Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

অমলদার আগে ওভারল্যাপ শিখিয়েছে ওঁর সেই প্রোজেক্টর

অমল দত্ত মারা যাওয়ার পরের সকালে যে ক’টা খবরের কাগজ পড়লাম, সবেতেই দু’টো প্রসঙ্গ দেখলাম আছেই। প্রদীপদা-অমলদার কোচিং লড়াই আর আমাকে অমলদার সেই সাতচল্লিশ বছর আগে এ দেশের ফুটবলে প্রথম ওভারল্যাপিং রাইট ব্যাক খেলানো।

ভবানী রায়
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩৪
Share: Save:

অমল দত্ত মারা যাওয়ার পরের সকালে যে ক’টা খবরের কাগজ পড়লাম, সবেতেই দু’টো প্রসঙ্গ দেখলাম আছেই। প্রদীপদা-অমলদার কোচিং লড়াই আর আমাকে অমলদার সেই সাতচল্লিশ বছর আগে এ দেশের ফুটবলে প্রথম ওভারল্যাপিং রাইট ব্যাক খেলানো।

যা দেখে আমার এই সত্তর-একাত্তর বছর বয়সেও মনের ভেতর একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সেই উনিশশো উনসত্তরের মোহনবাগান প্র্যাকটিস, মাঠে-ড্রেসিংরুমে কোচ অমলদার সঙ্গে আমার কথাবার্তা, সে বারের লিগ-শিল্ডে আমার কিছু কিছু মুভ— সব কেমন যেন অনেক পুরনো সিনেমার মতো চোখের সামনে খাপছাড়া ভাবে ভেসে আসছে।

আর একটা ব্যাপার বারবার মনে হচ্ছে। যেটা বোধহয় অমলদার আমাকে ওভারল্যাপিং সাইড ব্যাক খেলানোর মতোই অভিনব। মনে হচ্ছে, অমলদার প্রোজেক্টর ঘাড়ে নিয়ে গ্রাম-গঞ্জের মানুষকে পেলে-গ্যারিঞ্চা-পুসকাসের খেলার ফিল্ম দেখিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলের প্রথম স্বাদ দেওয়ার একমাত্র ফসলও হয়তো আমি-ই!

কাহিনিটা হল, ছেষট্টিতে আমার ইস্টার্ন রেল দলের গোলকিপার নারায়ণ মণ্ডল দক্ষিণেশ্বরে আমাদের পৈত্রিক বাড়ির কাছেই থাকত। তো একদিন ও আমাকে খবর দিল, অমল দত্ত পাড়ায় আসছেন তাঁর সেই প্রোজেক্টর নিয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখাতে। সে দিন উনি দেখিয়েছিলেন স্ট্যানলি ম্যাথেউজের ফেয়ারওয়েল ম্যাচের ফিল্ম। ম্যাথেউজ ইলেভেন ভার্সাস ওয়ার্ল্ড ইলেভেন। আর তাঁর সেই নিজস্ব কমেন্ট্রিতে অমলদা বারবার বুঝিয়েছিলেন, কী ভাবে বিশ্ব একাদশের আইরিশ সাইড ব্যাক সুযোগ পেলেই ওভারল্যাপে আক্রমণ করছে, আবার পরক্ষণে নীচে নেমে সঠিক পজিশন নিচ্ছে। বলেছিলেন, ‘‘এ জিনিস কেউ আগে দেখেনি এ দেশে।’’ ব্যাপারটা আমার মনে সেই সময় ভীষণ ছাপ ফেলেছিল। বলা যায়, উনসত্তরের তিন বছর আগেই অমলদা আমাকে ওভারল্যাপিং রাইট ব্যাক খেলতে শিখিয়েছিলেন!

আমি মোহনবাগানে সই করি সাতষট্টিতে। আর অমলদা আমাদের ক্লাবে কোচ হয়ে আসেন তার দু’বছর পর। এর ভেতর আটষট্টিতে মোহনবাগান যখন শ্রীলঙ্কা ট্যুরে গেল সেই সময় আমাদের টিমের নঈমদা, আলতাফরা ভারতের হয়ে খেলছে। ডিফেন্ডারের অভাব মোহনবাগানে। আমাকে ক্লাব কিন্তু সই করিয়েছিল হাফব্যাক হিসেবে। তার আগের কয়েক বছর ইস্টার্ন রেলের হাফে কালন গুহের সঙ্গে আমার খেলা দেখে। শ্রীলঙ্কা সফরের ম্যানেজার করুণা ভট্টাচার্য আমাকেই বললেন, ‘‘তুই এখানে সাইড ব্যাক খেলে দে।’’

সেই মোহনবাগানে আমার রাইট ব্যাক হয়ে ওঠা। আসলে আমার ফুটবলে দু’টো জিনিস বরাবর ছিল। স্পিড আর যে কোনও পজিশনে খেলে দেওয়ার স্বাচ্ছন্দ্য। এখনও মনে আছে, সাতষট্টিতে চুনীদার পাশে একটা লিগ ম্যাচে ইনসাইড ফরোয়ার্ড খেলেছিলাম। সুশীল সিংহের পাশে স্টপারেও খেলেছি। অমলদার জহুরির চোখ নিশ্চয়ই সেটা বুঝেছিল। উনসত্তরে মরসুমের আগাগোড়া পুরো স্বাধীনতা দিয়েছিলেন আমাকে ওভারল্যাপ করার। কেবল বলতেন, ‘‘শুধু একটা কথা মাথায় রেখো। তুমি যখন উঠে যাচ্ছ, তোমার রাইট ব্যাকের জায়গা নিচ্ছে রাইট স্টপার। তাই তুমি যখনই নীচে নামবে সব সময় কাট করে ভেতর ঢুকে রাইট স্টপারের জায়গায় আসবে।’’

ওভারল্যাপের সময় আর একটা দারুণ বোঝাপড়া ছিল আমার আর লেফট আউট প্রণব গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে। উনসত্তরের শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে ৩-১ হারানোর দিন গাঙ্গুলির দু’টো গোলের একটা ঠিক ওই বোঝাপড়ার রেজাল্ট। আমি ওভারল্যাপে যেতেই ও কাট করে ভেতরে ঢুকে এসেছিল। আমার পঁচিশ-তিরিশ গজের থ্রু পাস পৌঁছে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল গোলের সামনে ঠিক ওর পায়ে। সে বছরই মারডেকায় যখন যাই, ভারতীয় দলের কোচ জার্নাল সিংহ-ও আমাকে ওভারল্যাপ করার পুরো স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।

সত্যি বলতে সাই়ড ব্যাক, হাফ, স্টপার, ইনসাইড ফরোয়ার্ড— যে কোনও পজিশনে আমাকে খেলতে তৈরি করার পিছনে বাঘা সোম। ইস্টার্ন রেলে থাকার সময়। তবে সে রকম ফুটবলার তো এ দেশে আমার আগে বা পরে কতজনই আছে! কিন্তু ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে আমার আগে যা কাউকে খেলতে দেখা যায়নি সেই ওভারল্যাপিং রাইট ব্যাক আমাকে খেলিয়ে ইতিহাসে ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছেন অমল দত্ত-ই।

ধন্যবাদ অমলদা।

অন্য বিষয়গুলি:

Bhabani Roy Amal Dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE