ৬ উইকেট। লাল বলের ক্রিকেটে এটাই তাঁর সেরা বোলিং। এক দিনের বিশ্বকাপে প্রত্যাশিত ফর্মে ছিলেন না। ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। সমালোচনাও হয়েছিল। সিরাজ ফর্ম ফিরে পেলেন বিদেশের মাটিতে।
বাবার অটো চেপে ক্রিকেট শিখতে যাওয়া সিরাজের জীবন বদলে দিয়েছে ক্রিকেট। হায়দরাবাদে নতুন বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করলেও সযত্নে রেখে দিয়েছেন বাবার সঙ্গে দিন কাটানো একফালি ঘরটাও। সেই ঘরই যে তাঁর স্বপ্নকে লালন করেছে। তাঁকে সিরাজ করে তুলেছে। বাবার স্মৃতি আগলে রেখেছেন। সময় পেলে ঘুরে আসেন বাবার ছোঁয়া লেগে থাকা সেই ঘরে। অটোয় চড়ে স্বপ্নকে ধাওয়া করা সিরাজ এখন বিএমডব্লিউ গাড়ি চড়েন। পরিবারে অভাব-অনটন নিত্য সঙ্গী হলেও ছোট ছেলের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে কখনও বাধা দেননি ঘাউস। অভিষেক টেস্টে জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠতেই আবেগ সামলাতে পারেননি সিরাজ। সদ্যপ্রয়াত বাবার কথা মনে পড়ায় কেঁদে ফেলেছিলেন। সিরাজ এমনই এক জন। যিনি নিজে প্রকাশ্যে কাঁদেন। আবার বল হাতে প্রতিপক্ষকে কাঁদাতেও জানেন।
টেনিস বলের ক্রিকেটে একাধিক ম্যাচ জেতানোর খবর পেয়ে সিরাজের বাবা তাঁকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন স্থানীয় কোচিং ক্যাম্পে। অর্থাভাবে সেই কোচিং সেন্টারের খরচ চালানোও সম্ভব হত না। কিন্তু ছোটবেলার কোচ কে সাইবাবা খুদে পেসারের প্রতিভা দেখে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়ে যান। সে দিন থেকেই শুরু হয় সিরাজের যাত্রা। অনূর্ধ্ব-১৯ প্রতিযোগিতায় নামার আগে জুতো ছিল না সিরাজের কাছে। অটোচালক বাবা সারা রাত ধরে অটো চালিয়ে প্রথম জুতো কিনে দেন সিরাজকে। সেই জুতো পরে পাঁচ উইকেট নিয়ে বাবার পরিশ্রমকে যথার্থ সম্মান জানান সিরাজ।
সিরাজকে পরিশ্রম করার মন্ত্র দিয়েছিলেন তাঁর বাবা। দেশের জন্য খেলার উৎসাহও দিতেন ক্রমাগত। বাবার কাছে পাওয়া শিক্ষা প্রতি পদে কাজে লাগিয়েছেন সিরাজ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করতে পারেন। জাতীয় দলে নিয়মিত হওয়ার পরেও প্রয়োজন মনে হলেই পরামর্শ নেন ছোটবেলার কোচের। এখনও আস্থা রাখেন নিজের শুরুর দিনগুলোয়। টেস্টে সিরাজের প্রথম ৬ উইকেটে আস্থা রাখতে পারেন রাহুল দ্রাবিড়েরাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy