অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী
বছর পনেরো আগে আমাকে একগুচ্ছ অর্কিড পাঠিয়েছিল কেউ ৮ মার্চের সকালে। সম্ভবত মেয়েদের জন্য কাজ করে এমন এক সংস্থার পক্ষ থেকে। দরজা খুলেছিলাম, এক হাতে মেয়ের এক পাটি মোজা, অন্য হাতে কলম। কী ভাবে ফুলগুলি নেব বুঝতে কয়েক মুহূর্ত লেগেছিল। আমাকে কেনই বা কেউ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ফুল পাঠাবে? কী আমার কৃতিত্ব? আমি তো কখনও মিছিলে হাঁটিনি মেয়েদের অধিকারের দাবিতে, কাজ করিনি গ্রামে গঞ্জে থেকে মেয়েদের জন্য। আমার কাজ অফিসে বসে কাগজে কলমে, তবে পথের ধুলো কাদা যে মাখিনি তা নয়। ওই কয়েক মুহূর্তের খোলা জানালা দিয়ে শীতল বাতাস এসে যেন আমার কপাল স্পর্শ করল। আমাকে মনে করাল দীর্ঘ পথ হাঁটার ক্লান্তি, স্কুলবেলার রাস্তা পেরনো থেকে আরম্ভ করে বরানগরে অর্থনীতি বিভাগে পৌঁছনোর দীর্ঘ বাস যাত্রা, তুফান এক্সপ্রেসে দিল্লি পৌঁছনোর পর বিহার, ঝাড়খণ্ড, বাংলা, ওডিশা, মহারাষ্ট্রের নানান রঙা মাটির কাছে গিয়ে পৌঁছনো রোদে, শীতে, জল-ঝড়ে...।
মনে পড়ল, আমাদের কত দিন কেউ বলে না, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ, এ বার একটু ব’সো! বলে না, অনেক রাত জাগা হল, এ বার ঘুমোও। অনেক বোঝা বওয়া হল, এ বার ভার নামাও পথের ধারে তৃণভূমিতে। তাই বহু শত বছরের, বহু যোজনের, অনেক ভার বহনের ক্লান্তি জমে জমে ফসিল হয়ে গেছে আমাদের রক্তে, অস্থিতে, মজ্জায়...।
মনে পড়ল, আমি একা নই, প্রত্যহ এবং যে কোনও নারীদিবসে, আমরা বহু প্রজন্ম ও বহু জন মিলে একটি দীর্ঘ সময়ও মানবী শৃঙ্খল। অদৃশ্য হাতের ধরাধরিতে তৈরি করেছি সময়ের সমুদ্রে একটি সুরক্ষা বলয়। বহু দিন, পথ ও সংসার ব্যাপী আমাদের এই আত্মীয়তা এই কমরেডশিপের নাম নারীদিবস। এ দিন কোনও নিমজ্জিত হিমশৈলের শৃঙ্গ নয়। একটি সম্মিলিত অস্তিত্বের আত্মপ্রকাশ।
জ্বলন্ত চিতা থেকে পালিয়ে যে সদ্যবিধবা যুবতী আশ্রয় নিয়েছিল গ্রামান্তরের আটচালায়, আমার পিতামহী যিনি মাঘের শীতে সারারাত জাগতেন বারোটি সম্তানকে প্রদীপ দেখিয়ে বাইরে নিয়ে যেতেন, তেষ্টার বাতাসা-জল দিতে, আবার ভোরের কুয়াশা জড়ানো পুষ্করিণীর ঘাটলায় এসে বসতেন গত রাতের পাঁজা পাঁজা এঁটো বাসন নিয়ে। আমার কত মাতামহী যাঁরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারিণী ছিলেন না বলে সন্তানের জন্ম দিতে দিতে উপুড় হয়ে পড়েছেন নিজস্ব জরায়ুর রক্ত প্রবাহের উপর, আমার মা, যিনি সঞ্চয়িতা উল্টে বিছানায় রেখে কলতলায় ছুটেছেন অফিসবেলার মৌরলা মাছ বাছতে, এঁরাই কি আমার জন্য পাঠালেন এই স্বর্গীয় অর্কিড গুচ্ছ?
আরও পড়ুন, তবুও বাঁচে দুর্গা, বুকে হাত দিলে কামড়ে দেয়
না, না কেবল তাঁরা তো নন— ওই তো কিছু দূরে যেন ব্যারিকেডের ওপারে দাঁড়িয়ে হাসছে আমার শৈশবের পরিচারিকা নীরদা মাসি, খুব যত্ন করে আমাকে ভাত খাওয়াতো সে, তার নিজের ভাতের খিদে কিছুতেই মেটাতে পারেনি বলে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিল, ওই তো রুক্ষ্ম চুলে ময়লা কাপড় পরা শান্তির মা, হাতে হাজা, জল ন্যাতা দিয়ে আমাদের হাজরা রোডের বাড়ির লাল মেঝে মুছছে, বিড়বিড় করে বকছে, হাত ধুচ্ছে বার বার, ওই তো দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আয়ামাসিরা, যারা আট বছর ধরে মায়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমার জীর্ণ, কাঠের মতো শক্ত, সংবেদনহীন বাবাকে উঠিয়ে বসিয়েছে, স্নান করিয়েছে, জামা পাল্টে দিয়েছে, ভাত খাইয়ে দিয়েছে, ওই তো আদিবাসী যুবতী সরোজিনী, যে আমার সন্তানদের যত্ন নিয়েছে ধুলো উড়িয়ে জিপ নিয়ে আমি পথে বার হয়ে গেলে, ওই তো বৃহস্পতি, ববিতা, কেতকী, নীতু— কলকাতা, বম্বে, দিল্লির মেয়েরা যাঁদের হাতের উপর উথলে পড়েছে আমার উনুনের দুধের ফেনা, আমাদের কাপড় কাচতে কাচতে বাসন মাজতে মাজতে যাঁদের যৌবন গিয়েছে, গতরও, আমাদের তুলে রাখা বাসি রুটি তরকারি আর ফোটানো চায়ের পর একখানা জিলিপি কিংবা সন্দেশ পেলে যাঁদের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়, এরা সবাই মিলে আমার জন্য, আমাদের জন্য মোটা ছুঁচে, পাড়ের সুতোয় বুনে রেখেছে বড় একখানি কাঁথা, বলেছে আহা বৌদি, ওগো ম্যাডাম, একটু বসেন, একটু জিরিয়ে নেন—
মা তো আর নেই, তবু রবিবার সকালে কানের কাছে ঝন্ঝনিয়ে ওঠে আমাদের শ্যামারানির গলা, কলকাতার বাড়ি থেকে সে আমাকে ফোন করছে বম্বেতে— কী গো, ওষুধ-বিষুধগুলো খাচ্ছ তো নাকি, শরীরের উপর একটু দয়ামায়া করো এ বার...।
আরও পড়ুন, এখনও এ সমাজে মেয়েরা শুধুই ‘মেয়ে’!
‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতার মতো এরা সবাই কিন্তু বাঁচতে চেয়েছে, বাঁচাতে চেয়েছে নিজেদের বাপ মা সন্তানদের। মাতাল বরের লাথি ঝাঁটা খেতে খেতেও রাস্তা ছাড়েনি, বেস্পতি তার মা মরা নাতনিকে নিয়ে গিয়ে বসাত পাড়ার ড্রয়িং কম্পিটিশনে, নীতু তার ছেলের ভর্তির ফর্ম নিয়ে স্কুলের গেটে তাড়া খায়নি হেন দারোয়ান নেই দিল্লিতে, শ্যামা বলে, মাটিতে শুই কি সাধে, মেয়েটার পরীক্ষার ফি কোত্থেকে আসবে, যদি এখন তোষক কিনে ফেলি একখানা, সরোজিনী তার বুড়ি মায়ের গাঁয়ে যায় বাস ধরে, সঙ্গে চারটি মুরগির ডিম, একটা কাঁঠাল, ওদের গাছের...তোমাদের সবাইকে যদি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একখানা করে গাঁদা ফুল দিই, কিংবা গোলাপ, বাগান উজাড় হয়ে যাবে গো!
নাকি আমার নজরের দোষ হল, আমি মেয়েদের ছাড়া আজ কাউকে দেখতেই পাচ্ছি না দু চোখে? না, তা তো নয়। আমি খড়ির গণ্ডি টানার খেলায় বসিনি। মরমী পুরুষরা সঙ্গে না থাকলে, আড়ালে, আবডালে কিংবা অনেকটা এগিয়ে, এতটা পথ কি হাঁটা হত আমাদের?
কিন্তু না, আজ আর সেই আমরা-ওরার দিন নয়, দিন নয় বেড়া বাঁধার কিংবা খড়ির দাগ মোছারও। আজ আমাদের দিন। সংহতির দিন। এ ওকে কমরেড বলে কপালে আবির দেওয়ার দিন। এ ওর জন্য শীতল পাটি, কাঁথা পেতে দিয়ে এক ঘটি জল এগিয়ে দেওয়ার দিন। এ দিন আমাদের আত্ম আবিষ্কারের, আত্ম উন্মোচনের, আত্ম প্রতিষ্ঠার।
আরও পড়ুন, আমি মনে করি, নারী আগে, পুরুষ তার পরে
মনে পড়ে সুদূর কোরাপুটের পরজা রমণীকে, সুমনী ঝোড়িয়া, যে আমাকে বকে দিয়ে বলেছিল, পদবী বলছ কেন, বাপ-মায়ে নাম দেয়নি তোমার? মনে পড়ে সুন্দরগড়ের দুই সন্তান হারানো সেই যুবতীকে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে যার গর্ভ বন্ধ করে সেলাই করে দিয়েছিল টার্গেট উল্লাসি মেডিক্যাল মাফিয়া, সেই বুধবারী ওঁরাও আমাকে এসে বলছে, আমার পেটের বাঁধনটা খুলে দেবে গো? মা হতে সাধ যায় আমার! সেই যে আমার গল্পের বনমালা, চাষের জল আসবে বলে বাঁধের জন্য বাড়ি জমি খুইয়ে যে আজ টিনের ছাউনি দেওয়া কলোনিতে গিয়ে উঠেছে, কিন্তু জল আসেনি!
না গো সুমনী, বুধবারী, বনমালা, আমি নিজের পরিচয় জানি না। আমি তাই তোমাদের দিকে বাড়াতে পারিনি আমার বন্ধুত্বের হাত। বরং তোমাদের রক্তের ঘ্রাণে, তোমাদের উচ্ছিন্ন ভিটেমাটির ধুলিতে রঞ্জিত হয়ে গেছে আমার আঙুলগুলি।
তোমাদের কাছে ক্ষমা চাই আমি, আন্তর্জাতিক নারীদিবসে, তোমাদের কথা লিখি- যদি নিমজ্জিত সভ্যতার প্রত্ন আবিষ্কার হয় সহস্র সহস্র বছর পরে, তবে কেউ যেন পড়ে আমার মার্জনা ভিক্ষার শিলালিপি। হে নারীজন্ম, কেবল অনিচ্ছুক গর্ভদানে তোমাকে কলঙ্কিত, সমর্পণযোগ্য করা যায় বলে, কত নিগ্রহ সইলে তুমি ঘরে, পথে, রাজপুরুষের কাঠগড়ায়, তোমাকে ধর্ষণ, ভক্ষণ করার পরও সময় শরীরে গেঁথে দিয়ে গেল লোহা, কাচ, বাঁশ, কত বার বিক্রয় হলে তুমি, কত বার ক্রীতা, কত সন্তান লালন করলে, কত জল ভরণে গেলে, কত কাঠ, মধু, ফুল, ফল নিয়ে এলে বন পাহাড় থেকে, পুরুষকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বদনাম হ’লে বস্তারে, খালপাড়ে, নন্দীগ্রামে। ও আমার মা বোন দিদি মেয়ে পূর্বজ নারীরা, দয়া নয়, পূজা নয়, করুণা নয়।
আরও পড়ুন, ঋতুস্রাব লুকিয়ে রাখার নয়, লজ্জারও কিছু নেই
আজ আমাদের নিজেদের একান্ত আপনার দিনে আমি তোমাদের হাত ধরি, এ দিন অক্ষয় হয়ে দিগন্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাক, আমার হৃদয় সঞ্জাত অর্কিডগুচ্ছ তোমাদের দিই, তোমরা কলসি রেখে, কাস্তে নামিয়ে, বাসনের পাঁজা পাশে সরিয়ে, এ ফুলের স্তুতি গ্রহণ করো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy