বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দলের তারকা জাহানারা আলম। বল হাতে গতির ঝড় তোলেন তিনি। —নিজস্ব চিত্র।
এক সময়ে তিনি ক্রিকেট খেলাটাই বুঝতেন না। খুলনার স্কুলে ভলিবল আর হ্যান্ডবল খেলতেন। সেই মেয়ে এখন বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দলের বড় তারকা। পেস বোলিং তো বটেই, কঠিন পরিস্থিতিতে স্নায়ু শান্ত রেখে ম্যাচ জেতাতেও দক্ষ তিনি। এ হেন জাহানারা আলম ঢাকা থেকে সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজার ডিজিটালকে।
আপনার নাম আর বাংলাদেশের প্রাক্তন ক্রিকেটার হাসিবুল হোসেন শান্তর নাম এক বন্ধনীতে। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির ফাইনালে জেতার জন্য ১ বলে ১ রান দরকার ছিল বাংলাদেশের। শান্ত জিতিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপ ফাইনালে প্রায় একই চিত্রনাট্য। ভারতের বিরুদ্ধে শেষ বলে জেতার জন্য দরকার ছিল দু’রান। এই অবস্থায় স্নায়ু ঠিক রেখে দেশকে জেতালেন কী ভাবে?
কঠিন পরিস্থিতিতে অনেকেই ঘাবড়ে যায়। আমি সহজে ভেঙে পড়ি না। দারুণ কঠিন পরিস্থিতিতে আমার নার্ভ শান্তই থাকে। বাংলাদেশের বহু কঠিন ম্যাচে এবং কঠিন পরিস্থিতিতে আমিই এগিয়ে গিয়েছি। বোলিংয়ের সময়েও কঠিন পরিস্থিতিতে আমাকে বল করতে হয়েছে। ফিল্ডিংয়ের সময়ে মিড উইকেট, লং অন— এ সব জায়গায় আমাকে ফিল্ডিংয়ের জন্য দাঁড় করানো হয়। ওই সব অঞ্চলে অনেক ক্যাচ আসে। এশিয়া কাপের সময়ে আমাদের কোচ ছিলেন দেবিকা পালশিকার আর অঞ্জু জৈন। কঠিন পরিস্থিতিতে ওঁরা আমাকে নামতে বলেন। সে দিনের ওই ম্যাচে খুব কঠিন পরিস্থিতিতেও আমি পজিটিভ ছিলাম। আমার মাথায় ছিল, কিছু একটা করতে হবেই। দেবিকা-অঞ্জু ম্যাম আমাকে দৌড়ে রান নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। দুই উইকেটের মধ্যে আমি খুব দ্রুত দৌড়তে পারি। এমনকি মারার দরকার পড়লে আমাকে মারতে হবে, এটা ভেবেই আমাকে ব্যাট করতে পাঠানো হয়েছিল। ঠিক এক বলে দুই রান যখন দরকার, তখন কোচের নির্দেশ নিয়ে দ্বাদশ ব্যক্তি এসে আমাকে বলল, ব্যাটে বল লাগাতেই হবে। ক্যাপ্টেনকে (সালমা খাতুন) বললাম, ব্যাটে বলে ঠিকই ইমপ্যাক্ট হবে। আপনি দুই রানের জন্য দৌ়ড়বেন। সেই মুহূর্তে আমি একটুও ভয় পাইনি। অনেক রকমের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমি মনে মনে স্থির করে ফেলেছিলাম, ডাইভ দিয়ে আমাকে ক্রিজে ঢুকতে হবে। কারণ আমি দুই রানের জন্য দৌড়বো। সেই মতোই হরমনপ্রীতের বলটা মিড অনে মেরে মরিয়া হয়ে দৌড়ই।
২০১৮ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতকে হারানোর পরে একটা স্কুটি উপহার পেয়েছিলেন। সেই স্কুটিটা মাত্র এক দিন চালালেন। এখন কোথায় সেই স্কুটিটা? মাত্র এক দিন চালিয়েই বন্ধ করে দিলেন কেন?
(হাসি) আমি এক দিনও চালাইনি। এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে সেই উত্তেজক ম্যাচে বাংলাদেশকে জেতানোর পরে স্কুটিটা উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম। আমি ঢাকায় থাকি। ঢাকায় চলাফেরার সুবিধার জন্য স্কুটি হলে ভাল হয়। সেই কারণেই আমাকে উপহার হিসেবে স্কুটিটা দেওয়া হয়েছিল। এশিয়া কাপের পরেই ওয়ার্ল্ড কাপ ছিল। আমি নিজের ক্রিকেট নিয়ে একটু বেশি মাত্রাতেই সচেতন। আমি চাইনি স্কুটি চালাতে গিয়ে চোটের কবলে পড়ি। সেই কারণেই আর ঝুঁকি নিইনি। ভেবেছিলাম বিশ্বকাপের পরে স্কুটি চালানো শিখে নেব। মোটরসাইকেল রাইড আমার খুবই পছন্দের। এক বার স্কুটি চালানো প্র্যাকটিস করতে গিয়ে পড়েই গেলাম। আঙুলে চোট লেগেছিল। সেই ঘটনার পরে আমি আর স্কুটি চালানো শিখিনি। স্কুটিটা বাড়িতেই রয়েছে।
আরও পড়ুন: বিজয়, বিশাল, জোরাবর... ভারতীয় ক্রিকেটের সুপারস্টারদের এই অচেনা ভাইদের চেনেন?
কুয়ালা লামপুরে ভারতকে হারানোর পরেই মহিলাদের আইপিএল-এ একমাত্র বাংলাদেশের ক্রিকেটার হিসেবে ডাক পেলেন। এশিয়া কাপের পারফরম্যান্সের জন্যই কি আপনাকে ডাকা হল?
কেন ডাক পেয়েছিলাম, সেটা তো আইপিএল কমিটি ভাল বলতে পারবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সেরা ক্রিকেটারদের নিয়ে কী ভাবে ভাল দল করা সম্ভব, সেটাই হয়তো আইপিএল কমিটির মাথায় কাজ করছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে আমাকে প্রথম খবরটা দেওয়া হয়েছিল। সে বারের আইপিএল ছিল তিন দলের। চেয়েছিলাম দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে। ছেলেদের আইপিএলের মাঝেই হয়েছিল মহিলাদের আইপিএল। আমি জানতাম সবার দৃষ্টি থাকবে আমার দিকে। সেই কারণে নিজেকে তুলে ধরা চেষ্টা করেছিলাম। আইপিএলের পরে দেখলাম আমার খেলায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। ফলও পেয়েছি। ইন্ডিয়া এ টিমের বিরুদ্ধে ভাল খেলেছি। প্লেয়ার অফ দ্য ফাইনালও হয়েছিলাম। পাকিস্তান সিরিজটাও আমার ভালই গিয়েছে। সাউথ এশিয়ান গেমসে সোনা জিতেছিলাম। ফাইনাল ম্যাচে শ্রীলঙ্কা এ টিমের বিরুদ্ধে ম্যাচটা বেশ কঠিনই ছিল। শেষ ওভারটা কঠিন পরিস্থিতিতে বল করেছি। ধারাবাহিক ভাবে ভাল পারফরম্যান্স করে যেতে চাই। ক্রমতালিকায় নিজেকে উপরের দিকে নিয়ে যেতে চাই। আমি বিগ ব্যাশে খেলার স্বপ্ন দেখতাম। আশা রাখি এক দিন সেখানেও খেলব।
মাশরাফিকে আদর্শ করে এগিয়ে চলছেন জাহানারা।
আইপিএলে আপনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করে নিলেন। সেরা বলটাও বেরিয়েছে আপনার হাত থেকে। ওই দুটো ডেলিভারির কথা বলুন।
আমি প্রথম চেঞ্জে বল করতে এসেছিলাম। তখন বলের পালিশ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি যে প্রান্ত থেকে বল করছিলাম, সে দিক থেকে ইনসুইং ভাল হচ্ছিল। প্রথম বলটা করার পরেই বুঝতে পারি রিভার্স সুইং হচ্ছে। আমি নতুন বলে যেমন স্বাভাবিক আউট সুইং পাই, তেমনই পুরনো বলে রিভার্স সুইংও করাতে পারি। আমি খুবই কম রান দিয়েছিলাম। রিভার্স সুইং দারুণ কাজে দিয়েছিল। নাতালি স্কিভার ও সোফি ডিভাইনকে বোল্ড করলাম। সোফিকে যে বলটায় বোল্ড করলাম, সেটাই ছিল টুর্নামেন্টের সেরা বল।
এ বারের ছেলেদের আইপিএল দেখবেন নিশ্চয়? কোন দল আপনার প্রিয়? আপনার দেশ থেকে এ বার কোনও প্রতিনিধি কিন্তু নেই আইপিএলে।
বাংলাদেশে আইপিএল খুবই জনপ্রিয়। কেকেআর আমার পছন্দের টিম। শাকিব ভাই হায়দরাবাদে খেলার সময়ে আমি হায়দরাবাদকেও সাপোর্ট করেছি। এ বার বাংলাদেশ থেকে কেউ নেই আইপিএলে। আমি আমার পছন্দের দল কেকেআরকেই সাপোর্ট করবো। কেকেআরকে কেন এত ভাল লাগে, তা ব্যাখ্যা করতে পারব না। তবে আইপিএল-এর শুরু থেকেই কেকেআর-কে আমার ভাল লাগত। মনে হত এটা আমাদের নিজেদের টিম। খুব আপন মনে হত। তবে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ও বিরাট কোহালি আমার পছন্দের তালিকায় উপরের দিকে। ওদের খেলা আমি মন দিয়ে দেখি।
যদি সুযোগ হয়, তা হলে কোন পুরুষ ব্যাটসম্যানকে আউট করতে চান?
বিরাট কোহালিকে আউট করতে চাইব।
শাকিব, মাশরফিরা ইডেনে খেলছেন। আপনি ইডেনে খেলতে চান?
অবশ্যই। এখনও ইডেনে খেলার সৌভাগ্য হয়নি। আশা করি এক দিন ইডেনে খেলব, লর্ডসে খেলব। ক্রিকেটের সব লিজেন্ডরা ইডেন-লর্ডসে খেলেছেন। আমিও খেলতে চাই।
ভারতের বিরুদ্ধে খেলেছেন। ভারতকে এশিয়া কাপে হারিয়েওছেন। দুই দেশের মহিলা ক্রিকেটের পার্থক্যটা ঠিক কোন জায়গায়?
আমার মনে হয় অভিজ্ঞতায় অনেক পার্থক্য। ভারত প্রচুর ম্যাচ খেলে। ফলে ওদের অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে কত শ্রেণি বিন্যাস রয়েছে। সারা বছর ধরেই ওরা খেলার মধ্যে থাকে। এক জন বা দু’জন পরিবর্তন হলেও ওদের পাইপলাইনে অনেক প্লেয়ার রয়েছে। প্রত্যেকেরই অভিজ্ঞতা অনেক। মিতালি রাজের কথাই ধরুন। মিতালি ২০ বছর ধরে খেলছে। আমার বয়স এখন ২৭। তা হলেই বুঝে দেখুন, অভিজ্ঞতায় কে এগিয়ে। মিতালির আগের জেনারেশনও অনেক দিন ধরে খেলেছে। অনেক আগে থেকে খেলার ফলে ওরা অনেক অভিজ্ঞ। এখন স্মৃতি মন্ধানা, হরমনপ্রীতরা খেলছে। উঠে আসেছে শেফালি ভার্মার মতো প্লেয়ার। তুলনায় আমরা অনেক কম ম্যাচ খেলি। কোয়ালিটির দিক থেকে আমরা যে খুব পিছিয়ে রয়েছি, তা বলব না। তবে খেলতে হবে। খেললেই আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
নতুন বলে আউটসুইং করাতে দক্ষ জাহানারা।
টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে আপনাকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে। আপনার প্রশংসা সর্বত্র। এতে কি প্রেশার অনুভব করেন? না কি এটাই ক্রিকেট মাঠে আরও ভাল করার প্রেরণা দেয়?
অবশ্যই প্রেরণা জোগায়। সত্যি বলতে কী, টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইন্ডিয়া ম্যাচের পরে আমার কাজল পরা চোখ নিয়ে যে এত চর্চা হবে, তা বুঝতেই পারিনি। আমি কিন্তু ক্রিকেট খেলার (২০০৮) শুরু থেকেই কাজল পরি। কিন্তু আইসিসি বিশ্বকাপে খেলার সময়ে বেশি করে সবার নজরে পড়ি। ভাল তো অবশ্যই লেগেছে। তবে যেটা আরও ভাল লেগেছে, তা হল মহিলা ক্রিকেটের প্রতি সবার ফোকাস বেড়েছে। এটাই তো পজিটিভ দিক। তবে আমার পারফরম্যান্স নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন আরও বেশি ভাল লাগে।
আরও পড়ুন: ভিভোর পর আইপিএল থেকে সরে যাচ্ছে আরও কিছু চিনা স্পনসর?
আপনি নাটকে অভিনয় করেছেন। ভবিষ্যতে কি সিনেমায় দেখা যেতে পারে?
সে রকম ইচ্ছা নেই। ক্রিকেটকে আমি এতটাই ভালবাসি যে, ক্রিকেট ছেড়ে অন্য কোনও পেশার কথা ভাবতেই পারি না। অনেক অনুরোধ করায় নাটকটা করেছিলাম। বলতে পারেন স্বাদবদলের জন্যই নাটক করেছিলাম। তার পরে অনেকে নাটক করার প্রস্তাব দেন। দুটো সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তাবও এসেছিল। কিন্তু আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। অন্য কিছুতে আমি ফোকাস করতে চাই না। তা হলে ক্রিকেট থেকে ফোকাস নড়ে যাবে। আর সেটা আমি কোনও ভাবেই চাই না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy