ফাইল চিত্র
মাদার মেরির জন্য লকডাউন আশীর্বাদ। জীবনে এই প্রথম পরিবারের সঙ্গে এত দীর্ঘ সময় কাটাতে পারছেন। বাচ্চাদের পিৎজ়া, বার্গার তৈরি করে খাওয়াচ্ছেন। অন্য দিকে বক্সার মেরির পরীক্ষা কঠিন করে দিয়েছে অতিমারি এবং দীর্ঘ লকডাউন। কী ভাবে তিনি নিজেকে তৈরি রাখছেন পিছিয়ে যাওয়া অলিম্পিক্সের স্বপ্ন ধরে রাখার জন্য? চিরকাল দর্শকদের চিৎকারে উদ্বুদ্ধ বক্সারেরা কী ভাবে লড়বেন দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে? আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত, খোলামেলা আলাপচারিতায় সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে হাজির দেশের গর্ব মেরি কম। বলে দিলেন, অতিমারির ধাক্কা সামলেও সোনার স্বপ্ন সফল করতে মরিয়াই তিনি।
প্রশ্ন: বক্সিং ভীষণই দর্শক-নির্ভর একটা খেলা। দর্শকরা বড় অনুপ্রেরণা বক্সারদের কাছে। কোভিড-১৯ অতিমারির জেরে দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে যদি আপনাকে লড়তে হয়, কেমন হবে সেই অভিজ্ঞতা?
মেরি কম: দর্শকেরা আমাদের সব কিছু। বরাবর বক্সারের জীবনে বিরাট অবদান রেখেছেন তাঁরা। স্টেডিয়ামে ঢুকছি আর বিরাট চিৎকারে দর্শকেরা আমাকে স্বাগত জানাচ্ছেন, সেটাই তো এক জন অ্যাথলিটকে সব চেয়ে বেশি তাতিয়ে দেয়। বাইরের দেশে নিজের সতীর্থ এবং কোচ ছাড়া সমর্থন করার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেখানে দর্শকদের ভালবাসা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
প্র: আর ভারতে? নিজের দেশের সমর্থন নিয়ে কী বলবেন?
মেরি: অতুলনীয়! নিজের দেশের স্টেডিয়ামে, নিজেদের মানুষের ভালবাসা আর গর্জনের সমর্থনে খেলার অনুভূতিই অন্য রকম। কী জানেন তো, ফাঁকা স্টেডিয়ামে খেলার ব্যাপারটাই কখনও বক্সার হিসেবে ভাবিনি। উল্টোটাই তো স্বপ্নে দেখেছি। ভর্তি স্টেডিয়ামে মানুষের চিৎকার শুনছি... মেরি, মেরি! কাম অন মেরি! আর আমি প্রতিপক্ষকে নক-আউট করে দিচ্ছি। তবু কী আর করা যাবে! নতুন এই পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নিতেই হবে। অতিমারির মধ্যে মানুষের জীবনের চেয়ে দামি কিছু নেই। স্বাস্থ্যের সুরক্ষা সবার আগে।
প্র: মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে না?
মেরি: হবে, তবু মানিয়ে নিতেই হবে। ফাঁকা স্টেডিয়ামে লড়তে হলে দর্শকদের খুব মিস করব। তবে প্রার্থনা করব, খুব তাড়াতাড়ি কোভিড-১৯ প্রতিষেধক বেরোবে আর আমরা সকলে দ্রুতই আগের মতো স্বাভাবিক পৃথিবীতে ফিরতে পারব।
প্র: আপনার স্মরণীয় কোনও ফাইটের কথা বলতে পারেন, যেখানে দর্শকদের সমর্থন ম্যাচ ঘুরিয়েছিল?
মেরি: দিল্লিতে ২০১৮ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। সমর্থকেরা যে ভাবে আমার জন্য চেঁচিয়েছিলেন, ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। বিশেষ করে ফাইনালে। মনে হচ্ছিল, সারা দেশ যেন আমার জন্য চিৎকার করছে। সমর্থকদের গর্জনই আমাকে তাতিয়ে দিয়েছিল। বক্সিং রিংয়ে কিছু কিছু সময় আসে যখন পরিস্থিতি পক্ষে থাকে না। তখন...কঠিন সেই সময়টায় দর্শকদের চিৎকার আসলে ঐশ্বরিক আলোর রশ্মির মতো। শরীরে প্রবেশ করে সেই রশ্মি বক্সারকে জাগিয়ে তোলে, কোথা থেকে যেন একটা বাড়তি শক্তি চলে আসে তার মধ্যে, যে হাতটা এতক্ষণ উঠছিল না সেটাই সজোরে আছড়ে পড়ে প্রতিপক্ষের মুখের উপরে। কোণঠাসা হয়ে পড়েও সে নক-আউট করে দেয় প্রতিপক্ষকে। আমার ক্ষেত্রে ২০১৮ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল সে রকম একটা স্মরণীয় মঞ্চ।
প্র: আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, বক্সিং খুবই ‘বডি কন্ট্যাক্ট গেম’। রিংয়ে তো আর শারীরিক ব্যবধানের নিয়ম মানা সম্ভব নয়। অতিমারির জেরে বক্সিংয়ের মতো খেলায় ভয়টা কি একটু বেশিই থাকছে না?
মেরি: ভয় আছে নিশ্চয়ই। তবে সেটা শুধু আমাদের ক্ষেত্রে নয়, সব অ্যাথলিট, খেলোয়াড়ের জন্যই। যত দিন না প্রতিষেধক বেরোচ্ছে, উদ্বেগ থেকেই যাবে। প্রতিপক্ষ সঙ্গে নিয়ে বক্সিং প্র্যাক্টিস এখনও বন্ধ। সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা ভেবেই বন্ধ রাখা হয়েছে। আমি অপেক্ষা করে আছি কবে আবার আগের মতো বাইরে বেরিয়ে ট্রেনিংয়ে যেতে পারব। আপাতত বাড়িতে থেকেই ট্রেনিং করছি নিজেকে ছন্দে রাখার জন্য।
প্র: প্রচুর বিতর্কের পরে রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করলেন। সেই অলিম্পিক্স পিছিয়ে গেল। আপনি কতটা হতাশ? স্বপ্নটাকে কি কঠিন করে দিয়ে গেল অতিমারি?
মেরি: আমার স্বপ্ন অলিম্পিক্সে সোনা জেতা। আমার অলিম্পিক্স পদক আছে, তবে এ বার সেই পদকের রংটা পাল্টাতে চাই। আমি মনে করি, বক্সার হিসেবে এখন অনেক পরিণত হয়েছি। রণনীতিতে অনেক বেশি পোক্ত হয়েছি। যে রকম পরিশ্রম করে চলেছি, তাতে আমি আত্মবিশ্বাসী যে, অলিম্পিক্স পিছিয়ে গেলেও আমি পারব। ঈশ্বরের কৃপায় যদি আমি ফিট থাকি, তা হলে হলুদ রংয়ের পদকটা আনতে চেষ্টার ত্রুটি রাখব না। প্রাথমিক ভাবে, হতাশ হয়েছিলাম ঠিকই যখন শুনলাম অলিম্পিক্স পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দ্রুত নিজেকে বোঝালাম, এটা একটা অদ্ভুত সময়। কেউ ভাবেনি এ রকম পরিস্থিতির সামনে পড়তে হবে। তাই আমি যেটা করতে পারি, তা হচ্ছে, নিজেকে দারুণ ফিট রাখা, স্বপ্নটা ধরে রাখা, পরিশ্রম করে যাওয়া। আমি ঠিক সেটাই করে চলেছি।
প্র: এই মুহূর্তটায় দাঁড়িয়ে নিজের শক্তি, দুর্বলতা কী কী মনে হচ্ছে?
মেরি: লকডাউনের জন্য আমরা এখন রিংয়ে নেমে অনুশীলন করতে পারছি না। উন্নতি করার কিছু জায়গা তো থাকবে নিশ্চয়ই। সেগুলো রিংয়ে ফিরেই দেখতে হবে। তবে আমার উচ্চতা আর অনেক ঝড় সহ্য করা হাঁটু দুর্বল জায়গা হতে পারে। আর আমার গতি, আত্মবিশ্বাস, প্রতিপক্ষ অনুযায়ী লড়াইয়ে বৈচিত্র আনতে পারাটা আমার শক্তি। এবং, অবশ্যই আমার মানসিক জোর। ওটাই তো আমার এক নম্বর অস্ত্র (হাসি)।
প্র: ঘরের মধ্যে থেকে কী ভাবে নিজেকে ফিট রাখছেন?
মেরি: আমার বাড়িতে একটা ছোট বাগান আছে। সেখানে খোলা আকাশের নীচে ট্রেনিং করতে পছন্দ করি। সাই (স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া) আমাকে বাড়িতেই ট্রেনিংয়ের সব উপকরণ দিয়ে দিয়েছে। আমি শক্তি, স্ট্যামিনা বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছি। আমার একটা ট্রেডমিল আছে, তাতে দৌড়চ্ছি। প্রার্থনা করছি যাতে দ্রুত সব কিছ ঠিক হয়ে যায়।
প্র: ‘ফাইটার’ মেরির দেশবাসীর উদ্দেশে কী বার্তা?
আরও পড়ুন: আইপিএল ভারতে নয় বলে হতাশ স্মিথ, আস্থা স্টোকসেই
মেরি: আসল লড়াইটা করছেন ডাক্তার, পুলিশ এবং করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে নিত্য প্রয়োজনীয় কর্মে যাঁরা সেই শুরু থেকে ব্যস্ত রয়েছেন। তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন যাতে আমরা সবাই সুস্থ থাকি। আমি এটাই বলব সকলকে যে, নিয়ম মেনে আসল যোদ্ধাদের সমর্থন করে যাওয়াটাই প্রধান লক্ষ্য হোক। আর বলব, বাড়িতে থেকে সকলেই শারীরচর্চা করুন, ফিট থাকুন।
প্র: বাড়িতে সময় কেমন কাটছে? মাদার মেরির হেঁসেলে কী চলছে? নতুন কী বিশেষ রান্না শিখলেন?
মেরি: জীবনে এই প্রথম বোধ হয় এতটা দীর্ধ সময় একটানা বাড়িতে কাটাচ্ছি। বাড়িতে আমরা একসঙ্গে গান করছি, পিয়ানো বাজাচ্ছি, বাচ্চাদের সঙ্গে হেসে-খেলে কাটাচ্ছি। ঠিকই বলেছেন, প্রচুর রান্নাও করছি। সাধারণত হাল্কা ধরনের খাবারই আমরা বাড়িতে খাই। তবে বাচ্চাদের মন রাখতে আমাকে পিৎজ়া, বার্গারও বানিয়ে দিতে হচ্ছে। আমি কিন্তু পরিবারের সঙ্গে এই সময় কাটানোটা উপভোগ করছি।
প্র: আপনার কি মনে হয়, কোভিড-১৯ অতিমারি বরাবরের মতো খেলাকে পাল্টে দিয়ে গেল? ধরুন, বক্সার হিসেবে নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে কত ফুরফুরে মনে সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। সেই ভয়ডরহীন চলাচল আর সম্ভব?
মেরি: ভাইরাসের ঢেউ এখনও শান্ত হয়নি। তাই এখনই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। খেলা এখন লাইফস্টাইলে পরিণত, তাই বিরাট কিছু অদলবদল হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, আগের সেই গতিটা খেলায় ফিরতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। আমি যদিও খুব আশাবাদী, দ্রুতই আমাদের সেই চেনা, পুরনো পৃথিবী ফিরবে। মেরি কম হয়তো বক্সিং গ্লাভস সঙ্গে নিয়ে আগের মতো খুব বেশি দিন আর সারা পৃথিবী ঘুরবে না। কিন্তু তার উত্তরসূরিরা নিশ্চয়ই ঘুরবে, বিশ্বজয়ে বেরোবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy