অদম্য ইচ্ছেশক্তি ভর করে মানবিক শৃঙ্গারোহণের পর মাইকেল ক্লার্ক কি এ বার ক্রিকেটীয় শৃঙ্গচ্যুত হওয়ার মুখে?
পিঠের প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আবার ব্যাট করার মতো অবস্থাই ছিল না অবসৃত অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের। অন্য কোনও ম্যাচ হলে ঝুঁকি নিয়ে বাইশ গজে নেমে পড়ার প্রশ্নই নেই। যেখানে টিম বোর্ডে সাড়ে তিনশো তুলে দিয়েছে, সেখানে তো আরও ঝুঁকি নেওয়ার মানে নেই। কিন্তু ক্লার্ক বেঁকে বসেন। এটা তাঁর প্রিয় বন্ধু কাম ছোট ভাইসম ফিলের স্মৃতিবিজড়িত টেস্ট। তাঁকে অসমাপ্ত ইনিংস ফের শুরু করতেই হবে। তার জন্য যে কোনও মূল্য দিতে প্রস্তুত।
স্টিভ ওয়র বাড়িতে সাত ঘণ্টা ধরে গ্লেন ম্যাকগ্রার মুখোশ পরে আগুন নেভাতে দাঁড়িয়ে থাকার মতোই এই সহমর্মিতা। মূল্য মানে তো সকালে নেওয়া চারটে কর্টিজন ইঞ্জেকশনের যন্ত্রণাই শুধু নয়। বুধবারের অ্যাডিলেড ওভালে জীবনের আঠাশতম টেস্ট শতরানে যতই তাঁকে রাজাধিরাজ অবস্থানে বহাল রাখুক, এমন রোমান্টিক সিদ্ধান্তের মানে তো ব্রিসবেন টেস্টে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়া!
আধুনিক ক্রিকেটের যা নিয়ম তৈরি হয়েছে, চোট লুকিয়ে টেস্ট খেলা অসম্ভব। ম্যাচের মধ্যে লাগলেও আর রানার পাওয়া যায় না। বিপক্ষ খুব দয়াপরবশ হলে তবে ফিল্ডিংয়ে পরিবর্ত দিতে পারে। কিন্তু ব্রিসবেনে তো সেটাও দেবে না। বলবে আগের ম্যাচে চোট পেয়েছ তো তার সুযোগ নতুন টেস্টে তোমায় নিতে দেব কেন? ক্লার্কের পিঠের যা অবস্থা, যে কেউ হলে গাব্বার জন্য নিজেকে বাঁচিয়ে রাখত। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ব্রিসবেন। যেখানে অজিরা গত বেশ কয়েক বছর ধরে অপরাজেয়।
অন্য যে কোনও অধিনায়ক ভাবত, অ্যাডিলেডে নিরাপদ থেকে পিঠ সারিয়ে তোলার চেষ্টা করি। ব্রিসবেনে এক সপ্তাহ বাদে আরও তাজা থেকে ঝাঁপাব! কিন্তু তিনি, মাইকেল ক্লার্ক জীবনের প্রথম টেস্টে যেমন হেলমেট খুলে ব্যাগি গ্রিনে সেঞ্চুরি করতে গেছিলেন, এখানেও তেমনই রোমান্টিক চেতনাবিচ্ছিন্ন হবেন না। এই টেস্ট ক্রিকেটের হার-জয়ের সীমান্ত হিসেবে তিনি মোটেও দেখছেন না। আনুষ্ঠানিক অন্ত্যেষ্টি ম্যাক্সভিল যা করেছে, করেছে। ক্রিকেট মাঠে বন্ধুর একটা শেষ সত্কার বাকি ছিল। অদম্য সাহস আর মানসিকতায় ভর দিয়ে দ্বিতীয় দিন সেটাই সেরে ফেললেন।
হিউজের শোকগাথার মধ্যেও ক্লার্কের বাড়িয়ে দেওয়া প্রকাশ্য বন্ধুত্বের হাত নিয়ে খুব সর্বসম্মত বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না। এখনও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এমন পর্যায়ের নয় যে ক্লার্ক যা বলবেন, গোটা অজি ক্রিকেট মহল নীরবে ঘাড় নাড়বে। বরং ক্লার্কের যে কোনও মনোভাবেই ইদানীং তীব্র মেরুকরণ ঘটেছে অজি ক্রিকেটে। অনেকেই তাঁর সঙ্গে। আবার অনেকে অবিশ্বাসীর দলেও। যারা মনে করে অধিনায়কের শো যতটা, মশলা তত নেই।
ব্যথার স্টিমরোলারে গুঁড়িয়ে না গিয়ে ক্লার্কের বুধবারের প্রতিজ্ঞা নিয়ে কিন্তু কোনও মেরুকরণ নেই। মার্ক টেলর থেকে ইয়ান চ্যাপেল। শেন ওয়ার্ন থেকে ব্রেট লি— সকলে একই রকম মুগ্ধ! রাতে স্কাই নিউজেও ক্লার্কের সাহস নিয়ে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হল। যখন অ্যাঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, আজকের সিদ্ধান্তে কি ওর বিশ্বকাপ খেলা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে না? অস্ট্রেলিয়ার নামী মহিলা ক্রিকেটার-সহ অনুষ্ঠানে ক্রিকেটারদের প্যানেল এ বার ঝাঁপিয়ে পড়ল অ্যাঙ্করের ওপরে। বারবার করে এই সব প্রশ্ন কেন তুলছেন আপনারা? গত দু’সপ্তাহ ধরে বলে চলেছেন। বরঞ্চ মাইকেল যা মানবিক ছবি বারবার তুলে ধরছে সেটাকে কোলে তুলে নিন, উপভোগ করুন, তাতে আবিষ্ট হয়ে থাকুন। প্রশ্ন করবেন না। এফএম শো-র ফোন-ইনেও জনতার মোটামুটি একই রকম প্রতিক্রিয়া। কাল কী হবে পরে দেখা যাবে। আজ তোমার সাহসে অধিনায়ক, গোটা দেশ গর্বিত।
খেলার আগে চ্যানেল নাইনের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তীব্র জল্পনা চলছিল, কোন শটটা আজ ক্লার্ক মারলে তাঁর পিঠের সবচেয়ে ক্ষতি হবে? দ্রুতই সবাই একমত হল— পুল। ব্যথাটা পিঠের নীচের দিকে। পুলের জন্য অর্ধবৃত্তাকারে শরীর ঘোরা মানেই ওখানেই প্রচণ্ড লাগবে।
তা ক্লার্ক শুরুর দিকেই পুল মারলেন। ফিজিও মাঝে মাঝেই দৌড়ে আসছিলেন শুশ্রূষার জন্য। অস্বস্তি তো দেখাই যাচ্ছে। সব শটে পা যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্কোয়ার কাট মারছেন। তবু ভারতের ভাগ্য প্রায় সামনের টেরেন্স নদীর ওপর এনে দিয়েছেন তিনি আর স্টিভ স্মিথ। এক জন অস্ট্রেলিয়ার জেন ওয়াই ক্যাপ্টেন। অন্য জন ভাবি জেনারেশন জেড-এর হবু অধিনায়ক। দু’জনের ১৬৩ রানের পার্টনারশিপ চলাকালীন মাঠ আর মাঠের বাইরে অস্ট্রেলিয়ার জন্য একটাই শিউরে ওঠার উপযুক্ত ব্যাপার ঘটে। আর তা কোনও ভারতীয় বোলারের তৈরি নয়। ক্লার্ক পরিবারের।
যখন ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সেঞ্চুরি করে আসা ক্লার্ক কথা বলতে থাকেন তাঁর স্ত্রী আর বাবার সঙ্গে। চ্যানেল নাইন তা দেখাতেও শুরু করে। এমনিতে ক্লার্ক সিনিয়র মোটেও ছেলের সব ম্যাচে যান না। সিডনি থেকে এসেছেন অবশ্যই এই টেস্ট বাড়তি তাত্পর্য বহন করে বলে। ছেলের চোট নিয়ে নিশ্চয়ই গভীর দুশ্চিন্তা থেকে থাকবে। সেঞ্চুরি পূর্ণ হওয়ার কিছু পরে বৃষ্টিবিরতির মাঝে দেখা যায়, ড্রেসিংরুমের ঠিক বাইরে এঁদের সঙ্গে অজি অধিনায়ক গল্প করছেন। অথচ আইসিসি-র নিয়ম অনুযায়ী ড্রেসিংরুমের বাইরে ছবি টাঙানো নেই, এমন কোনও ব্যক্তি ওই তল্লাটে যেতে পারেন না। সে তিনি যত নিকটতমই হন। আর পাঁচটা দিন হলে ঘটনাটা নিয়ে তোলপাড় হয়ে যেতে পারত। কিন্তু এই ম্যাচের আবহ, আঙ্গিক, দৃষ্টিকোণ সবই আলাদা। আইসিসি গোয়েন্দারাও বোধহয় তাই আর উচ্চবাচ্য করেননি।
সরল গোয়েন্দাগিরি অবশ্য শুরু হওয়া উচিত ছিল, কোহলির টিমের এত মানসিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিল কেন? মানসিক সমস্যা তো দেখা যাওয়ার কথা ছিল অস্ট্রেলীয় চালচলনে। তারা মৃত্যুর ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। উল্টে ভারত এমন ভাব দেখাতে শুরু করেছে যেন ফিল হিউজ ইন্ডিয়া ক্যাপ পেয়েছিলেন, ব্যাগি গ্রিন নয়। নইলে ব্যথার যে স্টিমরোলারে ক্লার্কের চাপা পড়ার কথা, সেটাই ভারতীয় বোলিংয়ের উপর কী সহজে চাপিয়ে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ডনের দেশে ভারতীয় বোলার-ব্যাটসম্যান বলি হতে আসবে এটা যে কোনও চিট ফান্ড ব্যবসা এক দিন ধরা পড়বার মতোই স্বতঃসিদ্ধ! তা বলে আজকের মতো কদর্য চেহারায় তা কমই দেখা দিয়েছে। মেঘে ভরা অস্ট্রেলীয় আকাশ, বারবার বৃষ্টি হচ্ছে, থামছে, ভিজে উইকেট, সুইংয়ের আদর্শ পরিবেশ এ সবের নিট প্রভাব কী?
না, এক দিক থেকে কর্ণ শর্মা। আর এক দিক থেকে মুরলী বিজয়। দু’দিকে দুই স্পিনার। লর্ডসের মাঠে বছর তিনেক আগে ধোনির কিপিং গ্লাভস খুলে বল করতে যাওয়াকে ‘পৈশাচিক দৃশ্য’ বলেছিলেন কপিল দেব। বুধবারের অ্যাডিলেডকে কী বলবেন প্রসন্ন? রাহুল দ্রাবিড় অবশ্য এতটুকু উত্তেজিত হচ্ছেন না। তাঁকে অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক আওয়াজ দিতে গেছিলেন। দ্রাবিড় বললেন, “কিছু করার নেই। পেসাররা ওভার পিছু পাঁচ-ছয় রান করে দিচ্ছে। মুরলী সেখানে সবচেয়ে কম রান দিয়েছে।”
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট মহলে জোর আলোচনা চলছে মাঠে সামুদ্রিক পাখির আনাগোনা কমে যাওয়া নিয়ে। সাদা সাদা সব পাখি। উইকেটের কাছে তাদের এসে বসা একটা অনন্য চরিত্রই বরাবর দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটকে। অ্যাডিলেডেই তো পাখিগুলো সব সময় এসে বসত। এ বার তাদের দেখাই নেই। শুনলাম এমসিজি-তেও অনেক কম আসছে পাখিরা। সম্ভাব্য কারণ ক্রিকেট মাঠে স্পাইডার ক্যামের উপস্থিতি। ওই যে স্পাইডার ক্যাম ঘুরে ঘুরে গোটা মাঠের পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি তোলে, তাতেই পাখিরা ভয়ার্ত হয়ে পড়ে। ভাবে ঈগলের মতো ভীতিপ্রদ কিছু। এখুনি ছোঁ মেরে তার শিকার তুলে নেবে।
মোটামুটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা। কিন্তু ভারতীয় পেস বোলিংয়ের চোক করে যাওয়ার কী ব্যাখ্যা হয়? সামনে হাফ-ফিট ক্লার্ক। আর তার পর এই উইকেট পড়লেই টেলএন্ডারদের বিস্তৃত বাসাবাড়ি। মাথার ওপর মোটেও ফিল হিউজ নন। সুইং বোলিংয়ের উদ্যত আকাশ। যা এক্সমাসের আগেই সান্তা ক্লজের মতো অপেক্ষায়— এসো আমার কাছে উপহার নিয়ে যাও।
সান্তার উপহার নেবেন কী, বরুণ অ্যারন যে ভাবে বল করে গেলেন, তাতে মনে হচ্ছিল প্রস্তুতি ম্যাচে কি অস্ট্রেলীয়রা ইচ্ছে করেই তাঁকে অতিমানব হতে দিয়েছে? নইলে স্টিভ স্মিথ তাঁকে জংলি স্পিনারের ট্রিটমেন্ট দিলেন। যা মাঠের বাইরে যা। কী এসেছিস লোকালয়ে ক্রিকেট খেলতে। ইশান্তও মার খেলেন। শামিকে কাল শেষ বেলার ভূমিকায়ও পাওয়া গেল না। তার মধ্যে ঋদ্ধিমানের স্টাম্পিং নষ্ট করা থেকে শুরু করে আউটফিল্ডে তিন ক্যাচ পড়ার কাহিনি।
একটা টেস্ট ম্যাচ প্রায় চার ঘণ্টা বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে কোনও রকমে দু’দিন পার করেছে। তার মধ্যেই যদি মনে হতে থাকে, তিনটে বদল দলে অবশ্যম্ভাবী... ধোনি, অশ্বিন, উমেশ যাদব। তা হলে সেটাই তো সেরা এক্স রে সমন্বিত ম্যাচ রিপোর্ট। পাঠকের আর কিছু না জানলেও চলে।
হোটেলের দিকে ছোটার আগে শেন ওয়ার্ন বলে গেলেন, “কোহলি তো চার নম্বরে আসবে। ওটা তাড়াতাড়ি পড়ে গেলেই হল।” অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা ঐতিহাসিক ভাবে কোন মানসিকতায় সফরকারী দলকে ভেবে এসেছে সেটা জলজ্যান্ত। আগে সেনাপতিকে ফ্যালো। তা হলেই দেখবে অর্ধেক কাজ শেষ! এখানে অবশ্য সেনাপতি পড়ার আগেই শেষ দেখাচ্ছে।
হতাশার মাত্রা এতই নিম্নগামী যে এই অবস্থা থেকে কোনও ব্যাটসম্যান যদি প্রত্যাঘাত করতে পারে, বীরের মর্যাদা পাবে। সে টিম ইন্ডিয়া হার বাঁচাতে পারুক বা না!
অস্ট্রেলিয়া
প্রথম ইনিংস
(আগের দিন ৩৫৪-৬)
ক্লার্ক ক পূজারা বো কর্ণ ১২৮
স্মিথ ব্যাটিং ১৬২
জনসন ব্যাটিং ০
অতিরিক্ত ১৫, মোট ৫১৭-৭।
পতন: ৫০, ৮৮, ২৫৮, ৩৪৫, ৩৫২, ৩৫৪, ৫১৭।
বোলিং: শামি ২৪-২-১২০-২, অ্যারন ২৩-১-১৩৬-২,
ইশান্ত ২৭-৫-৮৫-১, কর্ণ ৩৩-১-১৪৩-২, বিজয় ১৩-৩-২৯-০।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy