ভারতীয় ক্রিকেটে ফিরছে এই জুটি। কোচ রবি শাস্ত্রী ও অধিনায়ক বিরাট কোহালি।
খাপ একটাই। অথচ, তলোয়ার দুটো!
তাতে যা হওয়ার সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট। আর গোটাটা সামলাতে মঞ্চস্থ করতে হয়েছে একের পর এক ‘নাটক’। শেষে রবি শাস্ত্রীকে এনে আপাতত সামাল দেওয়া গিয়েছে ‘যুদ্ধ’ পরিস্থিতি।
এটাই যে প্রথম, তেমনটা নয়। কোচ এবং অধিনায়ক যদি একে অপরের বিরুদ্ধে এবং ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা হন, তা হলে কী হতে পারে? অতীত তার সাক্ষী। আবার বিরাট কোহালি এবং অনিল কুম্বলের সম্পর্কের মতো সাম্প্রতিক উদাহরণও রয়েছে। কোন পথে এগিয়েছিল সেই সম্পর্ক? কবে থেকে সূত্রপাত বিরোধের? তিক্ততার রেশ শেষমেশ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিল? কী ভাবেই বা দলের সেই ‘খারাপ সময়’ কাটানোর চেষ্টা হল? ঝালিয়ে নেওয়া যাক সাম্প্রতিক সেই অতীত।
আরও খবর: হেড কোচ শাস্ত্রী, বোলিং কোচ জাহির, বিশেষ দায়িত্বে আনা হল দ্রাবিড়কে
ঘটনার শুরু মাস ছয়েক আগে। তখনও সেই ভাবে অনিল কুম্বলের সঙ্গে বিরাট কোহালির মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু, মে মাসে আর আটকানো যায়নি। ভারতে তখন সিরিজ খেলতে এসেছে অস্ট্রেলিয়া। দিনটা ৩০ মে। রাঁচী টেস্টের ঠিক আগেই কোচ-অধিনায়কের মতানৈক্য সামনে চলে আসে। দু’জনের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা জেনে যায় দলের বাকিরাও। বিষয়টা প্রকাশ্যে আসতেই বোঝা যায়, দল চালাতে বিরাটের মতকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছেন কুম্বলে। দু’জনের মধ্যে ঐকমত্য নেই মোটেও। আসলে রাঁচীর ওই ম্যাচে কুলদীপ যাদবকে খেলাতে চেয়েছিলেন কোচ কুম্বলে। অধিনায়ক বিরাট সেটা চাননি। শেষ পর্যন্ত ওই টেস্টে আর খেলাই হয়নি কুলদীপের। বোঝাই গিয়েছিল, কোহালিকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন কুম্বলে।
তার ঠিক আগেই নতুন কোচের জন্য আবেদনপত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে বিসিসিআই। সেটাও মেনে নিতে পারছিলেন না কুম্বলে। কিন্তু, তিনি কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
এর পরেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে চাওয়া নিয়েও সমস্যায় পড়ে দল। বিসিসিআই নানা বাহানায় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দল পাঠাতে চায়নি। কিন্তু, পরে ‘কমিটি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস’ (সিওএ)-এর হস্তক্ষেপে তড়িঘড়ি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দল পাঠায় বিসিসিআই। তখনও কোচ কুম্বলে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্তই চুক্তি ছিল তাঁর। ওই আসরেই ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুন দাবানলের আকার নেয়!
সেই সময় ইংল্যান্ডের মাটিতে বিরাট এবং কুম্বলেকে কথা বলতে দেখা যায়নি কখনও। এমনকী, কোহালিকে কুম্বলের বদলে ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গারের সঙ্গে আলোচনা করতে দেখা যায়। যেখানে সব দলের কোচ ও অধিনায়ক এক সঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলন করছেন, সেখানে ভারতীয় শিবিরের ছবিটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কুম্বলেকে এক দিনও দেখা যায়নি সংবাদমাধ্যমের সামনে আসতে। এ সবের ফল ফর্মের তুঙ্গে থাকা, গত বারের চ্যাম্পিয়নকেও হারতে হয় শ্রীলঙ্কার মতো দুর্বল দলের কাছে। ফাইনালে মুখ থুবড়ে পড়তে হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। কোথাও দাঁড়াতেই পারেনি ভারতীয় ক্রিকেট দল।
ড্রেসিংরুমের পরিবেশ যে বদলে গিয়েছে, সেটা ফের সামনে চলে আসে ওই সময়ে। তখন থেকেই কানাঘুষো শোনা যেতে থাকে, দলের অধিকাংশ ক্রিকেটারের সঙ্গেই কুম্বলের সম্পর্ক ভাল নয়। সেই সময় বিভিন্ন কারণে ক্রিকেট উপদেষ্টা কমিটির সদস্যেরা ইংল্যান্ডে ছিলেন। তাঁদের হাতেই ভারতীয় ক্রিকেট দলের কোচ বাছার দায়িত্ব। ওই সদস্যেরা যদিও চেয়েছিলেন, কুম্বলেকে রেখে দিতে। অন্য দিকে, দল তত দিনে পুরোপুরি কুম্বলের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। ১৮ জুন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে হারের পর ড্রেসিংরুমের গুমোট ভাবটা যেন আরও বেড়ে যায়। গোটাটার পিছনে নাকি ছিল বিরাটের বড় ভূমিকা!
অতীতে ভারতীয় দলের সঙ্গে রবি শাস্ত্রী। আবার তাঁকে দেখা যাবে এই ভূমিকায়।
শেষ পর্যন্ত কুম্বলে বনাম কোহালি যুদ্ধের ইতি হয় গত ২০ জুন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হেরে ওই দিন ইংল্যান্ড থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের জন্য পুরো দল উড়ে গেলেও কুম্বলে যাননি। পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় বিসিসিআই-এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, আইসিসির মিটিং সেরেই কুম্বলে যোগ দেবেন দলের সঙ্গে। কিন্তু, সবাইকে ‘ভুল’ প্রমাণ করে সে দিন বিকেলে নিজের ইস্তফাপত্র বিসিসিআইতে পাঠিয়ে দেন কোচ অনিল কুম্বলে। এর পরেই কোচের আবেদনপত্রের জন্য সময়সীমা ৩১ মে থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয় বিসিসিআই। ইতিমধ্যেই বিরাট কোহালির কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত রবি শাস্ত্রীর নাম উঠে আসতে শুরু করে দলের নয়া কোচ হিসাবে। শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রী আবেদনপত্র জমা দেন ৩ জুলাই। বোঝা গিয়েছিল, তিনিই ফিরছেন ভারতীয় কোচের পদে। কারণ বিরাট কোহালি যে তাঁকেই চান।
১০ জুলাই ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১০ জনের মধ্যে থেকে ছ’জনকে আগের দিনই বেছে নেয় বোর্ড। সে দিন সেই ছ’জনের মধ্যে পাঁচ জনই ক্রিকেট উপদেষ্টা কমিটির কাছে ইন্টারভিউ দেন। তালিকায় ছিলেন, রবি শাস্ত্রী, বীরেন্দ্র সহবাগ, লালচাঁদ রাজপুত, টম মুডি এবং রিচার্ড পাইবাস। ইন্টারভিউ শেষে কোচের নাম ঘোষণা করার কথা থাকলেও সাংবাদিক সম্মেলনে কমিটির অন্যতম সদস্য সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, তাঁরা আর একটু সময় নিতে চান। আসলে বিরাটের সঙ্গে কথা বলে নিতে চেয়েছিল কমিটি।
কিন্তু, আরও এক প্রস্থ নাটক অপেক্ষা করছিল ভারতীয় ক্রিকেটে কোচ বাছাইয়ের ইতিহাসে। রাত পোহাতেই অন্য প্রশ্নের মুখে পড়ে বিসিসিআই। সিওএ নির্দেশ দেয়, ১১ জুলাইয়ের মধ্যেই কোচের নাম ঘোষণা করতে হবে। তাড়াহুড়োয় পড়ে যায় বোর্ড। ওই দিন বিকেলের দিকে হঠাত্ রটে যায়, রবি শাস্ত্রীর নাম কোচ হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা, খবরের নামী ওয়েবসাইগুলো জানাতে থাকে রবির নামেই সিলমোহর পড়েছে। ফের নাটক। কারণ ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সাংবাদিক সম্মেলন করে বিসিসিআই-এর তরফে কার্যকরী সচিব অমিতাভ চৌধুরী জানিয়ে দেন, ভুল খবর। এখনও তাঁরা কোনও কোচের নাম ঘোষণা করেননি। সিদ্ধান্ত হলেই জানিয়ে দেওয়া হবে। ফের জল্পনা শুরু। তবে কি টম মুডির দিকেই ঝুঁকছেন নির্বাচকেরা? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও মুম্বই থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে রাতে জানান, সিদ্ধান্ত হয়নি। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বোর্ড সভাপতি সিকে খন্না জানিয়ে দিলেন, ২০১৯-এর বিশ্বকাপ পর্যন্ত ভারতীয় দলের কোচ হলেন রবি শাস্ত্রী। এর পরেই সব নাটকের অবসান।
তরবারি এবং খাপের এই নাটকে আপাতত যবনিকা পড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কত দিন পর রঙ্গমঞ্চের পরদা ফের উঠবে? এই প্রশ্নেই সরগরম ক্রিকেট মহল। কারণ, ধারে-ভারে রবি-বিরাটের ধারেকাছে আপাতত কেউ নেই। আর দুই তলোয়ার যে এক খাপে থাকতে পারে না, সেটাও তো অজানা নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy