বহন: ইটভাটার কাজে। বুধবার নারী দিবসের প্রাক্কালে সিউড়ির কাছে। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
কিছু দিন আগে এক মহিলা এসেছিলেন আমার কাছে। অভিযোগ ছিল, সরকারি উচ্চপদে কর্মরত স্বামী তাঁকে প্রতিনিয়ত মানসিক অত্যাচার করে চলেছেন। প্রথম দিকে স্বামীর সম্মানহানির কথা ভেবে অভিযোগ করেননি। যখন অভিযোগ নিয়ে এলেন, কথা বলে বুঝলাম ওই মহিলা মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছেন। পরে অবশ্য দু’পক্ষকে বসিয়ে কাউন্সেলিং করিয়ে পরিবারটি বাঁচানো গিয়েছে।
আর একটি ঘটনা বলি। এক জওয়ানের স্ত্রী-র অভিযোগ করেন, কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরেই তাঁকে বাপের বাড়িতে ফেলে দিয়ে চলে যান স্বামী। তার পরে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তখন বয়স সাত মাস। এত দিন পেরোলেও বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া দূর, একটি পয়সাও দেননি। এমনকি মেয়েকে একটা জামা পর্যন্ত কিনে দেননি স্বামী। এটা কিন্তু অত্যাচার। সমস্যা মেটানোর চেষ্টাও চলছে।
বিষয় হল যতই বলা হোক মেয়েদের অধিকার ছেলেদের সমান, বাস্তবে এখনও মেয়েদের নিজেদের কোনও বাড়ি নেই, পরিচয়ও নেই। না বাপের বাড়ি, না শ্বশুরবাড়ি— কোনওটাই এক জন মেয়ের নিজস্ব বাড়ি নয়। বিয়ের আগে বলা হয় এটা তার নিজের বাড়ি নয়। আর বিয়ের পরে শুনতে হয়, বাপের বাড়িতে যা করে এসেছে তা এখানে চলবে না। আসলে বাড়িতেও নিরাপদ নয় মেয়েরা। ছোটবেলা থেকে মেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তারা এক ধাপ পিছিয়ে। মেয়েদের সব সময় এক জন অভিভাবকের প্রয়োজন। বাবা, স্বামী এমনকি স্বামীর অবর্তমানে ছেলেই অভিভাবক। যে ছেলেকে জন্ম দিলেন, সেই ছেলে মায়ের অভিভাবক। মেয়েদের মানসিক এই দুর্বলতার জন্য আমাদের দেশ-রাজ্য-জেলায় মহিলাদের উপরে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন চলে।
বধূ নির্যাতনের আইন থাকায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া গিয়েছে। কিন্তু, এক জন মহিলা তো শুধু বধূ নন, তিনি মেয়ে, মা, বোন-মাসি-পিসি বা অন্য নানা সম্পর্কে রয়েছেন। তিনি স্বামী, শ্বশুর ছাড়াও বাবা-ভাই, ছেলে বা অন্য কোনও আত্মীয়ের হাতে নির্যাতিত হতে পারেন। তাঁদের অধিকার রক্ষার গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধ আইন ২০০৫, এ রয়েছে। যা এক জন মহিলাকে সুরক্ষা দিতে পারে। কোনও মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হলে কোথায়, কী ভাবে অভিযোগ জানাবেন, সেটা নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই অনেকের।
কোনও মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হলে সরাসরি বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট অথবা সরাসরি জেলা মহিলা সুরক্ষা আধিকারিককে জানাবেন। তবে মহিলা সুরক্ষা আধিকারিককে অভিযোগ জানানোর আগে থানায় একটি জেনারেল ডায়েরি করা উচিত। যিনি অভিযোগ জানাবেন, তা চারটি সূচকের আওতাভুক্ত হতে হবে। এক, তাঁকে ১৮ উত্তীর্ণা হতে হবে। দুই, মূলত যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবেন তাঁকে ১৮ উত্তীর্ণ পুরুষ হতে হবে। বাকি অভিযুক্তরা অন্য যে কেউ হতে পারেন। তিন, এক ছাদের তলায় বসবাসকারী হতে হবে।
প্রশ্ন হতে পারে, দূরে থাকা কোনও আত্মীয় কি এক জন মহিলার উপরে নির্যাতন করতে পারেন না? উত্তর হল পারে। কিন্তু ঘটনার সময়ে সেই আত্মীয় বা আত্মীয়াকে ওই বাড়িতে উপস্থিত থাকতে হবে। এ ছাড়া ফোনে উস্কানি বা মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ থাকলে তার প্রমাণ দেখাতে হবে। চার, অভিযাগকারিণীর সঙ্গে অভিযুক্ত বা অভিযুক্তদের সম্পর্ক থাকতে হবে। হয় জন্মসূত্রে বা বৈবাহিক সূত্রে, অথবা অন্য সম্পর্কে (যেমন লিভ-ইন)।
কোনটা গার্হস্থ্য হিংসা? একে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক শারীরিক, দুই মানসিক নির্যাতন। মানসিক নির্যাতন আবার তিন রকমের। মৌখিক বা ভার্বল হেনস্থা, যৌন হেনস্থা, অর্থনৈতিক নির্যাতন। ধরা যাক, কোনও পুরুষ স্ত্রীকে বললেন, আমার মা অনেক ভাল রান্না করেন। এটা এক দিন বললে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু প্রতিনিয়ত যদি এ কথা শুনতে হয় তা হলে সেটা নির্যাতন। তার বাইরে যেমন, তোমার চুল ভাল না, গায়ের রং কালো, ‘তোমাকে বিয়ে করে আমার জীবন নরক’ হয়ে গিয়েছে। ওমুক জায়গায় বিয়ে করলে বেশি পণ পেতাম, সেটা অবশ্যই নির্যাতন।
যৌন হেনস্থার দ্বিতীয়টা বিয়ে অথবা লিভ-ইন সম্পর্কের মধ্যে হয়ে থাকে। প্রথমেই বলি, ভারতীয় মহিলাদের অধিকাংশ জানেন না বা মানেন না, যৌন চাহিদাও অতি সাধারণ ব্যাপার। সেখানে তারও মতামত থাকবে। কিন্তু সচেতনতা না থাকায় ইচ্ছের বিরুদ্ধে, মতের বিরুদ্ধে তাঁকে অস্বাভাবিক যৌনতায় বাধ্য করা হলে সেটাও নির্যাতন। তৃতীয়টা হল, অর্থনৈতিক অত্যাচার। অধিকাংশ পুরুষ কত টাকা আয় করেন, সেটাই স্ত্রীকে জানান না। কিন্তু সব কিছু জানা যে স্ত্রী-র অধিকারের মধ্যে পড়ে সেটাই এড়িয়ে যান। সত্যিটা না জানার জন্য সমস্যায় পড়তে হয় স্ত্রীকে।
প্রথমে যখন গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ নিয়ে কেউ আসেন সেটা ফৌজদারি মামলা নয়। তখন সেটা মেটানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু, আদালত থেকে প্রোটেকশন অর্ডার নিয়ে বাড়িতে ঢোকার পরেও যদি ফের যদি ওই মহিলা অত্যাচারিত হন, তখন এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা এক বছরের।
নারী দিবসে একটা কথাই বলব, মেয়েরা আগে নিজে-নিজেকে চিনুন। মেয়ে বা ছেলে এই বিভেদে না গিয়ে প্রথমে এক জন মানুষ বলে ভাবলেই সমস্যা কমে। আমাদের দায়িত্ব বোঝানো। মেয়েটির যেমন কিছু দায়িত্ব বা কর্তব্য রয়েছে, তেমন মেয়ে বা স্ত্রীর প্রতি এক জন পুরুষের কিছু কর্তব্য রয়েছে। আসলে ঠিক মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য যে ‘গ্রুমিং’ প্রয়োজন, সেখানেই ফাঁক থেকে যাচ্ছে।
লেখক: বীরভূম জেলা মহিলা সুরক্ষা আধিকারিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy