বিরাট কোহালির গুরুপ্রণাম। ভিআইপি গ্যালারিতে অভিনন্দন সচিনের। - শঙ্কর নাগ দাস
ইটস অ্যামেজিং!
রাত সাড়ে বারোটা এখন। ইডেনে কয়েক জন মাঠকর্মী ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ছে না। একটু আগে ক্লাবহাউস লনের সামনে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে যে হুড়োহুড়িটা চলছিল, সেটাও কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। বরং একটা তীব্র আওয়াজ এখন আসছে ভারতীয় ড্রেসিংরুমের ভেতর থেকে। একটা গান। পপ তারকা জেমের ওই গান।
শোনা গেল যুবরাজ সিংহকে নাকি সবচেয়ে উন্মত্ত, সবচেয়ে আবেগপ্রবণ দেখিয়েছে। শরীর নাচিয়ে, কোমর দুলিয়ে নিজের তো বটেই, বাকিদেরও কালঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছিলেন যুবরাজ! এমনকী টিমের বিদেশি সাপোর্ট স্টাফ, আনন্দের উদ্দামতায় ভেসে যাওয়া যুবির হাত থেকে তিনিও বাঁচতে পারেননি। হরভজন আবার যেটা পাক-বধের পর ক্রমাগত করে গেলেন, তাকে ভাংড়া বলে। সিএবি-র এক কর্তা ও সবের মধ্যে রবি শাস্ত্রীকে গিয়ে বলেন যে, এই প্রথম। ক্রিকেটের সীমিত ফর্ম্যাটে ইডেনে ভারতের পাকিস্তানকে হারানো এই প্রথম। এত দিনের কালান্তক গেরোটা ভাঙল। শুনে রবি নন, উত্তরটা নাকি দেন ধোনি। বলে দেন যে, পাকিস্তানের রেকর্ড তাঁর টিম ভাঙেনি। বরং আজ রাত থেকে নতুন রেকর্ড শুরু করেছে! বিরাট কোহালি আর একজন। হাফসেঞ্চুরির পর কর্পোরেট বক্সে বসে থাকা কার উদ্দেশ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে ‘বাও’ করেছিলেন, গোটা ক্রিকেট-পৃথিবী দেখেছে। এবং শনিবার মধ্যরাতের টিম ইন্ডিয়া ড্রেসিংরুমে যে হুঙ্কারটা তিনি দিয়ে রাখলেন বলে শোনা গেল, তা বোধহয় গোটা ক্রিকেট-পৃথিবীর আগাম জেনে রাখা উচিত।
ইডেন, ৩ এপ্রিল আমরা আবার আসছি। আসছি বিশ্বজয় করতে!
রাতের ইডেন ড্রেসিংরুম থেকে প্রাপ্ত আলোর যে বিচ্ছুরণ দেখলে, চোখে ধাঁধা লেগে যেতে পারে। অবশ্য এক দিক থেকে দেখলে শনিবারের ইডেন তো ঝাড়বাতির রোশনাইয়ের দিন। যে রোশনাইয়ের শুরু বিখ্যাত ব্যারিটোনে বিগ বি-র জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া দিয়ে, ভিভিআইপি বক্সে বসে থাকা ইমরান-সচিনের ঔজ্জ্বল্যের ছটা দিয়ে। টুকরো অন্ধকার এসেছে মহম্মদ সামির আগুনে স্পেলে। কিন্তু সে সবের উপস্থিতি থেকেছে সংক্ষিপ্ত। বরং ইডেন আজ শেষ করেছে সেই আলোরই হাত ধরে। যে আলোর সরণির শুরুতে আজ অমিতাভ থাকলে শেষে থাকলেন কোহালি।
আর জয়ের দৃশ্যপটও বড় মায়াবী। ধোনি জয়ের শটটা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, গ্যালারিতে একসঙ্গে জাতীয় পতাকা দোলাচ্ছেন অমিতাভ-সচিন। ক্লাবহাউসে কয়েক জন সোজা চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার পর তীব্র হুঙ্কার ভারত মাতা কি জয়! ‘ডি’ ব্লকের দিক থেকে তখন আবার একটা ঢাকের শব্দ অনুরণন তুলে ছড়িয়ে যাচ্ছে এক ব্লক থেকে আর ব্লকে, একে-একে গোটা ইডেনে। ক্লাবহাউস আপার টিয়ারের তলা দিয়ে দেখা গেল, রবি শাস্ত্রী দৌড়োচ্ছেন। দৌড়োচ্ছেন, বোলিং কোচ ভরত অরুণের দিকে। হার্দিক পাণ্ড্য ডাগআউটে একটাই কাজ তখন করে যাচ্ছিলেন। মুষ্টিবদ্ধ হাত পাগলের মতো ঝাঁকিয়ে যাওয়া। কোহালি বরাবরের আবেগের প্রতিভূ। তিনি যে ম্যাচ জিতিয়ে ব্যাটটা হাওয়ায় একবার ঘুরিয়ে নেবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চিরকালের অনাবেগী ভারত অধিনায়ক? মহেন্দ্র সিংহ ধোনিও রাতে নিজের মতো করে উৎসবে ডুব দিতে ব্যস্ত। সাংবাদিক সম্মেলনে বারবার হেসে ফেললেন, নাগাড়ে চালিয়ে গেলেন ঠাট্টা-ইয়ার্কি।
আসলে টিম প্রথম ম্যাচে হেরে এতটাই ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে, ম্যাচের আগে টিমের স্থানীয় ম্যানেজার সন্দীপ দাসকে কালীঘাট পর্যন্ত পাঠানো হয়েছিল বলে শোনা গেল। সেখানকার প্রসাদী ফুল মাথায় ছুঁইয়ে নাকি ভারত নামে। টিমের মাঠে নেমে যেমন নিজেদের ‘খুন্নস’ মনোভাবের পরিচয় দেওয়ার উদগ্র ইচ্ছে ছিল, ঠিক তেমনই আবার অতলে তলিয়ে যাওয়ার ভয়কেও একেবারে অবচেতন থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে ফেলা যায়নি। আর তাই ম্যাচ শেষে যুবরাজের কোমর দোলানো, কোহালির হুঙ্কার, হরভজনের ভাংড়া অবাক লাগে না। ধোনিকে দেখে অবাক লাগে না যখন তিনি বলে দেন, “আমাদের নিজেদের প্রতি বিশ্বাস আমাদের এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আমরা এ রকম অবস্থায় আগেও পড়েছি, কিন্তু ফিরেও এসেছি।” বা যখন বলেন, “ভাববেন না পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা বিশ্বকাপে ১১-০ করলাম বলে আমাদের উপর চাপ কম ছিল। লোকে কিন্তু এর পর ধরে নেবে এর পর ১২-০ হবে। না পারলেই বলবে, আরে ১২-টা করতে পারলি না? তবে হ্যাঁ, পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বকাপে ১১-০ আমার কাছে বিশাল গর্বের ব্যাপার। তবে এই রেকর্ডও একদিন না একদিন ভাঙবে। দশ বছর হোক, পনেরো বছর হোক, কুড়ি হোক, একদিন না একদিন আমরা হারব।”
দশ, পনেরো, কুড়ি! ভাবা যায়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিতে ওঠা এক ভারত অধিনায়ক যেন পরোক্ষে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন যে, আজ নয়। নিকট-আগামীতেও নয়। বহু বছর পর আমাদের বিশ্বকাপে হারানো নিয়ে ভেবো। দশ-পনেরো বছর পর ভেবো।
ইটস অ্যামেজিং!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy