অভিভূত: প্রথম দর্শনেই সচিনের প্রতিভা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় তৈরি হয়নি শাস্ত্রীর মনে। ফাইল চিত্র
লকডাউনে বাইরে বেরোনোর প্রশ্নই নেই। মুম্বইয়ে সময় কাটাচ্ছেন পরিবারের সঙ্গে। ক্রিকেট এখন গৌণ, মনে করছেন তিনি। মুখ্য হচ্ছে, সকলে মিলে মানবজাতির বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে করোনাভাইরাসকে হারানো। বলের পালিশ কী করে রক্ষা হবে, তা-ও পরে ভাবা যাবে। সচিন তেন্ডুলকরের ফাঁস করা নতুন কাহিনি সম্পর্কে তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়াও পাওয়া গেল। করোনা, ক্রিকেট, সচিন, বর্তমান ভারতীয় দল, নানা বিষয় নিয়ে ফের আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ভারতীয় দলের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। ফোনে দেওয়া খোলামেলা, দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের আজ প্রথম পর্ব...
প্রশ্ন: এক মাস পেরিয়ে গিয়েছে দেশবাসী লকডাউনে। কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন এই সময়কে?
রবি শাস্ত্রী: নজিরবিহীন। এমন ঘটনা কখনও আমাদের অনেক প্রজন্ম দেখেনি, কখনও শোনেওনি। আমাদের জীবদ্দশায় কেউ দেখেনি। এটা এমন একটা ট্র্যাজেডি, যা বিশ্বযুদ্ধের পরে আর দেখা যায়নি।
প্র: আপনি টুইটারে ভিডিয়ো বার্তা দিয়েছিলেন, এটা হচ্ছে সব বিশ্বকাপের উপরে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বকাপ। মাদার অফ অল ওয়ার্ল্ড কাপ্স। মানবতার বিশ্বকাপ।
শাস্ত্রী: একদমই তাই। সকলে একত্রিত হয়ে লড়াই করাটা খুব জরুরি। সকলকে সতর্ক থাকতে হবে এবং একজোটে জিততে হবে। সেই কারণে আমার মনে হয়েছে, এই সময়টা পুরো মানবজাতি এক হয়ে লড়ছে। সবার সেরা বিশ্বকাপ জয়ের জন্য আমরা এক হয়ে লড়ছি।
প্র: কী মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাস অতিমারি, এই লকডাউন কতটা বদলে দিতে পারে পৃথিবীকে?
শাস্ত্রী: আমার মনে হয়, যত ক্ষণ না প্রতিষেধক বেরোচ্ছে, আমরা পাল্টে যাওয়া এই পৃথিবীটাই দেখব। আগের সেই জীবনে ফেরা চট করে হয়তো সম্ভব হবে না। ভয় থাকবে, সংশয় থাকবে। দেখুন, এটা হতে বাধ্য। নজিরবিহীন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা সকলে যাচ্ছি। এই ভাবে দিনের পর দিন, এক মাসের উপরে আমরা কখনও কেউ বাড়িতে বসে থেকেছি? এই যে আপনার সঙ্গে এখন কথা বলছি, তা আমরা এখনও জানি না, আরও কত দিন এ ভাবে বাড়িতেই থাকতে হবে। তো এ রকম একটা অধ্যায় থেকে বেরিয়ে এসে মানসিক ভাবে আগের অবস্থায় ফিরতেও সময় লাগবে। রাতারাতি বোতাম টেপার মতো আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে, তা তো নয়।
প্র: কী ধরনের প্রভাব দেখা যেতে পারে বলে মনে হয়?
শাস্ত্রী: মানুষ হয়তো ট্র্যাভেল করতে চাইবে না। শুরুর দিকে ভয় আর সংশয় থাকবে। তাই অনেকেই হয়তো চেষ্টা করবে ফ্লাইটে করে ভ্রমণের ব্যাপারটা এড়াতে। প্রতিষেধক না-বেরোনো পর্যন্ত অন্তত আগের মতো স্বচ্ছন্দে ট্র্যাভেল করা যাবে বলে মনে হয় না। সেটা হওয়া স্বাভাবিকও। গোটা মানবজাতির এখন একটাই প্রার্থনা— প্রতিষেধকটা যেন দ্রুত আবিষ্কার হয়ে যায়।
প্র: আপনারা এত বেশি ট্র্যাভেল করেন। পুরো ভারতীয় দল সারা বছর ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তে খেলতে যাচ্ছে। কত দেশের কত মানুষের সংস্পর্শে আসছেন। ভক্তরা নিজস্বী নিতে আসছেন। সব কিছুর উপরেই কি প্রভাব পড়বে?
শাস্ত্রী: অবশ্যই পড়বে। কেউ কখনও তো ভাবতেই পারেনি এ রকম একটা ভাইরাসের আক্রমণের মুখে গোটা বিশ্ব পড়তে পারে। এমন ভাইরাস, যা কি না মাসের পর মাস সারা পৃথিবীকে লকডাউনে রেখে দেবে। ভাবুন তো এক বার। কোথাও বোমাবর্ষণ হয়নি। কেউ বুলেট ফায়ার করেনি। আকাশপথে ফাইটার জেট ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসেনি। কোনও দেশ আর একটা দেশকে লক্ষ্য করে মিসাইল ছোড়েনি। তবু বিশ্ব পঙ্গু হয়ে রয়েছে।
প্র: ক্রিকেট বন্ধ। সব খেলাই বন্ধ। অতীতের কোনও অধ্যায়ের কথা কি মনে করা যায়, যখন এ রকম অবস্থা তৈরি হয়েছিল?
শাস্ত্রী: আমি আগেই বললাম, আমাদের জন্ম হওয়ার পর থেকে দেখিনি। তবে যুদ্ধের সাইরেন না-বেজেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা চলে আসছে। যখন পাঁচ-ছয় বছর ধরে ক্রিকেট বন্ধ ছিল। প্রার্থনা করব, করোনার জন্য অত দিন ধরে স্তব্ধ হয়ে যাবে না সব কিছু। আশা করব, খুব বেশি হলেও ছ’মাসের মধ্যে সব খেলার খেলোয়াড়দেরই আবার মাঠে ছুটতে দেখা যাবে। মানুষ আবার খেলা দেখে আনন্দ পাবে। তবু বলব, এই মুহূর্তে কোনও কিছুই নির্দিষ্ট নয়। কোনও কিছুই ঠিক নেই। সকলের এখন সতর্ক থাকার সময়। খেলার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে।
আরও পড়ুন: ‘শেষ বলে দরকার চার রান, কী বল করবে?’ জবাবে ওয়ার্নারকে ‘বোল্ড’ করলেন ভুবি
প্র: খেলোয়াড়েরা অনেক বেশি অপরিচিত জনতার সংস্পর্শে আসেন। নানা দেশে গিয়ে তাঁদের নতুন বন্ধু হয়। অনেক জায়গায় দেখেছি, প্রবাসী ভারতীয়রা আসছেন আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে, আপনাদের নামে হোটেলে জয়ধ্বনিও দিচ্ছেন। হাত মেলাচ্ছেন, ছবি তুলছেন। এ সব থেকে দূরে থাকা কতটা কঠিন হবে?
শাস্ত্রী: পরিবর্তনটা শুধু আমাদের নয়, সকলের ক্ষেত্রেই হবে। যে জিনিসগুলো আগে কেউ কখনও ভাবেনি, এখন ভাববে। যে ভয়গুলো আগে আমরা পাইনি, সেগুলো এখন পাব। সকলেই পাব। আমি বা ক্রিকেটারেরা, খেলোয়াড়েরা শুধু নয়। প্রত্যেককে আবার জীবনের ভঙ্গিটা রি-সেট করতে হবে। এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস প্রত্যেকের জীবন ব্রেক কষে থামিয়ে দিয়েছে। কেউ তার থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। যখন আবার গাড়ি চলতে শুরু করবে, সবাইকেই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। মাঝেমধ্যে একটু মন্থর ভাবে, বুঝেশুনে এগোনোটাই ঠিক। টেস্ট ম্যাচের ব্যাটিংয়ের মতো। সময়টা এখন সে রকমই। আমি সব সময়ই ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করি। তাই আমার মত হচ্ছে, এই অধ্যায়টাও সকলকে ভাল কিছু শিক্ষা দিয়ে যাবে।
প্র: খেলায় কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। এই যেমন বলা হচ্ছে, থুতু লাগিয়ে বল পালিশ করার এতকালের রীতিটাই হয়তো উঠে যাবে সংক্রমণের ভয়ে। আইসিসি আবার বলছে, বল পালিশের জন্য ভেজলিন বা জেলি জাতীয় পদার্থের ব্যবহার আইনসিদ্ধ করা হতে পারে। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?
শাস্ত্রী: ক্রিকেট এখন আমার চিন্তাভাবনার তালিকায় একেবারে শেষের দিকে রয়েছে। বল, থুতু, স্টাম্প, ব্যাটের বাইরের দিকের কাণা, ভিতরের দিকের কাণা, লেগ বিফোর উইকেট, সব একেবারে পিছনের সারিতে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে জীবন বাঁচানোটাই সকলের এক নম্বর চিন্তা। আমার মনে হয় না, আগামী তিন মাস কোনও ক্রিকেট খেলা হবে বলে। এখন থেকে এক মাস বা দেড় মাস পরে গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার লক্ষণ দেখালে না হয় আমরা ব্যাট-বল-প্যাড-গ্লাভস নিয়ে ভাবতে শুরু করতে পারি।
প্র: টিমের ছেলেদের সঙ্গে তো কথা হচ্ছে নিশ্চয়ই?
শাস্ত্রী: হ্যাঁ, আমরা মাঝেমধ্যে কথা বলছি। সহকারী কোচেদের সঙ্গে কথা হচ্ছে, ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে ওই যে বললাম, এখনই কিছু হওয়ারও তো নেই। এক্ষুনি আমরা মাঠে ফিরছি না, বোঝাই যাচ্ছে। গোটা পৃথিবীতে আগামী দু’তিন মাস সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে চলবে কি না, ঠিক নেই। তা হলে ক্রিকেট বা খেলা নিয়ে কী করে আগাম কিছু ধরে নেবেন? ঘরে বসে জল্পনা-কল্পনা করে তো লাভ নেই।
প্র: সচিন তেন্ডুলকর বলেছেন, পাকিস্তানে অভিষেক সফরে আপনার পরামর্শেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিসদের গতির সামনে তিনি যখন দিশেহারা, আপনি সচিনকে বুঝিয়েছিলেন, ক্রিজে ধৈর্য নিয়ে সময় কাটাও। স্কুল জীবনের ম্যাচ ভেবো না এটাকে।
শাস্ত্রী: (থামিয়ে দিয়ে) ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, সেই সময়ে সচিন একটা বাচ্চা ছেলে ছিল। মাত্র ষোলো বছর বয়স ওর। ওই বয়সে কেউ যে পাকিস্তানে গিয়ে টেস্ট অভিষেক ঘটাচ্ছে, সেটাই বিরাট একটা প্রাপ্তি ছিল। ওই বয়সে অনেকে তো খেলার মাঠের আশেপাশেই পৌঁছয় না। দেশের হয়ে টেস্ট ম্যাচ খেলা এবং সেটাও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে— এটা তো অনেক দূরের কল্পনা। অত অল্প বয়স বলেই হয়তো কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু দ্রুতই নিজের জাত চিনিয়েছিল। পরের ইনিংসেই প্রমাণ করে দিয়েছিল, ক্রিকেট বিশ্ব নতুন এক তারকাকে পেতে চলেছে।
প্র: সমস্যাটা কী হয়েছিল সচিনের এবং কী ভাবে সেটা দূর করলেন?
শাস্ত্রী: কিছুই না। অত অল্প বয়সে ওয়াসিম-ওয়াকারদের মতো বোলারের সামনে পড়াটাও চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না। কিছুটা হয়তো বেমানান লাগছিল ওর নিজেকে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে কী ভাবে মানিয়ে নেব, সেটাই শুধু ওকে বুঝতে হত। এবং, সচিন খুব দ্রুত শিখে নিতে পেরেছিল। বরাবরই দ্রুত শিখে নেওয়াটা ছিল ওর বড় গুণ। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, প্রতিপক্ষকে সম্মান করা। এর পরে আর কাউকে কিছু বলতে হয়নি। সারা বিশ্ব চব্বিশ বছর ধরে শুধু দু’চোখ ভরে দেখে গিয়েছে এক অসামান্য প্রতিভার ব্যাট হাতে বিচ্ছুরণ।
প্র: যখন দেখলেন ইমরান-ওয়াকার-ওয়াসিমদের সামনে সচিন সমস্যায় পড়ছেন, কী মনে হয়েছিল আপনার? এই ছেলে পারবে?
শাস্ত্রী: ধুর, ধুর, কোনও সন্দেহই ছিল না। সচিনের প্রতিভা সম্পর্কে আমার মনে কখনও কোনও সন্দেহই ছিল না। এক বার দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারত, অসাধারণ এক প্রতিভাকে ব্যাট করতে দেখছি। পরীক্ষাটা ছিল দ্রুত আন্তর্জাতিক পরিবেশ, পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার। যেটা প্রথম সফরেই দ্রুত করে ফেলতে পেরেছিল ও। তার পরে আর পিছন ফিরে দেখতে হয়নি। ওই সফরেই সকলে বুঝে যায়, বিশ্বকে শাসন করতে চলে এসেছে বিস্ময় বালক। আসছে এক নতুন কিংবদন্তি! (চলবে)
আরও পড়ুন: ‘আমার ছেলের কেরিয়ার তো প্রায় শেষ করে দিলে’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy