Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

পঁচাত্তরেও জীবন গড়ছেন অণিমাদেবী

কালনার কৃষ্ণদেবপুর এলাকায় এসটিকেকে রোড ঘেঁষা ১৪ কাঠা জমির উপর একতলা বাড়ি অণিমাদেবীর। ভেতরের তিনটে ঘরে ছেলেমেয়েদের রাজত্ব।

অনিমা তালুকদার। নিজস্ব চিত্র

অনিমা তালুকদার। নিজস্ব চিত্র

কেদারনাথ ভট্টচার্য 
কালনা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৯ ০৬:০৩
Share: Save:

ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়েছিল তাঁর। শাশুড়ির জেদে বই-খাতা সঙ্গ ছাড়েনি। স্কুলে শিক্ষকতাও শুরু করেন। ৭৫ বছর বয়সে পৌঁছেও ছেলেমেয়েদের জীবন গড়াই তাঁর ব্রত।

ভোরে উঠে বাড়ি-ঘর পরিষ্কার করে, রাস্তার উল্টো দিক থেকে পানীয় জল এনে, ৫০ জনের খাবার জোগাড় করে রাখেন তিনি। সকাল হতেই হাজির হয়ে যায় তাঁর ‘ছেলেমেয়েরা’। স্কুল যাওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর কাছেই পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া, আবদার চলে আদিবাসী পাড়া, জেলা পাড়ার পাঁচ থেকে পনেরো বছর বয়সীদের। স্কুল থেকে ফিরেও বাড়ি নয়, ‘মামণি’র কাছেই আসে তারা। কোনও দিন আঁকা, গান কোনও দিন আবার ক্যারাটে, খো-খো খেলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদের। ১৬ বছর ধরে এ ভাবেই চলছে অণিমা তালুকদারের ‘নগেন সুধা স্মৃতি শিক্ষা আশ্রম’।

কালনার কৃষ্ণদেবপুর এলাকায় এসটিকেকে রোড ঘেঁষা ১৪ কাঠা জমির উপর একতলা বাড়ি অণিমাদেবীর। ভেতরের তিনটে ঘরে ছেলেমেয়েদের রাজত্ব। অণিমাদেবীর সঙ্গে সেখানে পড়ান দীপ্তি মজুমদার, চন্দ্রশেখর শিকদার। ক্যারাটে শেখান দেবজ্যোতি সেন এবং খো-খোর দায়িত্বে রয়েছেন রাজীব চন্দ্র। সবাই কাজ করেন বিনা পারিশ্রমিকে। অণিমাদেবী জানান, এঁদের পাশে না পেলে এ কাজ চালিয়ে যাওয়া মুশকিল ছিল। অণিমাদেবী বলেন, ‘‘বরাবরই ইচ্ছে ছিল। অবসরের পরে পুরোদমে কাজ শুরু করি। শুধু শিক্ষা দেওয়া নয়, গরিব ছেলেমেয়েগুলোর অন্য গুণও টেনে বার করার চেষ্টা করি আমরা। যত দিন বাঁচব ওদের জন্য কাজ করব।’’ ২০১৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে নবম স্থানাধিকারী কালনার সুজিত মাতব্বরও এই আশ্রমেরই ছাত্র ছিল একসময়।

এলাকার বাসিন্দারা জানান, বাদাগাছি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে অবসর নেন অণিমাদেবী। স্বামীর মৃত্যুর পরে ২০০৩ সালে বাড়িতেই গড়ে তোলেন আশ্রম। তাঁর দুই মেয়ে সরকারি কর্মী, ছেলে ডাক্তার। প্রত্যেকেই সাধ্যমতো মায়ের পাশে দাঁড়ান। অণিমাদেবী জানান, বাংলাদেশে কর্না গ্রামে স্কুলে পড়ার সময়েই বিয়ে হয় তাঁর। কিন্তু পড়াশোনা ছাড়তে দেননি শাশুড়ি নগেন্দ্রবালা তালুকদার। তাঁর চেষ্টাতেই ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে স্কুলে পড়ান তিনি। অণিমাদেবী বলেন, ‘‘আমার শাশুড়ি বলতেন শুধু নিজের ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালালেই হবে না, ছোট শিশুদের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে শিক্ষার আলো।’’ সারা বছর ৫০-এর আশপাশে পড়ুয়া থাকে তাঁর আশ্রমে। আগে নিজেই তাদের জন্য ভাত-তরকারি রান্না করতেন। এখন শরীরের জোর কমায় কোনও দিন মুড়ি-চানাচুর, কোনও দিন মুড়ি-বাতাসা বা ডিম সেদ্ধ খাওয়ান তাদের। অভিভাবক পাপিয়া বালা, উর্মিলা বালারা বলেন, ‘‘সবাইকে নিজের সন্তানের মতোই দেখেন উনি। কেউ শৌচকর্ম করে ফেললেও পরিষ্কার করেন নির্দ্বিধায়। ছেলেমেয়েদের নিয়ে সাধ্যমতো ছোটখাট অনুষ্ঠানও করেন আশ্রমে। মহালয়ার দিন দুঃস্থ, কৃতীদের উৎসাহ দিতে পুরস্কারও দেন।’’

তবে এত বছwরেও লড়াই কমেনি তাঁর। অণিমাদেবী জানান, আশ্রম মূলত তাঁর পেনশনের টাকাতেই চলে। তার সঙ্গে কখনও পরিবারের সদস্যেরা, কখনও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী, কখনও এলাকার লোকজন সাহায্য করেন। তবে সরকারি সাহায্য তেমন পান না। এই বয়সে আর ছুটোছুটিও করতে পারেন না। অণিমাদেবীর অভিযোগ, ‘‘মাঝেমধ্যে আশ্রম চত্বরে মদের বোতল পড়ে থাকে। অন্য দুষ্কর্মও ঘটে। থানা, প্রশাসনের কাছে একাই ছুটতে হয়।’’ তাতেও অবশ্য পিছপা নন তিনি।

অণিমাদেবীর কথায়, ‘‘ওরা আমার ফুলের বাগান। মৃত্যুর আগে শুকোতে দেব না ওদের।’’ জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি দেবু টুডুরও আশ্বাস, ‘‘উনি সাহায্য চাইলে নিশ্চয় পাশে দাঁড়াব।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Anima Talukder Teaching Kalna
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy