মঙ্গলবার কলকতা নাইট রাইডার্স বনাম লখনউ সুপারজায়ান্টস। একটা কলকাতার দল। অন্যটা কলকাতার মালিকের দল। রবিবার দুপুরে বাইপাসের ধারে টিম হোটেলে বসে আনন্দবাজার-কে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন জ়াহির খান। নিলামে বিক্রি না হওয়া শার্দূল ঠাকুরকে নেওয়ার কথা হঠাৎ কেন মাথায় এল? ঋষভ পন্থ কেমন অধিনায়ক? তরুণ লেগস্পিনার, এ বারের আইপিএলের চমক দিগ্বেশ রাঠিকে কী ভাবে আবিষ্কার করলেন? নানা প্রশ্নের সামনে খোলামেলা, অকপট ভারতকে বহু ঐতিহাসিক জয় উপহার দেওয়া বাঁ হাতি পেসার ও বর্তমানে এলএসজি মেন্টর।
প্রশ্ন: মুম্বই ইন্ডিয়ানসকে হারিয়ে ইডেনে নামছেন। দলের মনোবল কেমন?
জ়াহির খান: খুব জরুরি ২ পয়েন্ট নিয়ে এসেছি আমরা। দরকার ছিল এই জয়টার। সামনে অনেক লম্বা দৌড়, দলে সকলে সেই যাত্রা নিয়ে উত্তেজিত। এলএসজি-র মন্ত্র হচ্ছে, প্রক্রিয়ার উপর নজর দাও। ফলঠিকই আসবে।
প্র: প্রক্রিয়া বলতে কী?
জ়াহির: ভারসাম্য হারিও না। ফোকাস ঠিক রাখো। ফল সব সময় সমান হবে না। কোনও দিন জিতবে, কখনও আবার দিনটা তোমার হবে না। কিন্তু পরিশ্রম করে যাও, চেষ্টায় ত্রুটি রেখো না। মনে রাখতে হবে, আইপিএলে কোনও সহজ ম্যাচ হয় না। সবাই কঠিন প্রতিপক্ষ।
প্র: একটা নতুন মরসুমের শুরুতে কোচ বা মেন্টরের প্রথম লক্ষ্য কী থাকে?
জ়াহির: প্রথম কাজ টিম বন্ডিং। এক পরিবার করে ফেলতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। বড় নিলামের পরে নতুন দল, নতুন সব ক্রিকেটার এসেছে। পুরনো কয়েক জন থেকে গিয়েছে। সকলকে এক ছাতার তলায় আনা প্রথম কাজ। দেখতে হবে যাতে ভারসাম্য গড়ে ওঠে। ড্রেসিংরুম সংস্কৃতির ব্যাপার আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক আবহাওয়া খুব দরকার। ফল বিপক্ষে গেলেও যেন ভাল দিকগুলো খুঁজে পাই। যেন শিখতে পারি হার থেকে।
প্র: চারটে ম্যাচের পরে দল নিয়েকী বলবেন?
জ়াহির: এটুকু বলতে পারি, বন্ডিংটা দারুণ হয়ে গিয়েছে। খুব জোরের সঙ্গে বলতে পারি, প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাফল্য উপভোগ করছে। দলগত সাফল্য পেতে গেলে এটাখুব জরুরি।
প্র: অধিনায়ক ঋষভ পন্থকেকেমন দেখছেন?
জ়াহির: এলএসজি-র যে দলীয় মন্ত্রের কথা বলছি, তাতে ঋষভ খুব বড় ভূমিকা নিয়েছে। ড্রেসিংরুম সংস্কৃতি গড়ে তুলছে। ক্রিকেটারদের স্বাধীনতা দিচ্ছে। যে কেউ মন খুলে কথা বলতে পারে। বুঝিয়ে দিচ্ছে, ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য আলাদা করে কাউকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে না। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলোচনার দরজা সব সময় খোলা।
প্র: ঋষভের অধিনায়কত্বের কোন দিকটা সব চেয়ে বেশি করে আপনার পছন্দ হচ্ছে?
জ়াহির: ম্যাচ নিয়ে ওর ভাবনা দারুণ। সাহস আছে, ভাবনাও আছে। ভাল অধিনায়ক হতে গেলে দু’টোই খুব দরকার। দিগ্বেশ রাঠিকে আঠারোতম ওভারে বল করাতে সে-ই পারে, যার মস্তিষ্ক সচল আর বুকের পাটা আছে। তা ছাড়া ঋষভ ক্রিকেটীয় আলোচনা করতে ভালবাসে, যেটা বড় গুণ। দলের হয়ে এগারো জন মাঠে নামে কিন্তু বেঞ্চেও অনেকে থাকে। যারা হয়তো সেই ম্যাচটা খেলল না কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে তাদের লাগতে পারে। তাই সবাইকে তৈরি রাখার একটা ব্যাপার থাকে। ২৪ জন ক্রিকেটারের একটা দল, সঙ্গে কোচের টিম। এত বড় একটা পরিবার নিয়ে চলা মোটেও সহজ কাজ নয়। কিন্তু ঋষভের বড় গুণ হচ্ছে, সকলকে সময় দিচ্ছে। সবাইকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনছে, জানছে। কোনও ক্রিকেটার যদি দেখে অধিনায়ক স্বয়ং যত্ন নিচ্ছে, তার মনোভাবই পাল্টে যেতে পারে। আমার মনে হচ্ছে, দুর্দান্ত এক অধিনায়ককে চোখের সামনে গড়ে উঠতে দেখছি।
প্র: কী দেখে প্রথম মনে হয়েছিল ঋষভের মধ্যে নেতৃত্ব গুণ রয়েছে?
জ়াহির: অনূর্ধ্ব উনিশ থেকে সবে বেরিয়েছে তখন। আমি দিল্লি ক্যাপিটালসে ছিলাম। তখনই দেখতাম, কয়েক ওভার পরে কী ঘটতে চলেছে, আগে থেকে আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। সব সময় ঘটনা ঘটার আগে ভাবার চেষ্টা করছে। আইপিএলে অধিনায়ককে সব সময় সজাগ থাকতে হয়। নিখুঁত হতে হয়। কুড়ি ওভারের খেলা। একটা ভুল সিদ্ধান্ত সব শেষ করে দিয়ে যেতে পারে। রিকভারির সময় নেই। আমি বলব, চারটে ম্যাচে ঋষভ সব কিছু দারুণ সামলেছে।
প্র: কিন্তু ঋষভ একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। বলা হচ্ছিল, মহেন্দ্র সিংহ ধোনির পরে এত প্রতিভাবান কিপার-ব্যাটসম্যান আসেনি। অথচ ভারতীয় দল থেকে বাদ। বেঞ্চে বসে থাকছেন। আইপিএলে একটা ম্যাচেও রান পাননি। কী বলছেন এইসময়ে ঋষভকে?
জ়াহির: আমি এটাকে কঠিন অধ্যায় হিসেবে দেখছিই না। ঋষভ এলএসজি ক্যাপ্টেন। শুধু একটা বিভাগে ও কী করছে, তা দেখলে হবে না। টিমটাকে কেমন চালাচ্ছে, সেটা সব চেয়ে আগে দেখব এবং ঋষভ সব মিলিয়ে দারুণ করছে। মনে রাখবেন এটা টিম গেম। ব্যক্তিগত স্কোরকার্ড এখানে কাজে আসবে না যদি না টিম জেতে। ঋষভের সঙ্গে আমরা ওর ব্যাটিং নিয়ে কোনও কথাই বলছি না। যা বলছি, সবই টিম নিয়ে। ওর ব্যাটিং নিয়ে কার সন্দেহ থাকবে? দুনিয়ার সর্বত্র সব ফর্ম্যাটের ক্রিকেটে রান করেছে। রান আসবেই, আমি চিন্তায় নেই।
প্র: কী দেখে এতটা আত্মবিশ্বাসীহতে পারছেন?
জ়াহির: ঋষভ ইজ় আ ফাইটার। যে জীবনের রাস্তায় এমন যুদ্ধ জিতে ফিরে এসেছে, তার কাছে বাইশ গজের লড়াই কী! এক বছর ক্রিকেট খেলতে পারেনি। তার পরেও জেদটা দেখুন, কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি। এ রকম চরিত্রকে নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হব না তো কাকে নিয়ে হব?
প্র: দু’জনের নির্বাচন নিয়ে জানতে চাইব। এক, শার্দূল ঠাকুরকে আপনার ফোন। নিলামে যাঁকে কেউ কেনেনি। দুই, দিগ্বেশ রাঠি। যার কথা সে ভাবে কেউ শোনেনি। দু’জনেই বল হাতে চমকে দিয়েছেন।
জ়াহির: আমাদের স্কাউটিং টিম আছে। নতুন ছেলেদের আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাদের দিতে হবে। শার্দূলের ক্ষেত্রে আমাদের মনে হয়েছিল, অভিজ্ঞতা আছে, কাজে লাগবে।
প্র: চারদিকে ছক্কার বৃষ্টি চলছে।এর মধ্যে বোলারেরা কী ভাবেমাথা ঠিক রাখবেন? আপনি কী বলছেন বোলারদের?
জ়াহির: একটাই কথা বলছি। খোলা মনে মাঠে নামো, নিজের অস্ত্রগুলো নিয়ে ভাবো। ওরা (ব্যাটসম্যানেরা) কী করবে, সে সব ভেবে মাথা গুলিয়ে দিও না। নিজের কাজের উপরে মনোনিবেশ করো।
প্র: ইডেনের ম্যাচ নিয়ে কী প্রত্যাশা?
জ়াহির: কলকাতা খুব খেলা পাগল শহর। ইডেনের গ্যালারি মানে সেরা আবেগ। সব সময় ভাল খেলাকে কুর্নিশ করে ইডেন। প্রতিপক্ষও এখানে সমান সম্মান পায়। আশা করব, আমাদের ছেলেরা এমন ক্রিকেট খেলবে যাতে ইডেন তাদেরওসমর্থন করে।
প্র: এলএসজি-রও তো কলকাতা যোগাযোগ রয়েছে। মালিক সঞ্জীব গোয়েন্কা কলকাতার। ফুটবলে মোহনবাগান টিম রয়েছে। সেটা কি দর্শক সমর্থনে সাহায্য করবে?
জ়াহির: আশা করছি, ইডেনের সমর্থন আমাদের দিকেও থাকবে। গত বছরের মতো মোহনবাগান সুপারজায়ান্টসের জার্সি পরে এ বারে এলএসজি মাঠে নামবে কি না, জানি না। কিন্তু একটা কথা বলতে পারি। কলকাতায় এলেই, ইডেনে গিয়ে দাঁড়ালেই একটা অন্য রকম উত্তেজনা অনুভব করি। কিছু একটা আছে বাতাসে যা ক্রিকেটারদের রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়। আমি নিশ্চিত, আমাদের টিমের এখনকার ছেলেরাও সেটা অনুভব করবে। টিমের মালিক এই শহরের, তাই টিমও বিশেষ কিছু করতে চায় এই ম্যাচে।
প্র: ইডেনের পিচ নিয়ে জোর চর্চা হচ্ছে জানেন নিশ্চয়ই। কী আশা করছেন বাইশ গজ নিয়ে?
জ়াহির: দেখুন, উইকেট এমন একটা জিনিস যা আমাদের হাতে নেই। আমরা পিচ দেখব, বিশ্লেষণ করব সেই মতো টিম স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা হবে হয়তো ব্যস। তার বেশি মাথা ঘামাচ্ছি না।
প্র: কেকেআর কতটা কঠিন প্রতিপক্ষ?
জ়াহির: ওরা গতবারের চ্যাম্পিয়ন। আমি এ ভাবে দেখছি যে, এলএসজি-কে যদি এ বারের আইপিএল জিততে হয়, তা হলে গতবারের চ্যাম্পিয়নকে হারানোর দক্ষতা দেখাতে হবে। কেকেআর গোছানো দল, পরিকল্পনা করে খেলে, প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার রয়েছে। তাই বিপজ্জনক দল। আমাদের খুব ভাল খেলতে হবে ওদের হারাতে গেলে। আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, এই ম্যাচটা তার আন্দাজ দিয়ে যাবে।
প্র: শেষ প্রশ্ন। পয়েন্ট টেবলে ইতিমধ্যেই ঠেসাঠেসি শুরু হয়ে গিয়েছে। ছ’টা দল ৪ পয়েন্টেদাঁড়িয়ে (রবিবারের রাতের ম্যাচের আগে পর্যন্ত)। এখান থেকে ট্রফি জিততে গেলে কোন জিনিসটা সব চেয়ে জরুরি?
জ়াহির: এখন পয়েন্ট টেবলের দিকে তাকাবই না। ছেলেদের জন্য একটাই বার্তা, মাঠে নামো আর সেরাটা দাও। নিজেদের প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলো। আর আমাদের কাজ, পরিকল্পনায় বিন্দুমাত্র গলদ না রাখা। ব্যস। পয়েন্ট টেবল পরে দেখা যাবে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)