বিসিসিআইয়ের নতুন সভাপতি হয়েছেন রজার বিন্নী। —ফাইল চিত্র
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে স্পষ্ট জানিয়েছেন, নিজের দায়িত্ব ভাল ভাবে পালন করবেন। যদি মনে করেন, কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, নেবেন। কিন্তু বিতর্কে জড়াবেন না। বিতর্কে জড়াতে চান না রজার বিন্নী। যে ভাবে ক্রিকেট জীবন ও তার পরেও ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীন কোনও বিতর্কে জড়াননি, সে ভাবেই নতুন অধ্যায়েও বিতর্ক থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে চান ভারতীয় দলে খেলা প্রথম অ্যাংলো ক্রিকেটার।
ঘটনাচক্রে বিন্নী যাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন, সেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনে নানা বিতর্ক এসেছে। সে খেলোয়াড় জীবনে কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে তাঁর বিবাদ হোক, বা বিসিসিআই সভাপতি হওয়ার পরে তৎকালীন অধিনায়ক বিরাট কোহলির সঙ্গে মতানৈক্য। বিন্নীর বাবা পেশায় রেলকর্মী ছিলেন। বদলির চাকরি। বাবার সঙ্গে বিন্নীকেও অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে। তাঁর সঙ্গে ‘মহারাজ’-এর অনেক তফাত। দু’জনের পারিবারিক অবস্থা, বড় হয়ে ওঠা, খেলোয়াড় জীবন সব কিছুই যেন দু’টি বিপরীত মেরু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সৌরভকেই সিংহাসন থেকে সরিয়ে তাঁর জায়গা নিলেন বিন্নী।
স্কুলে থাকাকালীন শুধু ক্রিকেট নয়, তার সঙ্গে ফুটবল, হকি, জ্যাভেলিন, ডিসকাস থ্রো-সহ বেশ কয়েকটি খেলায় দক্ষ ছিলেন বিন্নী। হকিতে খেলতেন লেফ্ট ব্যাক, ফুটবলে গোলরক্ষক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটকেই বেছে নেন এই ডান হাতি অলরাউন্ডার। মূলত পেস বোলার হলেও ব্যাটের হাত মন্দ ছিল না বিন্নীর। ক্রিকেটকে বেছে নেওয়ার একটা বড় কারণ তাঁর পরিবার। প্রতি রবিবার পরিবারের বাকি ভাইদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে যেতেন বিন্নী। রেলকর্মী বাবার পছন্দের খেলাকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নেন।
১৯৭৫ সালে প্রথম কর্নাটক দলে খেলার সুযোগ পান বিন্নী। র়ঞ্জিতে ভাল খেলায় সুযোগ পান ভারতীয় দলে। তবে বিন্নীর সেরা সময় ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫। বিশ্বকাপের কয়েক মাস আগেই দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। তাঁকে বিশ্বকাপের দলে রাখতে নির্বাচকদের সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া করেছিলেন অধিনায়ক কপিল দেব। অধিনায়কের ভরসার দাম দিয়েছিলেন বিন্নী। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে সব থেকে বেশি ১৮টি উইকেট নিয়েছিলেন। দু’বছর পরে ১৯৮৫ সালের বিশ্ব ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপেও সব থেকে বেশি উইকেট তাঁর দখলে ছিল। সে বার ১৭টি উইকেট নিয়েছিলেন।
ক্রিকেট থেকে অবসরের পরে কোচিং করানো শুরু করেন বিন্নী। ২০০০ সালে ভারত প্রথম বার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছিল। মহম্মদ কাইফের নেতৃত্বাধীন সেই দলের কোচ ছিলেন তিনি। পরে কাইফ তাঁকে নিয়ে বলেছেন, ‘‘বিন্নী স্যর ছিলেন বলে আমি এতটা স্বাধীনতা পেয়েছি। উনি বেশি কথা বলতেন না। যতটুকু দরকার ততটাই পরামর্শ দিতেন। কোচ এত মাথা ঠান্ডা রাখতেন বলে দলের মধ্যে পরিবেশ খুব ভাল ছিল। তবে শান্ত হলেও খেলার বিষয়ে খুব কড়া ছিলেন স্যর। আমরা কোনও ভুল করছি কি না, সে দিকে সব সময় নজর থাকত তাঁর।’’
যুবরাজ সিংহকে জাতীয় দলের উঠোনে নিয়ে আসার পিছনে বড় ভূমিকা ছিল বিন্নীর। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আগে চেন্নাইয়ে শিবির হয়েছিল। সেখানে যুবরাজের খেলা দেখে সবাই বলেছিলেন, এই ছেলে বেশি দিন খেলতে পারবে না। কারণ, সব বলই আড়াআড়ি ব্যাটে খেলতেন যুবরাজ। কিন্তু সেখানে সবার বিরুদ্ধে গিয়ে যুবরাজকে দলে নিয়েছিলেন বিন্নী। পরে তিনি এই বিষয়ে বলেছেন, ‘‘ওটাই যুবরাজের স্বাভাবিক খেলা। ওটা আমি বদলাতে যায়নি। ওই টেকনিক নিয়েই সাদা বলের ক্রিকেটে অন্যতম বিধ্বংসী ব্যাটার হয়েছে যুবরাজ। ওকে বদলাতে গেলে তার ফল উল্টো হতে পারত।’’
ঠিক যেমনটা বিন্নীর স্বাভাবিক খেলা বদলাতে গিয়েও পারেননি তাঁর কোচ হেমু অধিকারী। বিন্নী বল করার সময় তাঁর পিছনের পা কিছুটা আড়াআড়ি পড়ত। ঠিক যেমনটা জ্যাভেলিন থ্রোয়ারদের হয়ে থাকে। অনেক চেষ্টা করেও পা সোজা করতে পারেননি হেমু। পরে বিন্নী বলেন, ‘‘ওই ভাবে বল করতে আমার কোনও সমস্যা হত না। ওই ভাবেই আমি কত কত উইকেট নিয়েছি। তা হলে খামোখা বদলাতে যাব কেন?’’
অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে সাফল্য পেলেও বড়দের দলের কোচ হতে পারেননি বিন্নী। সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তাঁর জায়গায় কোচ হয়ে আসেন জন রাইট। একটা কথাও বলেননি। চুপচাপ সরে গিয়েছিলেন। আবার যখন ম্যাচ গড়াপেটায় কর্নাটক ক্রিকেট সংস্থা জর্জরিত, তখন এগিয়ে এসেছেন সেই বিন্নী। দায়িত্ব নিয়েছেন। মাঝে বিসিসিআইয়ের নির্বাচকের দায়িত্ব সামলেছেন। তখনও বিতর্কের বাইরে থেকেছেন। তাঁর ছেলে স্টুয়ার্ট বিন্নী সেই সময় ভারতীয় দলে বেশ কয়েকটি সিরিজে খেলেছিলেন। যাতে স্বজনপোষণের কোনও অভিযোগ না ওঠে, তার জন্য অলরাউন্ডার নির্বাচনের সময় থাকতেন না বিন্নী। বাকিদের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিতেন।
এখন গল্ফ ছাড়া অন্য কোনও খেলা খেলতে পারেন না। প্রতি সপ্তাহে দু’দিন গল্ফ খেলতে যান। তাঁর ধৈর্য তাঁকে এই খেলায় উৎসাহী করে তুলেছে বলে জানিয়েছেন বিন্নী। বলেছেন, ‘‘গল্ফ খেলতে ধৈর্য লাগে। আমার সেটা আছে। তাই এই খেলাটা ভাল লাগে।’’ এ ছাড়া মাছ ধরা তাঁর খুব প্রিয়। মাঝেমধ্যেই বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
কর্নাটকের বন্দিপুরে বাগানবাড়ি রয়েছে বিন্নীর। সেখানেই বেশির ভাগ সময় থাকেন। পাশের জঙ্গল থেকে মাধেমধ্যে চিতা, হাতি চলে আসে সেখানে। আর রয়েছে অজস্র কুকুর। তাদের বেশির ভাগকেই রাস্তা থেকে তুলে এনেছেন বিন্নী। আপাত শান্ত বিন্নী শুধু একটি ক্ষেত্রেই রেগে যান। যখন দেখেন পথকুকুর বা অন্য কোনও পশুর উপর কেউ অত্যাচার করছে। তখন থাকতে পারেন না। প্রতিবাদ করেন।
পরিচিতরা বলেন, বিন্নীর কোনও বদল হয়নি। তিনি নিজেও মানেন সে কথা। বলেন, ‘‘স্কুলে ক্রিকেট খেলার সময় যেমন ছিলাম, এখনও তেমনটাই আছি। হতে পারে আমি বিশ্বকাপ জিতেছি। তাতে আত্মহারা হওয়ার কী আছে।’’ বিসিসিআই সভাপতি হওয়ার পরে কত ক্ষণ আর গল্ফ খেলে বা বাগানবাড়ির কুকুরদের সঙ্গে কিংবা মাছ ধরে তিনি কাটাতে পারবেন জানেন না, তবে তিনি বদলাবেন না, এমনটাই বলছেন ভারতের প্রথম অ্যাংলো ক্রিকেটার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy