মালায় বরণ। সোমবার শহরে ফিরলেন ডালমিয়া। ছবি: উৎপল সরকার
ভারতীয় ক্রিকেটে হালফিলের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বোর্ড নির্বাচনী ফল ঘোষণার বারো ঘণ্টা পরেও গণ বিহ্বলতা কাটেনি! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটমহল এখনও নিঃসন্দেহ হতে পারছে না, নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন রাজ কি সত্যিই শেষ? না নির্বাচনী ফল যে অঙ্কের হিসেব দিচ্ছে, সেই পাটিগণিত মেনে এখনও তাঁর শাসন অব্যাহত থেকে গেল?
ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত সবাই তাঁর লোক। কোষাধ্যক্ষও তাঁর। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর প্যানেলেরই সবাই জিতেছেন। হারিয়ে দিয়েছেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মতো হেভিওয়েট প্রার্থীকেও। টেকনিক্যালি নতুন প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়াও তো তাঁরই মনোনীত প্রার্থী। ভারতীয় বোর্ড থেকে আইসিসিতে যাওয়ার প্রয়োজনীয় ছাড়পত্রও তো শ্রীনি জোগাড় করে নিলেন এ দিন গরমাগরম। তা হলে আর রাজ শেষ হল কোথায়?
অনেকেরই প্রশ্ন জাগছে, পারথে বসে থাকা মহেন্দ্র সিংহ ধোনি তা হলে কী সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন? ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক হিসেবে তাঁর সীমাহীন বাড়তি অধিকার অক্ষুণ্ণ থেকে যাবে? নাকি ধোনির প্রস্তুত থাকা ভাল যে, এ বার থেকে শুধুই ক্রিকেটীয় দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল থাকার সাবেকি ঘরানায় ফিরতে না পারলে কোপ আসা অনিবার্য?
বহু বহু বছর আগে নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন, স্কোরবোর্ড একটি গাধা। এ বারের বোর্ড নির্বাচন স্কোরবোর্ডও সম্ভবত গাধা শ্রেণিভুক্ত! পাটিগণিতে তা যতই শ্রীনির নিরঙ্কুশ জয় সূচিত করুক, আদতে তার প্রতিটি মোড়ে বিপন্নতা। কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি যে বিপন্নতার এমন আঁধার তাঁর নিজের শহরেই শ্রীনিবাসনের ওপর নেমে আসতে পারে! বোর্ড নির্বাচনে যুযুধান দু’দলেরই প্রার্থী জিতে মিশ্র সরকার গড়া তো এর আগেও হয়েছে। ডালমিয়া আর সিন্ধিয়া এক সঙ্গে কাজ চালিয়েছিলেন। তখন তো এই প্রশ্ন ওঠেনি যে, সরকার কার? সচিবের, না প্রেসিডেন্টের?
এ বার নতুন বোর্ড সরকার গড়ার প্রথম এক ঘণ্টাতেই উঠে পড়েছে। কারণ নতুন সচিব অনুরাগ ঠাকুর টিভি সাক্ষাৎকারে তীব্র আক্রমণ করেছেন পুরনো জমানার কাজকর্মকে। আর নতুন প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া প্রথম বৈঠকেই বলেছেন, নতুন নির্বাচক কমিটি গড়া দরকার। নতুন টেকনিক্যাল কমিটির মাথা করে শ্রীনি-বিরোধী হিসেবে পরিচিত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে আনতে চেয়েছেন! দেখে-টেখে সবাই বিস্ফারিত হচ্ছেটা কী! শ্রীনি-রাজ গত কয়েক বছর ধরেই হীরক রাজার দেশের চেহারা নিয়েছে! সেখানে প্রজাদের বলা দূরে থাক, ভাবারও অধিকার নেই! ডালমিয়া শ্রীনি-সমর্থিত বোর্ড প্রধান হয়ে কী করে নিজস্ব প্যানেলের কথা ভাবছেন?
এরই মধ্যে বিকেলের বৈঠকে অনুরাগ ঠাকুর নতুন আইপিএল কাউন্সিলের সদস্যদের নাম দেখে তাতে সই করতে রাজি হননি। বলে দিয়েছেন, এটা পুরো শ্রীনির প্যানেল। আমি কেন সই করব? ডালমিয়া তখন বলেছেন, ঠিক আছে। আমরা কমিটির নাম ঘোষণার জন্য আরও ক’দিন সময় নিই। প্রথম বিদ্রোহ কড়া ভাবে দমন দূরে থাক, তা নিয়ে ভাবতে চেয়েছেন! এটাও বিস্ময় জাগিয়েছে।
এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেট অলিন্দের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রশ্ন, ডালমিয়া কি সত্যিই শ্রীনির মন রেখে সরকার চালাবেন? নাকি শ্রীনি তাঁর প্রেসিডেন্টের কাছেও আচমকা বিদ্রোহের আশঙ্কা করতে পারেন? শ্রীনি-ঘনিষ্ঠরা আশা করছেন, তিনিই চালাবেন। আর অনুরাগকে নাকি সামলে নেবেন বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর অরুণ জেটলি।
এটা মোটেও গরিষ্ঠ ধারণা নয়। গরিষ্ঠ ধারণা হল, জেটলি ফিরে এলে আরও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবেন অনুরাগ। আর ডালমিয়াই বা কোন দুঃখে বিজেপি-সেন্টিমেন্ট অগ্রাহ্য করতে যাবেন? বোর্ডের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট বলছিলেন, “কীসের শ্রীনির সমর্থনে প্রেসিডেন্ট হওয়া? শ্রীনির প্রার্থীরা তো জিতেছে এক ভোটে। ডালমিয়ার সেখানে নিজেরই তিন ভোট। ডালমিয়ার বদলে অন্য কোনও প্রার্থী দিলে ওই পোস্টটা শ্রীনি জিতত কী করে?”
শ্রীনি নিজেও তাঁর নতুন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে একশো ভাগ নিশ্চিন্ত যে হতে পারছেন না, তা তাঁর প্রতিক্রিয়াতেই বোঝা যাচ্ছে। নিজের বিশ্বস্ত বিশ্বরূপ দে-কে তিনি ডালমিয়ার সঙ্গে জুড়ে দিতে চাইছেন প্রেসিডেন্টের এগ্জিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। যিনি চব্বিশ ঘণ্টা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে থাকবেন। প্রেসিডেন্ট্স অফিস থেকে বোর্ডের অন্যদের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রাখবেন। অর্থাৎ নিজের লোককে এমন জায়গায় নিয়ে এসো, যেখান থেকে প্রেসিডেন্টকেও রিমোট কন্ট্রোল করতে সুবিধে হয়।
ক্রিকেটমহল যদিও মনে করছে, এই সর্বগ্রাসী কন্ট্রোলের শ্রীনি-মডেল সফল হবে না! প্রথমত, এ বার খোদ বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে সরাসরি তাদের ঘোষিত বিরোধী হয়ে পড়লেন শ্রীনি। এ দিন গুজরাত ক্রিকেট সংস্থার হয়ে অমিত শাহ-র পুত্র জয় শাহ ভোট দিতে এসেছিলেন। তিনি ঘোষিত ভাবেই শ্রীনি-বিরোধিতা করেছেন। আশা করা হচ্ছে শ্রীনি প্যানেলে যে দুই ভাইস প্রেসিডেন্টের বিজেপি বা আরএসএস যোগাযোগ রয়েছে, এর পর তাঁদেরও নির্দেশ দেওয়া হবে নতুন জমানার সঙ্গে চলার। পুুরনো জমানার রক্তবমিকে ধিক্কার দেওয়ার! যেমন দিচ্ছেন অনুরাগ।
সচিব হিসেবে অনুরাগের অভিষেকের দিনেই এমন কথা চাউর হয়ে গিয়েছে যে, আড়াই বছর বাদে পরের বোর্ড নির্বাচন। উত্তরাঞ্চলের টার্ম। তখন অনুরাগ প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবেন আর জয় শাহ সচিব। আজ পর্যন্ত কোনও বোর্ড নির্বাচনে জয়ী সচিব সম্পর্কে এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী দর্শনের কথা তাঁর অভিষেকের দিনেই শোনা যায়নি। বোর্ড সংবিধানে প্রেসিডেন্টের হাতেই বেশি ক্ষমতা। সচিবের কম। কিন্তু ধরে নেওয়া হচ্ছে কাজেকম্মে সচিব সংবিধানের চেয়ে বেশি গুরুত্বই পাবেন। আর প্রেসিডেন্ট তা নিয়ে আপত্তি তুলবেন না। কারণ পুরনো জমানার অনেক দর্শনের তিনি নিজেও ঘোর বিরোধী। তা মিডিয়া-নীতি হোক, ধোনি-নীতি হোক, কী আইপিএল দুর্নীতি-নীতি।
প্রাক্তন এক ভারত অধিনায়ক শোনা যাচ্ছে অনুরাগের জয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। রোববারের ফ্লাইটে গোপনে চেন্নাই উড়ে গিয়ে পূর্বাঞ্চলের এক রাজ্যের প্রতিনিধিকে তিনি অনুরাগের দিকে ঘোরান। ওই এক ভোট খুব গুরুত্বপূর্ণ চেহারা নিয়ে নেয় গোটা নির্বাচনে। কারণ মর্যাদার যুদ্ধ সচিব পদ ঘিরেই ছিল।
এই অধিনায়কের পরিচিতি নিয়ে যতই কুয়াশা জমুক, সোমবারের ফল মহেন্দ্র সিংহ ধোনির জন্য স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসবে না, জানা কথা। অনুরাগের গভীর বন্ধুত্ব যুবরাজের সঙ্গে। আর নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যানের যুবিকে টিমে নেওয়ার প্রস্তাব অতীতের মতো অগ্রাহ্য করতে পারবেন ধোনি? একাধিপত্য চলবে তাঁর?
কারও মনে হচ্ছে না। সচিব বিরোধী। প্রেসিডেন্ট কড়া এবং নিজের মতামত আছে মানে তো শ্রীনি জমানার আমও গেল! ছালাও গেল!
কলকাতায় নেমে তিনি, ডালমিয়া অভিনন্দনের ভিড়ে আত্মরক্ষা করতে ফের এয়ারপোর্ট টার্মিনালে ঢুকে গিয়েছেন। আর চেন্নাইয়ে তিনি, শ্রীনিবাসন মুখ ছোট করে বাড়ি ফেরার গাড়িতে উঠলেন! প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে নিজের মনোনীত প্রার্থীর সচিব পদে হার একেবারে বিমর্ষ করে দিয়েছে তাঁকে।
হীরকের রাজা দৃশ্যত খানখান নন। কিন্তু প্রজারা যে টানার মতো শক্ত দড়িটা এত দিনে পেয়ে গিয়েছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy