রহস্য ১ নারিন
ক্রিকেট সাংবাদিক তো বটেই, কেকেআর-দর্শকের কাছেও দৃশ্যটা এখন সম্পূর্ণ ক্লিশে!
টিম গম্ভীরের উইকেট দরকার? ম্যাচ হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে? অবধারিত তাঁকে ডাক এবং তিনি আসবেন। আসবেন চলমান মৃত্যুদূত হয়ে। নতজানু হয়ে তাঁর স্পিনের সামনে দাসত্ব স্বীকার করবে দুঁদে ব্যাটসম্যান, ম্যাচও ঘুরিয়ে দেবেন টিম গম্ভীরের দিকে, কিন্তু নিজে থাকবেন নির্বিকার। চার বছর ধরে আছেন যেমন। ভাবলেশহীন। হ্যাটট্রিক চান্সের সামনে না এখনই ছক্কা গিললেন, কেউ দেখে বুঝবে না। কেউ বুঝবে না পাঁচ মিনিট আগে যে ব্যাটসম্যানকে তিনি ফেরালেন তাঁর নাম কী? বিরাট কোহলি না শ্যামবাজারের পঞ্চানন পাল? মুখ তো বরাবরের অঙ্কে গোল্লা পাওয়া ছাত্রের মতো।
সুনীল নারিন সত্যিই খুব ক্লিশে হয়ে গিয়েছেন। পারফরম্যান্সে, আবেগের বহিঃপ্রকাশে!
নিজামের শহরে কেকেআর চার উইকেটে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় ম্যাচটাও জিতে নেওয়ার পর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দেখা গেল সুনীল নারিনকে নিয়ে দু’টো তর্কসভা বসেছে। একটা বিদগ্ধ ক্রিকেটলিখিয়েদের। যাঁরা ঠিক নিশ্চিত নন, সীমিত ওভারের ক্রিকেট বাজারে আমদানি না হলে সুনীল নারিন নামের কোনও বস্তুর অস্তিত্ব ক্রিকেট-পৃথিবীতে থাকত কি না। কারণ ক্যারিবিয়ান অফস্পিনার টেস্ট ক্রিকেটের বিশেষ ধার ধারেন না, ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট টিমও তাঁর টি-টোয়েন্টির বোলিংকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না। বয়সের উল্লেখ নেটওয়ার্কিং সাইটে না থাকলেও দ্বিতীয় তর্কসভাটা টি-টোয়েন্টি সম্প্রদায়ের। যারা সুযোগ বুঝে নারিন নিয়ে সুস্বাদু সব ইয়ার্কি ছাড়ছে। বলে দিচ্ছে, কী কী নিয়ম অবিলম্বে আনা উচিত নারিনের জন্য। যেমন, তিনি চার ওভারে দশের বেশি দিলে কড়া ‘শাস্তি’ হিসেবে ব্যাটিং টিমের স্কোরের সঙ্গে গোটা পনেরো রান জুড়ে দিতে হবে। যেমন, এক জন ব্যাটসম্যানকে এক বার নয়, দু’বার আউট করতে হবে নারিনকে। সবচেয়ে ভাল নাকি নিয়ম করে দেওয়া যে, নারিনকে টিমে রাখা যাবে একটা শর্তে। তিনি হবেন দ্বাদশ ব্যক্তি। কারণ নিয়মগুলো তাড়াতাড়ি চালু না হলে নারিনের টিম খেললে টি-টোয়েন্টির উত্তেজনা চলে যাচ্ছে।
আবদার বটে। ইংল্যান্ড ক্রিকেটে এক কালে ডব্লিউ জি গ্রেসকে নিয়ে এমন রসালো টুকরো-টাকরা ছড়িয়েছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু ক্যারিবিয়ান অফস্পিনার যে উচ্চতায় নিজের বোলিংকে দিন দিন নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে টি-টোয়েন্টি বোলিংয়ে গ্রেস-সুলভ সম্মান এ বার ক্রিকেটারদের থেকে পেতে শুরু করলে খুব আশ্চর্যের হবে না।
এ দিন নারিনের স্পিন ম্যাচটাকে ভারত বনাম পাকিস্তান নয়, টিম গম্ভীরের আরও একটা রেকর্ডের ম্যাচ হিসেবে লিখে দিয়ে গেল। যতই শেষ দিকে সূর্যকুমার যাদবের দিকে ফলো থ্রু-তে তেড়ে যান আইজাজ চিমা। সবাই বুঝল ওটা হতাশার বহিঃপ্রকাশ। তেজের নয়। যতই ম্যাচটা শেষ ওভারে যাক। সবাই জানত, কেকেআর ওটা জিতছে। বরং পাকিস্তানের টিমকে রক্তাক্ত করে এগারো ম্যাচে এগারো করে গেল কেকেআর। সেই আইপিএল সেভেন থেকে যা শুরু হয়েছে। যা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে কেউ কখনও করতে পারেনি। ভাবার সাহসও কি কেউ দেখিয়েছে?
আজ নারিনের স্পিন গৌতম গম্ভীরকে প্রত্যাবর্তনের মঞ্চও দিয়ে গেল। যা চাপহীন, যা সম্ভব ছিল না টার্গেট দেড়শোর বদলে ১৭০-১৮০ হলে। বহু দিন পর গম্ভীর নয়, ঝকঝকে দেখাল কেকেআর ক্যাপ্টেনের ব্যাটকে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর জ্বলে ওঠার চিরাচরিত ট্র্যাডিশন আছে। আর রবিবারের গম্ভীর, নির্মম গম্ভীর। লাহৌরের এক নম্বর এক্সপ্রেস চিমার জন্যই প্রহারের বেশিটা বরাদ্দ ছিল। একটা সময় রবিন উথাপ্পা যখন সবে ৪ ব্যাটিং, গম্ভীর তখন প্রচণ্ড মারে ৩০ পেরিয়ে গিয়েছেন কবে এটা শেষ দেখা গিয়েছে?
রহস্য ২ কুলদীপ
এক-এক সময় ভাবতে ইচ্ছে করবে, লাহৌর ইনিংসের পনেরো নম্বর ওভারটা না থাকলে কী হত শেষ পর্যন্ত? নারিন তার আগে একটা নিয়েছিলেন। কিন্তু ম্যাচটা ঘুরে গেল ওই ওভারে যেখানে ক্যারিবিয়ান অফস্পিনার পরপর দু’বলে দু’জনকে তুলে নিলেন। ওমর সিদ্দিকি আর আসিফ রাজা নামের যে দু’জন এলবিডব্লিউ আর বোল্ড হলেন, তাঁরা বুঝতেও পারেননি ঠিক কী ঘটে গেল! ওমর ক্যারম বলে শেষ। বাঁ হাতি রাজা আবার বোল্ড হয়েও টের পাননি বোধহয়। পরের বলের জন্য স্টান্স নিতে যাচ্ছিলেন! হাফিজকে দেখা গেল শোকস্তব্ধ মুখচোখে বসে। শনিবার তাঁর প্রচ্ছন্ন গর্বে বলা ‘নারিনকে আমরা খেলতে জানি’ এ দিন তো তাঁকেই গিলতে হল। দেখতে হল, ৪ ওভারে তিনটে নিচ্ছেন নারিন, মাত্র ন’রান খরচ করে। চেন্নাইয়ের রাজাধিরাজদের বাড়তে দেননি, রান খরচের সংখ্যা একই ছিল, পার্থক্যের মধ্যে আজ শোষিতের ভূমিকায় লাহৌরের সিংহরা।
লাহৌর অধিনায়ক নিজেও পারেননি। শুধু তাই নয়, নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে তাঁর উইকেট দিয়েই কেকেআর সংসারে নতুন স্পিন-অস্ত্রের জন্ম হল। ভুল। আসলে ভারতের স্পিন-সংসারে। যিনি নারিনের মতোই কৃপণ, যাঁকে খেলা নারিনের মতো দুর্বোধ্য না হলেও কঠিন। শোনা যায়, কৈশোরে জেদ ধরে পেস বোলিং চালিয়ে যাওয়ার জন্য কোচের কাছে রীতিমতো শাস্তি পেতে হত কুলদীপ যাদবকে। রবিবারের পর ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে পারেন কুলদীপ। অনূর্ধ্ব-উনিশ ভারতীয় দলের স্পিনার চার ওভারে ২১ দিয়ে হাফিজকে নিলেন, বিসলা সহজতম স্টাম্পিং মিস না করলে উইকেটসংখ্যা তাঁর আজ দুই হয়। সবচেয়ে বড় কথা, নারিনের তৈরি করা চাপটা তিনিও রেখে গিয়েছেন। তাঁর স্পিনটাও ধরতে পারেননি কেউ। আর সেটা হয়েছে কুলদীপের বোলিং স্টাইলের জন্যই। তিনি আর পাঁচ জন বাঁ হাতি স্পিনারের মতো নন, চায়নাম্যান। আগে একটা পল অ্যাডামস ছিল। এখন শুধু একটা ব্র্যাড হগ পড়ে আছে।
তাই কোথাও গিয়ে মনে হবে, রবিবাসরীয় হায়দরাবাদে গৌতম গম্ভীরের শ্রেষ্ঠ পাওনা মোটেও এগারোয় এগারো নয়। অধরা ট্রফির শেষ চার প্রায় নিশ্চিত করে ফেলাও নয়। পাকিস্তানের টিমকে হারানো বা নিজের ফর্মে ফিরে আসাও নয়।
গৌতম গম্ভীর বোধহয় সবচেয়ে তৃপ্তি পাবেন এখন তাঁর টিমের স্পিন অস্ত্রদের দেখলে। আগে তাঁর হাতে একজন ‘শ্রীযুক্ত নির্ভরযোগ্য’ ছিল। এখন একের সঙ্গে আরও এক, দুই।
নতুন জন চায়নাম্যান। পুরনো জন মিস্ট্রি স্পিনার।
দু’জনেই বিরল!
সংক্ষিপ্ত স্কোর
লাহৌর লায়ন্স ২০ ওভারে ১৫১-৭ (শেহজাদ ৫৯, উমর ৪০, নারিন ৩-৯, কুলদীপ ১-২১)
কেকেআর ১৯.৩ ওভারে ১৫৩-৬ (গম্ভীর ৬০, উথাপ্পা ৪৬, চিমা ২-৪২)।
ছবি বিসিসিআই টিভি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy