‘প্যাডম্যান’ সিনেমাটা এসে ভারতের ঘরে ঘরে ‘কুসংস্কার’-এর কথা, অচ্ছুত-নারীযাপন-সময়ের কথা জানিয়েছে।
যা-ই বলুন, মেয়েরা অজাত-কুজাত। না হলে, যত খারাপ খারাপ জিনিস কি ওদের সঙ্গেই হয়? ফ্রক তুলে নির্যাতন কার হয়? শিশুকন্যার। ধর্ষণ কাদের হয়? মেয়েদের। স্তন কাদের থাকে? মেয়েদের। উত্তেজনা ছড়ায় কারা? মেয়েরা। ছোট পোশাক পরে কে? মেয়েরা। বিয়ের আগে গর্ভবতী হয় কারা? মেয়েরা। বিয়ের আগে বা পরে গর্ভপাত করায় কে? মেয়েরাই তো। ইজ্জত কার যায়? মেয়েদের। এমনকী ঋতুস্রাব কাদের হয়? মেয়েদের। অতএব নষ্টের মূল কারা? মেয়েরা, আবার কারা?
এত দোষে যেন কুলোচ্ছিল না, মেয়েরা আরও বেহায়া হয়ে গিয়েছে। একেবারে ঋতুস্রাব নিয়ে খোলাখুলি কথা, খোলাখুলি আলোচনা করছে! যা তোদের লুকিয়ে রাখার কথা, যে কথা শুনলে কান অবধি গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে নেওয়ার কথা, সে বিষয়ে জিভ দিয়ে আলোচনা করছিস! জানিস না জিভে সরস্বতীর বাস (তিনি দেবতা-মেয়ে, বোধ হয় ঋতুমতী হন না)। শুধু কি তাই? এত দিন না হয় এনজিও, স্বাস্থ্যকর্মীরা গুনগুন করে ঋতুস্রাবকালীন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করছিল। এতেই ক্ষান্ত না থেকে এ বার ঘরের মা-বোনেদের একেবারে অধঃপাতে পাঠানোর জন্য একটা আস্ত পপুলার হিন্দি সিনেমা পর্যন্ত হয়ে গেল! যেগুলো আগুনখেকো নারীবাদী সেগুলো বহু আগেই কুপথে গেছে, এখন শান্ত-সুশীলা, শত চড়েও রা না কাটা, গাভীর ন্যায় আজ্ঞাপালনকারী মেয়ে-বউ ছিল যারা, তাদেরও চরিত্র গেল। বলে কি না, ‘প্যাডম্যান’ দেখতে যাব, নারী-স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানব, নিজেদের যত্ন নেব। কী চোপা!
অবশ্য জানা গিয়েছে, একটা পুরুষই নষ্টের গোড়া। অরুণাচলম মুরুগনন্তম। বাড়ি তামিলনাড়ুর কোয়ম্বত্তূরে। ২০০৪ সালে বিয়ের পর আবিষ্কার করেন, বউ ঋতুস্রাবের সময় ময়লা কাপড় ও কাগজ জড়ো করছেন। তখনই তাঁর মাথায় ঢোকে যে এই অস্বাস্থ্যকর জিনিসটা বন্ধ করতে হবে। নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষার পর তিনি তাঁর স্যানিটারি প্যা়ড তৈরির যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন, যা খুব কম খরচে পরিস্রুত, স্বাস্থ্যকর প্যাড তৈরি করতে পারে। এ নিয়ে তাঁকে কম ছিছিক্কার শুনতে হয়নি। এমনকী, প্রথম দিকে তাঁর স্ত্রী ও বোন ‘মেয়েদের সমস্যা’য় পুরুষ কেন— এই যুক্তিতে পরীক্ষানিরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। প্যাড তৈরির খুঁটিনাটি সম্পর্কে জ্ঞান বাড়িয়েই গিয়েছেন। কী করলে কম খরচায় কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভাবে প্যাড তৈরি করা যায়, সেই বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এবং শেষে ঠিকঠাক প্যাড তৈরি করে ক্ষান্ত হয়েছেন। তাঁর প্যাড তৈরির যন্ত্রের খরচও বেশ কম। এখন অবধি ২৩টি রাজ্যে তাঁর এই মেশিন বসানো হয়েছে। তাঁর অনুপ্রেরণায় উৎসাহী হয়ে আরও অনেক ছোট ব্যবসায়ী এই ব্যবসায় এসেছেন। তিনি বিভিন্ন আইআইটি’তে, টেড টক-এ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন, তাঁর আবিষ্কারের কথা জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: আমি মনে করি, নারী আগে, পুরুষ তার পরে
মুশকিল হল, এত দিন তাঁর এই সচেতনতা যাত্রাই বলুন কিংবা তা নিয়ে ছিছিক্কারের কথাই বলুন, তার সবটাই একটা গণ্ডির মধ্যে ছিল, এই ভাবে অলিতেগলিতে পুকুরঘাটে আধুনিক মলে ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু আজ হঠাৎ প্যাডম্যান সিনেমাটা এসে ভারতের ঘরে ঘরে এই ‘কুসংস্কার’-এর কথা, অচ্ছুত-নারীযাপন-সময়ের কথা জানিয়ে দিয়েছে। আর তাই এমন শোরগোল, এমন গেল গেল রব।
অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
এই সিনেমা ঋতুস্রাব নিয়ে কুসংস্কারের ভুল ধারণাটা ভাঙতে পেরেছে কি না, সেটা বড় কথা নয়। অন্তত মেয়েদের নিয়মিত ঋতুস্রাব হয় এবং সেটা লুকিয়ে রাখার নয়, তার জন্য লজ্জার কিছু নেই— এই সরল কথাটা কোটি কোটি মানুষের সামনে নির্দ্বিধায় তুলে ধরা গিয়েছে। এই রকম একটা ধাক্কার বোধ হয় দরকার আরও অনেক আগে ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। এখন যে হল, এটাই বা কম কীসের?
আরও পড়ুন: এখনও এ সমাজে মেয়েরা শুধুই ‘মেয়ে’!
অনেকেই বলবেন সিনেমাটা ভাল নয়। ভাল হয়নি। এত সহজে, এত তাড়াতাড়ি জলের মতো আন্দোলন হয় না কি, আর তার সমাধানই বা কী করে হয়। কথাটা হয়তো খাঁটি। কিন্তু বাস্তব জীবনে যেখানে পিরিয়ড নিয়ে কথা বলাটাই এখনও ‘লজ্জার’, ‘লুকিয়ে রাখার’ ব্যাপার, সেখানে আস্ত একখানা সিনেমা বানিয়ে কোটি কোটি মানুষের সামনে তুলে ধরার একটা মানে আছে বইকী। যেখানে আধুনিক শহরের দোকানেও প্যাড কিনতে গেলে কালো প্যাকেটে মুড়ে দেওয়া হয়, যেন কী না কী দোষ হয়েছে এই জৈব-প্রক্রিয়ায়, কিংবা প্রক্রিয়াটা যেন কী লজ্জার কী লজ্জার— এমন একটা ভাব দেখানো হয়, সেখানে এ রকম একটা সিনেমাও খুব দরকারি। সিনেমার শৈল্পিক সত্তা মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে কি না জানা নেই, কিন্তু সিনেমার বিষয়বস্তু বন্যার জলের মতো না-চাইতেই শহর থেকে গ্রামে-গঞ্জে, পিতৃতন্ত্রের দরজা ভেঙেই হোক কিংবা তিরতিরিয়েই হোক, ঢুকে পড়েছে। এখন আর ব্যাপারটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কেউ উচ্চারণ না করতে চাইলেও, এমনকী গালাগালি দিতে গেলেও মেয়েদের ঋতুস্রাবকালীন স্বাস্থ্যের কথা এসে পড়ছে। মৌনী থাকা যাচ্ছে না আর। অক্ষয়কুমার তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অনেক পুরুষ তাঁদের বাড়ির মেয়েদের এই সিনেমা দেখতে যেতে দিচ্ছেন না। তার কিন্তু অন্য একটা মানে আছে— পুরুষটি এবং বাড়ির মেয়েরাও সম্ভবত জানছেন সিনেমার বিষয়বস্তু কী, এবং সেই জন্য দেখতে যেতে দিচ্ছেন না। অর্থাৎ, না চেয়েও বিষয়টি সম্পর্কে তাঁদের অন্তত ওয়াকিবহাল হতেই হচ্ছে। পপুলার কালচারের এটাই তো সুবিধে। সেটা সদর্থক ভাবে ব্যবহার করা গেলে অনেক দূর অবধি পৌঁছে যাওয়া যায়। সিনেমার দৌলতে কেউ কেউ হয়তো সদিচ্ছায় এই বিষয়টিকে গ্রহণ করছেন, কেউ অক্ষয়কুমারের ফ্যান বলে, কেউ বা সামাজিক পরিবর্তনের একটা অঙ্গ হিসেবে, আবার কেউ বউকে ভালবেসে মেনে নিচ্ছেন, কথা বলছেন, ট্যাবু ভাঙছেন।
কেউ কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করবেন, এর ফলে সত্যিকারের পরিবর্তন কতটুকু হবে? বিরাট পরিবর্তন যে এখনই আসবে না, তা হলফ করে বলা যায়। কিন্তু ছোট ছোট পরিবর্তন আসবে না, মানুষ একটুও সচেতন হবে না, এটা কি হলফ করে বলা যায়? আর এটা তো মানতে হবে, একটা পপুলার হিন্দি সিনেমা মানুষের মনে যে ভাবে চারিয়ে যেতে পারে, একটা বা কয়েকটা গোষ্ঠীর আন্দোলন তা পারে না। বিশেষত, মেয়েদের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য যে কত লড়াই করতে হয়, বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষের কাছে, এমনকী দাবির জন্য লড়াই করা ‘অশিক্ষিত’ মানুষের কাছেও সেটা স্পষ্ট। এই সিনেমাটি অন্তত সেই কথা বলার জায়গাটুকু করে দিয়েছে। হতেই পারে যে এই সিনেমা নিয়ে কথা বলার সময় পাঁচ জন লজ্জা পাবে, কিন্তু ষষ্ঠ জন তো খোলা মনে কথা বলতেও পারে, সাহায্য চাইতেও পারে, নিজের অবস্থান বদলাতে ইচ্ছুক হতেই পারে।
একটা নারী দিবসে নারীর অবস্থান বদলায় না, তার জন্য অনেক অনেক বছর লড়াই করতে হয়, কিন্তু দিনটাকে মনে রেখে লড়াইটা চালিয়ে যেতে হয়। একটা ‘প্যাডম্যান’ সিনেমাতেও হঠাৎ সব কিছু বদলে যাবে না। কিন্তু সিনেমাটাকে মনে রেখে কথাবার্তা, আলোচনা হয়তো শুরু করা যাবে। যেটা আগে সম্ভব ছিল না। এখন হয়তো বা সম্ভব হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy