চিলি ০(৪) : আর্জেন্তিনা ০(২)
হতাশা। যন্ত্রণা। কান্না। টিভি-তে লিওনেল মেসির মুখের ক্লোজ আপ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, মুহূর্তটা দুঃখের হলেও এটাই হওয়ার ছিল।
আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে মেসির অবসর ঘোষণা করা ফুটবলের জন্য শোকের দিন হতে পারে। কিন্তু ঘটনা হল, দেশ এবং তার সেরা ফুটবলারের মধ্যে ফাটলটা কিন্তু অনেক দিন আগে থেকেই বড় হচ্ছিল। মাঠ এবং মাঠের বাইরেও।
তিন বছরে যদি কেউ দেশের জার্সিতে তিনটে ফাইনাল হারে তা হলে তো বোঝাই যাচ্ছে, কোথাও একটা সমস্যা আছে। বিশ্বকাপ ফাইনালে না হয় জার্মানির মতো হেভিওয়েট দল ছিল। কিন্তু তা বলে চিলি? তাও আবার পরপর দু’বছর। এতেই তো বোঝা যাচ্ছে, আর্জেন্তিনা আর মেসির জুটি ট্রফির সামনে এসে ক্লিক করছে না। ক্লাবের হয়ে যতই ভাল ফর্মে থাকুক না কেন, দেশের হয়ে শেষমেশ সেই এক ছবি। সেই এক গল্প। মেসি হয়তো বুঝে গিয়েছিল, এর পর আর এই টিম নিয়ে ট্রফি জেতা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
২০১৫ কোপা ফাইনালের রাত এখনও চোখের সামনে ভাসছে। এই চিলির কাছেই ফাইনালে হারতে হয় মেসিকে। কিন্তু এক বছরের মধ্যে শতবর্ষের কোপা ঘোষণা করার পরে ভেবেছিলাম, যাক এ বার মেসির পাশে কালো দাগটা মুছবে। আর্জেন্তিনা যা দল নিয়ে গিয়েছিল তাতে আমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। গ্রুপ পর্ব থেকে শুরু করে সেমিফাইনাল পর্যন্ত মেসি যা খেলছিল, তাতে যে কেউ আর্জেন্তিনাকে ফেভারিট ধরবেই। কিন্তু সোমবার সকালের ফাইনালটা যাবতীয় হিসেবকে ভুল প্রমাণিত করে দিল। যার পিছনে রয়েছে চিলির হাইপ্রেসিং ফুটবল।
চিলির খেলা এমন কিছু দুর্দান্ত ছিল না। বলতে পারব না যোগ্য দল হিসেবে ওরা জিতেছে। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, ট্রফি তোলার খিদে আর ফুটবলারদের জয়ের তাগিদ আর্জেন্তিনার থেকে চার গুণ বেশি ছিল চিলির মধ্যে। শুরুর থেকেই অবিশ্বাস্য গতিতে প্রতিটা বল তাড়া করতে শুরু করেছিল সাঞ্চেজরা। কোনও সময় থামতে দেখিনি। ওরা যেন ভুলে গিয়েছিল কোন পজিশনে খেলছে। শুধু দৌড়ে দৌড়ে আর্জেন্তিনাকে তাড়া করে গিয়েছে। এমনকী প্রথমে লাল কার্ড দেখার পরেও জায়গা দেয়নি মেসিদের।
কিন্তু আর্জেন্তিনার বিরুদ্ধে খেলা মানে তো মেসির জন্যও তোমাকে আলাদা কিছু ভেবে আসতে হবে। চিলিও সেই প্ল্যানটা করে এসেছিল। এবং মাঠে নেমে সেটা কাজেও লাগাল দারুণ ভাবে।
সোমবারের মেসিকে দেখে মনে হচ্ছিল চক্রব্যূহে বন্দি হওয়া এক প্রতিভা। ও যত বারই বল পাচ্ছিল তত বারই চিলির চার-পাঁচজন ফুটবলার এসে ঘিরে নিচ্ছিল। একজন ডিরেক্ট মার্কার। বাকি চার জন জোনাল মার্কার। এ রকম মার্কিংয়ে শট নেওয়া তো দূর, পা দুটোই ঠিক করে মুভ করা যায় না। আর তাই গোলের কাছে না গিয়ে দূর থেকেই শট নেওয়ার চেষ্টা করতে হচ্ছিল মেসিকে। যেখান থেকে গোল হওয়া প্রায় অসম্ভব।
মেসির মতো বল প্লেয়ারের সব সময় একটা ভাল পাসিং আউটলেট দরকার হয়। সাম্প্রতিক কালে গোল করা ছাড়াও মেসি দেখিয়েছে ও কত সুন্দর স্কিমার। নিজে গোল না করলেও গোল করাতে পারে। কিন্তু চিলির বিরুদ্ধে ও বল পেলে পাশে কাউকে পাচ্ছিল না যার সঙ্গে ওয়াল খেলতে পারে। স্বভাবতই বলটা বেশিক্ষণ নিজের কাছে রাখতে হচ্ছিল। ড্রিবল করার চেষ্টা করছিল। আর সে সময়টাতেই চিলি এসে ঘিরে ধরছিল। মুভ তৈরি করতে চাইলেও পারেনি। কয়েকটা ভাল ড্রিবল করেছিল। কিন্তু সামনে যখন প্রথম মার্কার কেটে যাচ্ছে তখন সাপোর্টে আসছে আর এক মার্কার। তাই বেশিক্ষণ বল পায়ে রাখা মানেই বিপক্ষ ঘিরে ধরবে আর শেষমেশ বল জমা দিয়ে চলে আসতে হবে। মেসির সঙ্গে যা হল।
গত কয়েক বছরে মেসির সঙ্গে ভাল কম্বিনেশন গড়েছিল ইগুয়াইন, রোখো, দি’মারিয়ার মতো ফুটবলাররা। কিন্তু ফাইনালে দি’মারিয়া চোট থেকে ফিরে বেশি কিছু করতে না পারায় ওকে বসিয়ে দিতে হল। রোখো লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে গেল। ইগুয়াইন ফার্স্ট হাফে একটা খুব সহজ সুযোগ ফস্কায়। সেকেন্ড হাফেও খুব বেশি ছাপ ফেলতে পারছিল না। সে সময় ওকে তুলে নেন মার্টিনো। এর ফলে মেসির তিনটে প্রধান সাপোর্ট সিস্টেমই অকেজো হয়ে যায়। আমি বলব, ইগুয়াইন আর দি’মারিয়া যতই খারাপ খেলুক ওদের মাঠে রাখা উচিত ছিল। যাতে মেসির সঙ্গে কম্বিনেশনটা তৈরি করতে পারে। ওরা বসে পড়ায় মেসি পুরো একা হয়ে যায়। সাধারণত, মাসচেরানো মাঝমাঠ থেকে মেসিকে সাপোর্টটা দেয়। কিন্তু রোখো লাল কার্ড দেখায় মাসচেরানোকে ডিফেন্সে নেমে যেতে হয়। এবং মেসির সঙ্গে ওর এতটাই দূরত্ব হয়ে যায় যে কোনও মুভমেন্ট আর তৈরি হচ্ছিল না।
এ বার আসি টাইব্রেকারের কথায়। মনে হচ্ছে, মেসি অতিরিক্ত চাপটা সামলাতে পারল না। ওর শটটায় জোর বেশি ছিল, প্লেসমেন্ট নয়। ইদানীং কিন্তু বার্সেলোনার হয়ে অনেক স্পট কিক নষ্ট করেছে মেসি। তাই হয়তো মানসিক ভাবে ও একটু গুটিয়ে ছিল কিকটা মারার সময়।
চিলির বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে আর্জেন্তিনা জিতেছিল। ওই ম্যাচে মেসি দলে ছিল না। তাই হয়তো মেসির অভাবটা ঢেকে দিতে আর্জেন্তিনার ফুটবলারদের মধ্যে একটা বাড়তি তাগিদ ছিল। সেই তাগিদটাই পেলাম না ফাইনালে।
আসলে টিমে মেসির মতো একজন কিংবদন্তি থাকলে যা হয় আর কী। দলের বাকিরা ওর দিকেই তাকিয়ে থাকে। সমস্ত আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় মেসি। সবাই যেন ভেবেছিল, প্রতিটা মুভ ও তৈরি করবে। প্রতিটা ফ্রি-কিক ও মারবে। প্রতিটা শট ও নেবে। আরে এটা তো এগারো জনের খেলা। ফুটবলে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যতা ম্যাচে সৌন্দর্য আনতে পারে। তা বলে এই নয় সব সময় জয় তুলে আনবে। এই কারণেই তো আর্জেন্তিনা আর মেসির শেষটা এত যন্ত্রণার হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy