Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

বল ‘বানাতে’ হবে, সঙ্গে রাখো স্কচব্রাইটও

স্টিভ স্মিথদের বল-বিকৃতি কাণ্ডের জেরে শিরোনামে রিভার্স সুইং। কিন্তু কী করে তা ক্রিকেটে এসেছিল? আবিষ্কর্তা কে? ক্যামেরা ঘিরে রাখা মাঠে কী ভাবে বল-বিকৃতি ঘটে? অনুসন্ধান করে যা পেল আনন্দবাজার:স্টিভ স্মিথদের বল-বিকৃতি কাণ্ডের জেরে শিরোনামে রিভার্স সুইং। কিন্তু কী করে তা ক্রিকেটে এসেছিল? আবিষ্কর্তা কে? ক্যামেরা ঘিরে রাখা মাঠে কী ভাবে বল-বিকৃতি ঘটে? অনুসন্ধান করে যা পেল আনন্দবাজার:

সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৮ ০৫:০১
Share: Save:

• ইমরানের হাতে ধ্বংস ভারত •

১৯৮২ সালের করাচি। ভারত বনাম পাকিস্তান টেস্ট। ভারত প্রথম ইনিংসে ১৬৯ অলআউটের পরে পাকিস্তান তুলল ৪৫২। ইনিংস পরাজয়ের আতঙ্কের মধ্যে পাল্টা লড়াই শুরু করেছেন সুনীল গাওস্কর এবং দিলীপ বেঙ্গসরকর। চা-পানের বিরতিতে ভারত ১০২-১। আর ঠিক তখনই দ্বিতীয় স্পেল করার জন্য ফিরে এলেন ইমরান খান। হাতে ৪০ ওভারের পুরনো বল। পরের ২৫ বলে ভারতের পাঁচ জন আউট। ভয়ঙ্কর ইনসুইং ব্যাট-প্যাডের মধ্য দিয়ে ভিতরে ঢুকে ভেঙে দিল গাওস্করের স্টাম্প। ভারতীয় ড্রেসিংরুমে কেউ ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না, ৪০ ওভারের পুরনো বলে এমন মারণ-সুইং কী ভাবে পাচ্ছেন ইমরান? ভারত অলআউট ১৯৭। ইমরান একাই দ্বিতীয় ইনিংসে নিলেন আট উইকেট।

• বল পাল্টে ফেলছে নাকি রে? •

করাচির সেই টেস্টে গাওস্করের সঙ্গে ওপেন করেছিলেন অরুণ লাল। মিশরে ঘুরতে যাওয়া অরুণ ফোনে বললেন, ‘‘কুলকিনারাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না যে, কোথা থেকে কী হচ্ছে। ৪০ ওভারের পুরনো বলে দেখছিলাম, নতুন বলের চেয়েও বিষাক্ত সুইং হচ্ছে। আমাদের মনে হয়েছিল, জলপানের বিরতিতে ওরা বোধ হয় বলটাকে পাল্টে ফেলছে! তখনও তো বারবার বল পরীক্ষা করার নিয়ম ছিল না।’’ করাচির সেই টেস্টে দায়িত্বে ছিলেন সব চেয়ে বিতর্কিত দুই পাক আম্পায়ার খিজার হায়াত এবং শকুর রানা। যাঁরা ‘দেশপ্রেমী’ হিসেবে নাম করেছিলেন ক্রিকেট দুনিয়ায়। মাঝপথে বল পাল্টে ফেললেও কি তাঁরা ধরবেন না? প্রশ্ন করায় অরুণ যোগ করলেন, ‘‘তখন বোঝা সম্ভব হয়নি, রিভার্স সুইং হচ্ছে। পরে জানতে পারি। একটাই ব্যাখ্যা মাথায় এসেছিল যে, নজর রাখতে হবে ওরা ড্রিঙ্কসের সময় বলটা পাল্টে ফেলছে না তো?’’

• আবিষ্কর্তা ইমরান নন, সরফরাজ •

রিভার্স সুইংয়ের জন্ম যে পাকিস্তানেই হয়েছিল, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যে কারণে অনেকেই বলে থাকেন ‘মেড ইন পাকিস্তান’। তবে ইমরান নন, রিভার্স সুইংয়ের আবিষ্কর্তা সরফরাজ নওয়াজ। ডব্লিউ জি গ্রেস যেমন ব্যাকফুট শট এনেছিলেন ক্রিকেটে, রঞ্জিতসিংহজি যেমন লেগ গ্লান্সের আবিষ্কর্তা, ভিক্টর ট্রাম্পার যেমন পুল-হুক শটের উদ্ভাবক, বার্নার্ড বোসানকোয়েট যেমন আবিষ্কার করেছিলেন গুগলি, তেমনই রিভার্স সুইংয়ের জনক সরফরাজ। যা তিনি ইমরানকে শেখান এবং ইমরান পরে শেখান ওয়াসিম আক্রম এবং ওয়াকার ইউনিস-কে। যাঁরা রিভার্স সুইংয়ের দুই সেরা ‘মাস্টার’ হয়ে উঠেছিলেন।

• কী ভাবে হয় রিভার্স সুইং •

রিভার্স সুইং করতে গেলে বলের এক দিকে পালিশ রাখতে হবে, অন্য দিকটা থাকবে শুকনো এবং খরখরে। একদিক ভারী (পালিশের দিকটা) থাকবে, অন্য দিকটা হাল্কা (খরখরে দিকটা)। প্রথাগত সুইংয়ে ডানহাতি বোলারের হাতের ডানদিকে পালিশ থাকলে ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে বল আউটসুইং করবে, অর্থাৎ বাইরের দিকে যাবে। বাঁ দিকে পালিশ মানে বল ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে ইনসুইং করবে, অর্থাৎ ভিতরের দিকে আসবে। কিন্তু রিভার্স সুইংয়ে উল্টোটা হবে। সেই কারণেই নামকরণ হয়েছে ‘রিভার্স’ (ছবিতে দেখুন)। ব্যাটসম্যান দেখছে ডানদিকে পালিশ, তাই আউটসুইং ভেবে খেলতে যাবে কিন্তু তাঁকে ধোঁকা খাইয়ে বল বাইরের গোঁত্তা খেয়ে ভিতরের দিকে আসবে। রিভার্স সুইং খুব দেরিতে, শরীরের কাছে এসে ভাঙে এবং দ্রুত গতির বোলার হলে সেটা সামলানো খুব কঠিন।

• বলটাকে ‘বানাতে’ হবে •

রিভার্স সুইংয়ের মতো এই শব্দটিরও জন্ম পাকিস্তানে— বল ‘বানানো’। কলকাতা নাইট রাইডার্সের বোলিং পরামর্শদাতা থাকার সময় ওয়াসিম আক্রমকে অনেক বার বলতে শোনা গিয়েছে। এই বল ‘বানানো’-র মধ্যেই লুকিয়ে আছে রিভার্স সুইংয়ের রহস্য। কারও কারও মতে, বল-বিকৃতি ছাড়া বল বানানো সম্ভব নয়। কিন্তু আক্রমের বক্তব্য, ‘‘এগুলো ইংরেজরা বলে। যখন আমরা পুরনো বলে সুইং করি, বল-বিকৃতি হয়। ওরা করলে রিভার্স সুইং।’’ ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে কাউন্টি খেলার সময় ইংল্যান্ডে অনেককে এই শিল্প শেখান আক্রম-ই।

• চকচকে রাখার রহস্য •

স্টিভ স্মিথ কাণ্ডের জেরে কয়েক জন ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বলে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য পাওয়া গেল। পালিশের দিকটা চকচকে রাখার জন্য জেলিবিন্স বা ক্যান্ডি মুখে রাখেন অনেকে। জলের বোতল নিয়ে কেউ ঢুকলে সেই বোতলের উপরের দিকটায় ক্রিম বা ভেসলিন লাগানো থাকতে পারে। জল খেতে আসা ফিল্ডার সেখানে হাত রাখলেই পেয়ে যাবেন ক্রিম। ট্রাউজার্সে, টি-শার্টের কলারে ক্রিম লাগিয়ে নামেন অনেকে, যাতে আম্পায়াররা ধরতে না পারেন।

আরও পড়ুন: আইসিসি দিয়েছে এক টেস্ট নির্বাসন, দেশ এক বছরের

• অন্য দিকটা নিয়েই যত বিতর্ক •

বল-বিকৃতির আসল খলনায়করা কারসাজি করেন খরখরে দিকটা নিয়ে। নখ চালিয়ে এবড়ো-খেবড়ো করার চেষ্টা হয়। অনেক দলে নির্দিষ্ট ক্রিকেটার আছেন, যাঁরা এই কাজটা করবেন। তাঁরা নখ শক্তিশালী করার দিকেও আলাদা ভাবে নজর দেন। যাতে আম্পায়ারের চোখ এড়িয়ে বল খোঁটাখুঁটি করা যায়। অনেক সময় পানীয় বোতলের ছিপি অনেক সময় ট্রাউজারের মধ্যে এমন ভাবে ঢুকিয়ে রাখা হয়, যাতে ছুঁচলো দিকটা উপরে থাকে। ট্রাউজারে বল ঘষলেই ছুঁচলো দিকটায় লেগে বল খড়খড়ে হতে থাকবে। থালা-বাসন পরিষ্কার করার স্কচব্রাইট বা স্টিলউলও খুব জনপ্রিয় ‘অস্ত্র’। সীমানার বাইরে যাওয়া বল কুড়িয়ে নেওয়ার আগে শক্ত কিছুতে ঘষে নেওয়াও হয়। অনেক ক্ষেত্রে বলের পিছনে ধাওয়া করা ফিল্ডার হাত দিয়ে বলবয়-কে ইশারা করেন যে, বলটা ধরবে না। শক্ত কিছুতে ধাক্কা খাওয়ার আগে বলবয় ধরে ফেললে বল বিকৃত হবে কী করে?

• ক্রিকেটের মতোই দলগত খেলা •

অস্ট্রেলিয়ার বল-বিকৃতি কাণ্ডে অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ ও সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ছাড় পেয়েছেন কোচ ডারেল লেম্যান। বল-বিকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালদের মতে, কোচকে অন্ধকারে রেখে কিছু ঘটা অসম্ভব। ‘‘ক্রিকেটের মতো এটা দলগত খেলা। কোচ থেকে অধিনায়ক, সবাই জানবে,’’ বলছেন এক ক্রিকেটার। প্রত্যেক দলে একজন বল বানানোর পাণ্ডা থাকে। পাঁচ-ছয় ওভার ধরে তাঁর নেতৃত্বে চলে সেই প্রয়াস। তিনিই প্রথম অধিনায়ককে ইশারা করবেন যে, বল তৈরি। অধিনায়ক তখন রিভার্স সুইংয়ে বিশেষজ্ঞ বোলারদের আক্রমণে নিয়ে আসবেন। আক্রমদের পাকিস্তান দলে ভাল বল ‘বানানো’-র কাজ করতেন লেগস্পিনার মুস্তাক আমেদ। ইংল্যান্ডে ছিলেন মার্কাস ট্রেসকোথিক।

• সাবধান, ক্যামেরা দেখছে •

আক্রম, ইউনিস-দের যুগ থেকে ক্রিকেট সম্প্রচার অনেক পাল্টেছে। এখন মাঠের চারদিকে ৩০টি ক্যামেরা বসানো থাকে। যে অঞ্চলে বেশি ক্যামেরা থাকে, সে দিকে দাঁড়ানো ফিল্ডাররা কখনও বল নিয়ে কারসাজি করবেন না। বেশি করে এই কাজ করবেন পয়েন্ট বা শর্ট মিডউইকেটে দাঁড়ানো ফিল্ডার। সব চেয়ে কম করেন সোজা দাঁড়ানো ফিল্ডাররা। সোজাসুজি থাকা ক্যামেরাগুলি সব চেয়ে সজাগ থাকে। ‘‘বল বানানোর কাজ করে ক্লোজ-ইন ফিল্ডাররা। কয়েকটি ফিল্ডিং পোজিশন আছে, যেখানে ক্যামেরার নজর কম,’’ বলছিলেন ভারতের রিভার্স বিশেষজ্ঞ এক জন।

• রিভার্স তবু এক অনন্য শিল্প •

পকেটে বোতলের ছিপি থাকলেই কি রিভার্স সুইং করা যাবে? কখনওই নয়। নেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করে তবেই সুইংয়ের সুলতান হয়েছেন আক্রম-ইউনিসরা। নতুন এবং পুরনো দু’টো বল নিয়ে পড়ে থেকেছেন। রিভার্স ইয়র্কার শিখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। যত্ন নেওয়া শিখিয়েছেন বলের। একটি ম্যাচে এক সতীর্থ ভুল করে খরখরে দিকটায় থুতু লাগিয়ে ছিল। আক্রম ছুটে এসে তাঁকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘বলকে আগে ভালবাসতে শেখ। তার পর খেলবি!’ আক্রমের হাত ধরে এই শিল্প শিখেছেন অনেকে। ভারতে রিভার্স সুইংয়ে সেরা কে? মহম্মদ শামি— প্রাক্তন নাইট, তিনিও যে আক্রমের প্রিয় ছাত্র!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy