Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
বাঙালির ব্যাঘ্রগর্জন ধর্মশালা থেকে পদ্মাপার

বালক-বীরের মহাকীর্তিতে বঙ্গ ক্রিকেটে বসন্ত পূর্ণিমা

মেহেদি হাসানের ছোড়া বলটি যেন আরেক ব্রহ্মাস্ত্র। স্টিভন ফিনের পায়ে তা লাগতেই আকাশ চিরে দেওয়া সমস্বর আবেদন। যে আবেদন কেবল মাঠের এগারো ক্রিকেটারের না, ষোলো কোটি ক্রিকেটপ্রাণেরও। আর তাতে সাড়া দিয়ে আম্পায়ারের আঙ্গুল উঠতেই আনন্দের বিস্ফোরণ।

ঐতিহাসিক জয়ের মুহূর্ত। (ডান দিকে) ইতিহাসের মেহদি।

ঐতিহাসিক জয়ের মুহূর্ত। (ডান দিকে) ইতিহাসের মেহদি।

নোমান মোহাম্মদ
মিরপুর শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:০৯
Share: Save:

মেহেদি হাসানের ছোড়া বলটি যেন আরেক ব্রহ্মাস্ত্র। স্টিভন ফিনের পায়ে তা লাগতেই আকাশ চিরে দেওয়া সমস্বর আবেদন। যে আবেদন কেবল মাঠের এগারো ক্রিকেটারের না, ষোলো কোটি ক্রিকেটপ্রাণেরও। আর তাতে সাড়া দিয়ে আম্পায়ারের আঙ্গুল উঠতেই আনন্দের বিস্ফোরণ। রোমাঞ্চের ঢেউ পেরিয়ে যে অপার সোনালি রোদ্দুরের পাড়ে ভেড়ে বাংলাদেশের জয়ের জাহাজ। তা-ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে! তা-ও টেস্টে!

রবিবার হেমন্তের বিকেলে হঠাৎ তাই বেজে ওঠে বসন্ত বাঁশি। যে বাঁশির সুরে মাতোয়ারা ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মানচিত্র। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয় যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের হিরন্ময় এক ছবি! অর্জনের এই ক্যানভাসের ফ্রেমটা স্মৃতির সেগুন কাঠে বাঁধাই করা থাকবে বহু দিন। বলা ভালো, চির দিন!

টেস্ট ক্রিকেটে এই প্রথম যে জিতল বাংলাদেশ, তা নয়। ২০০৫ সালে জিম্বাবোয়ের বিপক্ষে জয় আছে। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবা ২০১৪-তে আবার ওই জিম্বাবোয়ের বিপক্ষেও। ও সব জয়ে কৃতিত্ব আছে ঢের, বীরত্ব ততটা নয়। কারণ ধারে-ভারে জিম্বাবোয়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ইংরেজ ক্রিকেট সৈনিকরা। আর ক্যারিবিয়ান সফরে গিয়ে তো বাংলাদেশ জেতে দুর্বল দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষে! এ বার ইংল্যান্ডকে তা বলা যাবে না। টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে চার নম্বর তারা। মৌসুম জুড়ে তুখোড় ফর্মেও। তাদের বিপক্ষে জয় তাই অর্জনের অক্ষয় কালিতে লেখা হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

ইতিহাসের আর্তনাদ ছিল পেছনে। ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মুলতান, ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফাতুল্লাহ, ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রাম কিংবা এই গত সপ্তাহে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট— অন্ধকূপ থেকে চোখ রাঙাচ্ছিল ওই টেস্টগুলো। যেখানে জয়ের মরুদ্যান বিলীন হয়েছে হাহাকারের মরীচিকায়! এ বার কী তবে আবারও? কিন্তু মেহেদি হাসান মিরাজ নামের এক বালক-বীর তা আর হতে দিলেন না। তাঁর ১২ উইকেট শিকারের অর্জনে লেখা হল বাংলাদেশ ক্রিকেট-রূপকথার সবচেয়ে বড় অর্জনের গল্প।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রোদ্দুর জ্বালিয়ে আসা এক ক্রিকেটারের নাম মিরাজ। তাঁর স্বপ্নভেজা আবির্ভাবে চমকে গেছে ইংল্যান্ড। বিহ্বলতায় হতভম্ব! তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সদর-অন্দরে তিনি অচেনা কেউ নন। সর্বশেষ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। প্রতিযোগিতায় দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে না পারলেও নিজে হন ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট। যার আশ্চর্য ধারাবাহিকতা অব্যাহত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরুর দাগচিত্রেও। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ তো মিরাজ-ই! আর দুই টেস্টে ১৯ উইকেট নেওয়ায় ম্যান অব দ্য সিরিজেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

এই আশ্চর্য আগমনের চেয়ে তাঁর ক্রিকেটের সঙ্গে সখ্যতার গল্পও কম অবাক করা নয়! রূপসাপাড়ের ছেলে মিরাজের পরিবারে ক্রিকেটপ্রেমের জায়গা ছিল না। সংসারে যে লেগে থাকে নিত্য অনটন! বাবা গাড়ি চালিয়ে সংসার টানতেন। ক্রিকেট সেখানে বিলাসিতার নামান্তর। বাবাকে লুকিয়ে তাই ব্যাট-বলের সঙ্গে বন্ধুতা গড়ে তুলতে হয়। তবু কী আর সব সময় লুকোনো যায়! টের পেলেই বেদম পিটুনির শিকার। কিন্তু ক্রিকেটদেবতার আশীর্বাদ ছিল ছেলেটির উপর। এলাকার ‘মুসলিম অ্যাকাডেমি’র কোচের নজরে পড়ে যান। কোচ আল মাহমুদকে বাবার রূদ্রমূর্তির কথা বলতেই তিনি নিজে ব্যাট-বল-কেডস কিনে দেন মিরাজকে। ব্যস, শুরু হয়ে যায় ক্রিকেট নিয়ে তাঁর ঋষির সাধনা। অবশ্যই তখনও বাবাকে লুকিয়ে।

সেই বাবার অনুমোদন মেলে কী ভাবে? সে-ও আর এক গল্প। জেলা পর্যায়ে টুকটাক সাফল্য পান মিরাজ। সংবাদপত্রের এক কোণে আলগোছে পড়ে থাকে তাঁর নাম। আড়চোখে তা দেখে মন কিছুটা নরম হয় বাবার। আর ২০১০ সালে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড সিরিজের সময় ছেলেকে স্বপ্নের পিছনে ছোটার অনুমোদন দিয়ে দেন পুরোপুরি। সে বার অনূর্ধ্ব-১৪ লিগ পর্যায়ের সেরা ব্যাটসম্যান হন। ছয় বছর আগে এই শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ওয়ান ডে শুরুর আগে দেওয়া হয়েছিল যার পুরস্কার। বাংলাদেশের এই ক্রিকেটতীর্থে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন মিরাজ। সেখানে ক্রিকেটারদের কদর দেখে মনের বাঁকবদল বাবার। ছেলেকে আর আটকে রাখেননি। বলেছিলেন, ‘এখন থেকে তুই শুধু ক্রিকেট খেলবি। আর এক দিন অবশ্যই জাতীয় দলে খেলতে হবে।’

মিরাজের মনেও তখন স্বপ্নের প্রজাপতির ওড়াউড়ি। সেই প্রথম চর্মচক্ষে স্বপ্নের নায়কদের দেখা। মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবালদের খেলা দেখেন কোথা থেকে জানেন? প্রেসবক্স থেকে! ১৩ বছরের পুঁচকে শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সের কোন কোণে বসে সে দিন খেলাটি দেখেছিলেন, তা আজ আর মনে করতে পারছিলাম না। কিন্তু মিরাজ এ দিন মনে করিয়ে দিলেন ঠিকঠাক, ‘‘আমি প্রেসবক্সে বসে ২০১০ সালে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড খেলা দেখি। এক বার মাঠে তাকাই। এক বার প্রেসবক্সের টেলিভিশনে। সত্যি সত্যি আমার স্বপ্নের নায়কদের খেলা চোখের সামনে দেখছি, তা বিশ্বাস হচ্ছিল না।’’ সেই মিরাজের কীর্তিতে এ দিন অবিশ্বাস্য এক টেস্ট জিতল বাংলাদেশ। প্রেসবক্সের কোণায় অনধিকার প্রবেশের আড়ষ্টতা নিয়ে বসে থাকা ছেলেটিকে ছয় বছর পর স্টেডিয়ামের নীচের সংবাদ সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকরা বরণ করে নেন হাততালিতে। সঙ্গে তাঁর অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। এ কী স্বপ্ন, না কি মায়াবী বিভ্রম— মিরাজ চাইলে বোধহয় চিমটি কেটে দেখতে পারতেন!

বাংলাদেশ ক্রিকেটে সর্বশেষ এমন সোনার ছেলে মুস্তাফিজুর রহমান। যাঁর কাটারের প্রশংসায় বোদ্ধাদের ভাষার ভাঁড়ারঘরে পড়ে যায় শব্দের আকাল। মিরাজের এখন ঠিক সেই অবস্থা। জলতরঙ্গের নুপূর বাজিয়ে মুস্তাফিজের মতোই যে আবির্ভাব তাঁর! একটা জায়গায় অবশ্য ওই ‘কাটার মাস্টার’-এর চেয়েও এগিয়ে সদ্য উনিশ পেরোনো এই তরুণ। বাংলাদেশকে যে টেস্ট জিতিয়েছেন তিনি! তা-ও ইংল্যান্ডের মতো ক্রিকেট-পরাশক্তির বিপক্ষে। মিরাজের এমন কীর্তিতে তাই পঞ্জিকাকে এখন থোড়াই কেয়ার বাংলাদেশ ক্রিকেটের।

পঞ্জিকা বলছে যে, এখন বসন্তকাল না। আকাশের চাঁদও নেই পূর্ণিমা তিথিতে। উল্টে অমাবস্যা তিথি! তবু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন বসন্ত-পূর্ণিমা। যেখান থেকে প্রেরণার আলো বিচ্ছুরিত হবে বহু কাল। বলা ভালো, অনন্ত কাল!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ ২২০ ও ২৯৬ (ইমরুল ৭৮, রশিদ ৪-৫২)
ইংল্যান্ড ২৪৪ ও ১৬৪ (কুক ৫৯, মেহেদি ৬-৭৭, সাকিব ৪-৪৯)।
বাংলাদেশ ১০৮ রানে জয়ী।

(লেখক সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক কালের কন্ঠ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dhaka test Bangladesh vs England Test match
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy