Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

অঙ্কিত ফুটবলার হলে চোটটা এড়াতে পারত

বললেন প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ফুটবলার আর কোচ হিসেবে দীর্ঘ সাত দশকে যাঁর মাঠে চোট পাওয়া আর চোট পেতে দেখা, দুয়েরই অভিজ্ঞতা প্রচুর। সোমবার সল্টলেকের বাড়িতে বসে তিনি অঙ্কিতের মর্মান্তিক চোট নিয়ে নিজস্ব মতামত দিলেন সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়-কে।মৃত্যু সংবাদ মানেই তীব্র যন্ত্রণার। তার উপর সেটা যদি খেলতে গিয়ে ঘটে তার চেয়ে মর্মান্তিক বোধহয় আর কিছু নেই। মানুষ খেলেই তো আনন্দ পেতে আর আনন্দ দিতে। সেখানে যখন কুড়ি বছরের একটা তরতাজা প্রাণ নিছক ক্যাচ লুফতে গিয়ে চোয়াল-ঘাড়ে চোট পেয়ে দু’দিন পরে হাসপাতালে চিরদিনের মতো শেষ হয়ে যায়, তার ভয়ঙ্কর ধাক্কা একজন আটাত্তরের প্রবীণ প্রাক্তন খেলোয়াড়কে কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে সেটা ব্যাখ্যা করার মতো মানসিকতা আমার এই মুহূর্তে নেই।

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৮
Share: Save:

মৃত্যু সংবাদ মানেই তীব্র যন্ত্রণার। তার উপর সেটা যদি খেলতে গিয়ে ঘটে তার চেয়ে মর্মান্তিক বোধহয় আর কিছু নেই।

মানুষ খেলেই তো আনন্দ পেতে আর আনন্দ দিতে। সেখানে যখন কুড়ি বছরের একটা তরতাজা প্রাণ নিছক ক্যাচ লুফতে গিয়ে চোয়াল-ঘাড়ে চোট পেয়ে দু’দিন পরে হাসপাতালে চিরদিনের মতো শেষ হয়ে যায়, তার ভয়ঙ্কর ধাক্কা একজন আটাত্তরের প্রবীণ প্রাক্তন খেলোয়াড়কে কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে সেটা ব্যাখ্যা করার মতো মানসিকতা আমার এই মুহূর্তে নেই।

একই সঙ্গে নিজের দীর্ঘ ফুটবলার আর কোচিং জীবনে মাঠে প্রচুর চোট পাওয়া আর চোট পেতে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে অঙ্কিত কেশরীর অকাল মৃত্যু ঘিরে মনে কয়েকটা প্রশ্ন জাগছে। পাশাপাশি মনের ভেতর ভিড় করছে বেশ কিছু স্মৃতিও। বারবার মনে হচ্ছে, ক্রিকেট মাঠে টিপিক্যাল ফুটবলীয় চোট একজন তরুণ ক্রিকেটারের জীবন কেড়ে নিল! অথচ ফুটবল মাঠে বলের জন্য এ রকম সংঘর্ষ অ্যাটাকার আর ডিফেন্ডারে আকছার হয়ে থাকে। ডিফেন্ডারের দস্তুরই হল, এরিয়াল বলের লড়াইয়ে আগুয়ান ফরোয়ার্ডকে ট্যাকল করার সময় নিজের হাঁটু বিপক্ষের বুক থেকে মুখের দিকে সজোরে এগিয়ে দেওয়া।

ঠিক যেমন সে দিন ইস্টবেঙ্গলের ক্রিকেট ম্যাচে উঁচু ক্যাচের দিকে দু’জন ফিল্ডার ধাওয়া করতে গিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে সতীর্থের হাঁটু সজোরে আঘাত করেছিল অঙ্কিতের ঘাড়ের পিছনে। এখন প্রশ্ন, সারা পৃথিবীতে ফুটবলে যে চোট হামেশাই লাগছে, সেই ধরনের চোটে ক্রিকেট মাঠে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল কেন?

আমার মনে হচ্ছে, ক্রিকেটে এমন ফুটবল ম্যাচ-মার্কা সংঘর্ষ বিরল বলেই এ রকম মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল ময়দানে। আসলে ফুটবলের মতো আপাতমস্তক বডি কনট্যাক্ট গেমে প্লেয়াররা চোটআঘাতের ব্যাপারে মাঠে সব সময় যতটা সতর্ক থাকে, ক্রিকেটের মতো মূলত ব্যাট-বলের লড়াইয়ে ততটা থাকে না। বিশেষ করে ফিল্ডাররা। সত্যি বলতে কী, থাকার দরকারও পড়ে না।

বহু বছর আগে আমাদের দেশের ক্রিকেটার রামন লাম্বা বাংলাদেশের মাঠে যে বলের আঘাতে মারা গিয়েছিল, সেটা ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে তার দিকে ব্যাটসম্যানের সপাটে মারা শটে। আর হালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার ফিল হিউজের ব্যাট করতে গিয়ে মৃত্যু ঘটেছে মাথার পিছন দিকে হেলমেটের অনাবৃত জায়গায় বাউন্সার আছড়ে পড়ায়। ফাস্ট বোলারের ভয়ঙ্কর বাউন্সার থেকে বাঁচতে ব্যাটসম্যানের জন্য না হয় হেলমেট, আর্ম গার্ড, চেস্ট গার্ড আছে। ক্লোজ ইন ফিল্ডারও সিন গার্ড, অ্যাবডোমেন গার্ড পরে থাকে। কিন্তু আউট ফিল্ডে খাটান দিচ্ছে যারা তাদের হয়তো লাখে এক বার গুরুতর চোট পাওয়ার আশঙ্কা। যদি না অঙ্কিতের মতো চরম দুর্ভাগ্যের শিকার কেউ হয়!

সে জন্যই আরও বেশি করে এ রকম পজিশনের ফিল্ডার চোটআঘাত লাগার ব্যাপারে কম সতর্ক থাকে। আর সেই রকম মুহূর্ত তার সামনে এলে সেটাকে এড়ানোর ব্যাপারে আরওই কম সতর্ক থাকে। তবে সেটা মোটেই ফিল্ডারের দোষ নয়। আসলে তাকে এর ট্রেনিং দেওয়ার প্রয়োজনই বিশেষ থাকে না। যেটা ফুটবলে একজন অ্যাটাকারের অবশ্যম্ভাবী ট্রেনিংয়ের মধ্যে পড়ে।

কোচিং জীবনে যেমন আমি আকবর, হাবিবকে হেডিংয়ের সময় চোট এড়ানোর আলাদা ট্রেনিং করাতাম। তা সত্ত্বেও আকবরকে চোখের সামনে কম করে দু’বার ডিফেন্ডার বা কিপারের সঙ্গে সংঘর্ষে মাথায়-ঘাড়ে চোট পেতে দেখেছি। কিন্তু কী ভাগ্যিস সেগুলো বড় রকমের চোট হয়নি। তাই এক-এক সময় মনে হচ্ছে, অঙ্কিতের চোটটা ফুটবল মাঠে লাগলে বেচারা হয়তো মরত না। যতটা মারাত্মক চোট পেয়েছে, তার চেয়ে হয়তো কম আঘাত পেত। চোটের প্রাবল্য নির্ঘাত কিছুটা হলেও এড়াতে পারত।

তা ছাড়াও উঁচু বলের দিকে নজর রাখতে গিয়ে দু’জন ফিল্ডারের মধ্যে যখন সংঘর্ষ ঘটে সেটা এতটাই আচমকা ঘটে যে, তার আগের সেকেন্ড পর্যন্ত কারও পক্ষে একচুলও মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকা অসম্ভব। ফলে মানসিক আঘাতটাও ভীষণ হয়। অঙ্কিতের আঘাতের দু’দিন পরে শেষমেশ হার্টফেলে মৃত্যু হয়েছে শুনে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, বাচ্চা ছেলেটা হয়তো খুব ভয়ও পেয়েছিল। যেমন সাঁতার না জানা কেউ ডুবে মারা গেলে দু-একটা ক্ষেত্রে দেখা যায়, ডুবে মারা যাওয়ার মতো জল সেখানে ছিল না। বেচারা জলে পড়ে যাওয়ার ভয়ে আরও মারা গিয়েছে।

নার্সিংহোমে শোকস্তব্ধ অঙ্কিতের বন্ধুরা। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

তবে ফুটবলেও কি দু’জন প্লেয়ারের সংঘর্ষে হেড ইনজুরিতে কারও মৃত্যু ঘটে না? আমাদের দেশেই এ রকম দুটো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা এখনই মনে পড়ছে। সন্তোষ ট্রফিতে রেলের সঞ্জীব দত্তের মৃত্যু আর ফেড কাপে জুনিয়রের মারা যাওয়ার ঘটনা। সঞ্জীবের ক্ষেত্রে সেই সময় দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ডোপিংয়ের একটা মৃদু সন্দেহের প্রশ্ন উঠেছিল। আর জুনিয়রের বেলায় গোলকিপারের প্রচণ্ড জোর ফিস্ট বল মিস করে সামনেই হেড করতে ওঠা জুনিয়রের মাথায় আঘাত করেছিল। ‘কনকাশান’ থেকে মৃত্যু।

আমার ফুটবলজীবনে ছাপ্পান্নর মেলবোর্ন অলিম্পিক থেকে ছেষট্টির লিগ ম্যাচ—দশ বছরে অন্তত দশ বার মাথায় চোট পেয়েছি। বেশির ভাগই হেডে গোল করার চেষ্টায়। মেলবোর্নে আমার চেয়ে সাত-আট ইঞ্চি লম্বা যুগোস্লাভ কিপারের সঙ্গে সংঘর্ষের পর কান থেকে রক্ত বেরোলেও ঠিক বুঝিনি। বাকি মিনিট কুড়ি খেলার পর ম্যাচ শেষ হতেই অজ্ঞান হয়ে যাই।
হাসপাতালে আট-নয় ঘণ্টা পরে নাকি আমার জ্ঞান ফিরেছিল। তার দশ বছর পরে লিগে বিএনআর ম্যাচে অরুণ ঘোষের সঙ্গে এরিয়াল বলে ওর হেড আমার মাথার পিছনে এত জোরে আঘাত করেছিল যে মাঠেই কয়েক সেকেন্ড অজ্ঞান ছিলাম। তার পরেই আমার ডাক্তার-পরিবার শ্বশুরবাড়ির গুরুজনদের প্রবল চাপে আমাকে ফুটবল ছাড়তে হয়। ক’জন জানেন জানি না, একত্রিশেই আমার ফুটবলকে চিরবিদায় জানানোর পিছনে অন্যতম একটা কারণ কিন্তু হেড ইনজুরি।

যে আঘাত আমার ফুটবলারজীবন কেড়ে নিয়েছিল, সেটা অঙ্কিতের জীবনই কেড়ে নিল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE