বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম ভারতীয় হিসেবে সেঞ্চুরি করার পরে। দিনের শেষে জয়ও পকেটে পুরে ফেলেন কোহলিরা। ছবি: রয়টার্স
রাতের অ্যাডিলেড ওভাল থেকে মিসবা-আফ্রিদিদের অবসন্ন, ক্লান্ত চেহারাগুলো একে একে বেরোতে দেখছিলাম, খারাপই লাগছিল। মিসবা-উল-হকের এটাই শেষ ওয়ান ডে টুর্নামেন্ট। শাহিদ আফ্রিদিও যত দূর জানি, বিশ্বকাপের পর ওয়ান ডে ছেড়ে দিচ্ছে। বিশ্বকাপে ভারতকে হারানো ওদের স্বপ্নই থেকে গেল! এ বারও গাঁটটা ওরা ভাঙতে পারল না!
গাঁট! শব্দটা কাল পর্যন্ত বিশ্বাস করতাম না। মানতাম না, বিশ্বকাপে ভারতের মুখে পড়লে পাক ড্রেসিংরুমে একটা ভীতি আচমকা আসে। তবে বহু বছর পাকিস্তানে ক্রিকেট-সাংবাদিকতা করে দেখেছি, দেশের লোকে বলত এই ভীতির কথা। কিন্তু যতই ০-৫ হয়ে থাকুক, নিজের কখনও মনে হয়নি। কিন্তু রবিবার যা দেখলাম, তাতে মনে হচ্ছে, কিছু না কিছু নিশ্চিত হয়! কোনও না কোনও চাপে তো পড়ে টিমটা।
বিশ্বাস করুন, শনিবার পর্যন্ত আফ্রিদিদের দেখে মনে হয়নি মারাত্মক চাপের ফাঁস এঁটে বসেছে। আরে, বিশ্বকাপে ভারত ম্যাচ, চাপ তো থাকবেই। কিন্তু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে সেটা কাল পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু মাঠে এটা কোন পাকিস্তান টিমকে দেখলাম? এটা কি সেই টিম, যেখানে ওয়াসিম-ওয়াকার খেলত? এটা কি সেই দেশ, যেখান থেকে জাভেদ মিয়াঁদাদ-ইনজামাম উল হকের মতো ব্যাটসম্যান বেরিয়েছিল? এটা কি সেই টিম-জার্সি, যা পরে ইমরান খান ‘৯২-এ ওয়ার্ল্ড কাপ তুলেছিল?
না! একদমই না! আসলে এটা টিমই নয়! বলা ভাল, মিসবার পাকিস্তানে এগারোটা প্লেয়ার আছে। যারা নামে নিজেদের জায়গা বাঁচাতে। টিমের কথা এরা ভাবে না। ভাবে, আজ কত করলে পরের ম্যাচে আমি থেকে যাব! আপনাদের কোহলির মতো আমাদের একটাও ছেলে নেই যে কি না নিজের পরিচিত ধাঁচের খেলাটা ছেড়ে ভারত-পাক ম্যাচে শুধু শিট অ্যাঙ্করের কাজ করে যাবে। বাউন্ডারির বদলে খুচরো রানের দিকে চলে যাবে। যাতে স্কোরবোর্ড সব সময় চালু থাকে। স্রেফ টিমের জন্য। পাকিস্তানে এত ভাববেই না কেউ!
আজকের জঘন্য হারের পিছনে যেটা সবচেয়ে বড় কারণ। অ্যাডিলেডে নেমেছিল আপনাদের টিম। আমাদের নেমেছিল স্রেফ এগারো জন প্লেয়ার! যাদের কেউ টিমের অংশ নয়!
এটা ঘটনা। বিরাট আর উমর আকমল একই সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলেছিল। ২০০৭-এ। আজ বিরাট কোথায়, আকমল কোথায়! বিরাট অ্যাডিলেডে বাইশ নম্বর ওয়ান ডে সেঞ্চুরিটা করল। আকমলের সেখানে সেঞ্চুরি আজ পর্যন্ত সাকুল্যে তিনটে! ওর প্রতিভা আছে, কিন্তু মাঠে গিয়ে পারফরম্যান্স নেই। আর এক জন শোয়েব মকসুদ। প্রথম বলেই কী ভাবে না আউট হল! ক্লাব ক্রিকেটেও কেউ ও ভাবে আউট হলে তার খেলা বন্ধ হয়ে যাবে! শুনলাম, ম্যাচের পরে পাকিস্তানের কোনও কোনও টিভির দোকানে ভাঙচুর হয়েছে। দেশের সমর্থকদের দোষ দেওয়া যায় না। তিনশো তাড়া করে জেতা বিশ্বের যে কোনও মাঠেই কঠিন। বিরাট-ধবনের ইনিংস আর পরের দিকে সুরেশ রায়নার ঝড় ম্যাচের ভাগ্য কী হতে যাচ্ছে, আগেই বোঝাচ্ছিল। আর এমএস ধোনির মতো মোটেও আগ্রাসী ক্যাপ্টেন নয় মিসবা। কিন্তু হারের একটা ধরন থাকবে তো! বিশ্বকাপ ম্যাচ, অথচ একটুও লড়াই থাকবে না? আর মাঠে যদি যন্ত্রণাকে রাগে না বদলানো যায়, ম্যাচ হেরে হতাশ ভাবে স্টেডিয়াম ছাড়ারও যুক্তি নেই।
আন্দাজ করতে পারছি দেশে কী চলছে। ‘সিনিয়র হঠাও’ আওয়াজটা আবার উঠবে। লোকে বলবে, মিসবা-আফ্রিদিকে বসাও। জুনিয়রদের আনো। কিন্তু কারা জুনিয়র? উমর আকমল পাঁচ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে। আহমেদ শেহজাদেরও পাঁচ বছর হয়ে গেল। আজ ক্রিজে শেহজাদ এত সময় নিল, কিন্তু ম্যাচটা বার করতে পারল না! ঢিকির-ঢিকির ব্যাট করে টিমে টিকে থাকার খেলাটা খেলল! সিনিয়রদের গালাগাল করে লাভ নেই। আফ্রিদি-মিসবারা নিজেদের সেরা সময় ফেলে এসেছে। কাঠগড়ায় কাউকে তুলতে হলে, পাকিস্তান ক্রিকেটের সিস্টেমকে তোলা উচিত। বোর্ড কর্তাদের মনোভাবকে তোলা উচিত। প্রতিভা আমাদের দেশে কম আসে না। অনূর্ধ্ব-উনিশে প্রচুর আসে। কিন্তু হারিয়ে যায়। পরের লেভেলে ওদের ধরে রাখার চেষ্টাটাই হয় না। আর বোর্ড কর্তাদের ভয় হারলেই লোকে ছিঁড়ে ফেলবে। তাই বড় টুর্নামেন্ট মানে সঙ্গে সঙ্গে সিনিয়র। ভাবতে পারেন, সাত ফুটের মহম্মদ ইরফান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা শুরু করল একত্রিশে! আর সত্যিটা স্বীকার করা ভাল। কোহলি-রায়না-শিখরের মতো প্রতিভা আমাদের টিমে নেই। সিনিয়ররা শেষের দিকে। জুনিয়রদেরও কারও চোখ ধাঁধানো প্রতিভা নেই। আমার তো ভয়ই লাগছে। টিমটার ওয়ান ডে র্যাঙ্কিং যে ভাবে নামছে, নতুনদের পারফরম্যান্স গ্রাফের যা অবস্থা, ভয় লাগছে মিসবারা চলে গেলে কী হবে! তখন না জিম্বাবোয়ে ম্যাচ জিততেও কালঘাম ছোটে!
(লেখক পাকিস্তানের শীর্ষ স্থানীয় ক্রিকেট সাংবাদিক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy