হিউম না জেজে। হাবাস না মাতেরাজ্জি। হাসি আজ কার?
হাবাসের মগজাস্ত্র বনাম মাতেরাজ্জির জহুরির চোখ।
ভয়ঙ্কর ড্রিবলার মেন্ডোজা বনাম ছটফটে হিউম।
হিউম-দ্যুতি যুগলবন্দি বনাম মেন্ডোজা-জেজের স্কোরিং দক্ষতা।
কলকাতার টিমগেম বনাম চেন্নাইয়ের শেষ চার ম্যাচ টানা জেতার আত্মবিশ্বাস।
নানা স্বাদের লড়াইয়ের সম্ভাব্য কোলাজ শনিবার পুণেতে আইএসএল নক-আউটের অকালবোধন ঘিরে।
দু’দলের দুই মার্কি ফুটবলার পস্টিগা আর ইলানো নেই ফাইনালে ওঠার প্রথম যুদ্ধে। এক জন কোচের আস্থা ভোট না পেয়ে। অন্য জনের কার্ড সমস্যা।
কিন্তু সে তো আর পাঁচটা ফুটবল ম্যাচেও হয়। নতুন কী?
আইএসএল যে জৌলুস নিয়ে হাজির হয়েছে ভারতীয় ফুটবলে সেই রং-ই তো উধাও এই হাইপ্রোফাইল সেমিফাইনালে! জৌলুসের প্রধান উপকরণ— সেলিব্রিটিদের উপস্থিতি নিয়েই ধোঁয়াশা? কোথায় বা টিকিটের সেই হাহাকার? প্রিয় দলের পতাকা নিয়ে আগাম দৌড়োদৌড়ি? সব যেন কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে!
অভিষেক বচ্চন আসছেন। সে তো চেন্নাইয়ানের সব ম্যাচেই মাঠে থাকছেন এ বার। কিন্তু ঐশ্বর্যা বা বচ্চন পরিবারের আসার সম্ভাবনা নেই।
ভিআইপি এনক্লোজারে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বনাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি হচ্ছে না। এটিকের মুখ আসছেন না এখানে। আর ধোনি ব্যস্ত ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে।
বদলে গ্যালারি ভর্তি করতে স্কুল-কলেজ ছাত্রছাত্রীদের আনা হচ্ছে। চেন্নাই শিবির থেকে বারবার আফশোস শোনা যাচ্ছে, ‘‘আমাদের ওখানে ম্যাচটা হলে দেখতেন তিরিশ হাজার দর্শক আমাদের হয়ে গলা ফাটাত। আর এখানে বারো হাজারের মাঠেও আট হাজার টিকিট ছাপানো হয়েছে। দেখা যাক তার মধ্যেও কত জন আসেন!’’
বালেওয়াড়ি স্টেডিয়ামের সাউন্ড সিস্টেমে আজ বিকেল থেকেই গান বাজানো হচ্ছে গমগম করে। কিন্তু কাল আসল সময় ক’জন ফুটবল-উৎসবে আসবেন ভেবে সেমিফাইনালের নিরপেক্ষ কেন্দ্রের সংগঠকেরাও চিন্তিত। অস্থির। উৎসবে লোকই না থাকলে সেটা তো অকালবোধনই!
মাঠের বাইরের রং উধাও হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে কী হবে? মাঠের ভেতরের নব্বই মিনিটের যুদ্ধ ঘিরে কিন্তু উত্তেজক কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। শুরু হয়েছে যুযুধান দু’দলের পেশাদারিত্বের মারপ্যাঁচের আগাম খেলা।
চেন্নাই টিম অনুশীলনে নামার অনেক আগে তাদের কোচ মাতেরাজ্জিকে দেখা গেল সটান মাঠে ঢুকে পা ছড়িয়ে বসে পড়েছেন। খুলে ফেলেছেন জার্সি। সারা গা ভর্তি রং- বেরঙের ট্যাটু। তার উপর রোদ পড়ে যেন রামধনু! প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের কেউ দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যেতে পারে।
সাংবাদিক সম্মেলনে এসে আবার যেন জিদানের কাছে ঢুঁসো খাওয়ার মতোই চমক চেন্নাইয়ানের ইতালীয় মহাতারকার। জেজেদের কোচ চব্বিশ ঘণ্টা পরের প্রতিপক্ষ নিয়ে বলতে গিয়ে সটান বলে দিলেন, ‘‘কলকাতার আসল শক্তি ওদের কোচ হাবাস। লোকটা দেড় বছর ধরে টিমটাকে তৈরি করেছে। আমি ওর কোচিং পছন্দ করি।’’
যা শুনে অবশ্য এক ফোঁটা উচ্ছ্বসিত নন আটলেটিকো কোচ। বিপক্ষ কোচের তাঁকে দেওয়া শংসাপত্রেও কোনও অঙ্ক আছে বোধহয় ধরে নিয়ে হাবাস বললেন, ‘‘মার্কো কী বলেছে সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই আমার। আমি আমার টিম নিয়েই ভাবছি শুধু। বুদ্ধি করে খেলতে হবে। জিততে হবে।’’
ঘরের মাঠ চেন্নাইতে খেলতে না পেরে এমনিতেই মনমরা মাতেরাজ্জির দলের ফুটবলাররা। চেন্নাইয়ের সাম্প্রতিক অতি-বৃষ্টির পাশাপাশি বন্যার মতোই চেন্নাইয়ান কোচের মনমরা ড্রেসিংরুমের পাশাপাশি সমস্যা দলের সেট পিস মাস্টার ইলানোকে পাচ্ছেন না। পাচ্ছেন না সেরা গেম মেকার, আর এক ব্রাজিলিয়ান রাফায়েল আগাস্তোকেও। শেষ গ্রুপ ম্যাচে চোট পেয়ে দেশেই ফিরে গিয়েছেন তিনি। এ দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাই মেন্ডোজাদের কোচও যেন কী রকম কাঠ-কাঠ!
উল্টো দিকে হাবাসকে দেখে মনে হচ্ছিল প্রাণখোলা এক সুখী মানুষ। সাংবাদিক সম্মেলনে কোচের পাশে বসে থাকা আরাতা যখন বলছেন, ‘‘আমাদের ড্রেসিংরুমের পরিবেশ যে কোনও ফুটবলারকে খুশি করার জন্য যথেষ্ট’’, তখন হাবাস হাসতে হাসতে তাঁর দিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাথা নাড়লেন। ‘‘দেখছেন, কী বলছে!’’ এ দিন এক ঘণ্টার অনুশীলনেও তাঁকে বকাঝকা করতে দেখা যায়নি দলের কোনও ফুটবলারকে।
ঠিক সে রকমই সকালে টিম হোটেলে চোখে পড়ার মতো নমাজ পড়তে যাওয়ার সময় দ্যুতি-নবি-জুয়েলদের তিনি কেমন ভাল ভাবে প্রার্থনা করার জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন। বোরহা-নাতোদের বলছেন, ‘‘বিশ্রাম করো, বিশ্রাম করো।’’
হাবাস কেন হঠাৎ বদলে ফেললেন নিজেকে? তাও আবার এ রকম একটা হাইপ্রোফাইল ম্যাচের আগে!
কলকাতার স্প্যানিশ কোচের সঙ্গে একান্তে কথা বলে মনে হল এর পিছনে তিনটে কারণ। এক) চেন্নাই হোম ম্যাচ খেললেও ঘরের মাঠের সমর্থন পুণেতে পাবে না। দুই) হাবাস ধরে নিয়েছেন ছোট মাঠ বলে মেন্ডোজার সাপ্লাই লাইন বন্ধ করা সহজ হবে। তিন) ড্র হলেও পরে যুবভারতীতে হোম ম্যাচের সুবিধেটা নিতে পারবেন তিনি।
এ দিন প্র্যাক্টিসে হিউম-দ্যুতি যুগলবন্দি ঝালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি আরাত-হিউমকে দিয়ে নতুন কিছু মুভ করান হাবাস। বোরহা-নাতোদের আবার পাঠ দিয়েছেন পাল্টা আক্রমণ তৈরির। বিপক্ষের সেট পিসের সময় আরও আঁটোসাটো থাকার অনুশীলন করিয়েছেন অর্ণব-গ্যাভিলানদের ডিফেন্সকে। ‘‘মেন্ডোজা নামটা আমার টিম হোটেলে ঢুকতে দিচ্ছি না। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সেরা প্লেয়ারকে নিয়ে বেশি আলোচনা করলে নিজেদের ফোকাস নষ্ট হয়,’’ মিডিয়া রুম থেকে বেরিয়ে প্র্যাক্টিসে যাওয়ার পথে বলছিলেন হাবাস। মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছিল, জেতার ব্যাপারে চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী।
হাবাসের ভাবনায় জল ঢেলে দিতে মাতেরাজ্জি আবার অন্য কথা শোনাচ্ছেন। এ বার লিগের দু’টো ম্যাচেই কলকাতার কাছে হেরেছে চেন্নাইয়ান। সেখানে সেমিফাইনালে ভাঙাচোরা অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও মেন্ডোজাদের কোচ মনে করিয়ে দিয়েছেন পরিসংখ্যান। ‘‘গত বার লিগে কেরল ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে দু’টো ম্যাচ জেতা সত্ত্বেও আমরা কি সেমিফাইনালে ওদের হারাতে পেরেছিলাম? পারিনি। তা হলে এ বার কলকাতা...!’’ কথা শেষ করলেন না মাতেরাজ্জি।
আরও একটা পরিসংখ্যান তিনি না দিলেও এটিকের মনে থাকার কথা। পুণের এই মাঠ কিন্ত এখনও আইএসএলে কলকাতাকে জিততে দেয়নি। কলকাতার কর্তাদের মধ্যেও কারও কারও আশঙ্কা, হাবাসের উইং প্লে অস্ত্র কাল এই মাঠে কার্যকর নাও হতে পারে। হাবাসও সেটা বুঝছেন বোধহয়। এ দিন অনুশীলনে আলট্রা ডিফেন্সিভ স্ট্যাটেজি ফিরিয়ে আনা সেই ভাবনারই ফসল হয়তো। মাতেরাজ্জির অনুশীলনে অবশ্য দেখা দেখা গিয়েছে উল্টো ছবি। আক্রমণ আর আক্রমণ।
কাল শেষ হাসি কে হাসবেন সেটা সময় বলবে। তবে যু্দ্ধের আগের দিন দু’জনকে দেখে মনে হল, কেউ কাউকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে নারাজ। যে ঠোকাঠুকিতে মাঠের ভিতরে যে রঙিন ফুলকি উঠবে সেটা এক রকম গ্যারান্টি। নাই বা হোক গ্যালারি রঙিন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy