উপাখ্যান: বিশ্বকাপ ফাইনালে গোলের পরে চেনা ভঙ্গিতে মেগান র্যাপিনো।—ছবি রয়টার্স।
টানটান উত্তেজনায় তখন আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে প্রায় গোটা স্টেডিয়াম। রেফারির বাঁশি বলল, পেনাল্টি। অমনি বেগুনি-ছোপ চুলের মেয়েটা সটান এগিয়ে এল পেনাল্টি বক্সে। মহিলা বিশ্বকাপ ফাইনালের দ্বিতীয়ার্ধ। ডাচ গোলরক্ষককে দাঁড় করিয়ে রেখে মাপা শট। ১-০ গোলে টিম ইউএসএ-কে এগিয়ে দিলেন চৌত্রিশ বছরের নির্ভীক, আত্মবিশ্বাসী এবং বুদ্ধিদীপ্ত ক্যাপ্টেন মেগান র্যাপিনো। ছবির দেশ, কবিতার দেশ ফ্রান্সের মাটিতে খেলা। আর আমি টিভির পর্দায় চোখ রেখেই ইতিহাস তৈরি হতে দেখলাম।
বাকি ম্যাজিক এল আরও আট মিনিট পরে। রোজ় লাভেলের বাঁ পায়ের গোলে। ২-০ গোলে প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে চতুর্থ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হল মার্কিন মহিলা ফুটবল টিম। ফুটবল ভক্ত হিসেবে এমন টানটান ম্যাচ ও প্রিয় দলকে জিততে দেখার আনন্দ এর আগেও ঢের পেয়েছি। কিন্তু এই জয়ের আবেগ সম্পূর্ণ অন্য রকমের। এই জয় শুধু মার্কিন ফুটবলের নয়, এই জয় লিঙ্গ-সাম্যেরও। যে লড়াইটা দীর্ঘদিন ধরে লড়ে আসছেন মেগান ও তাঁর মেয়েরা।
মেয়েদের জয় দেখলাম, দেখলাম অভিনব উদ্যাপনও। কারও ভঙ্গিতে ‘চায়ের কাপে চুমুক’, তো কেউ সটান দাঁড়িয়ে রইলেন দু’হাত বাড়িয়ে। অনেকেই বলছেন, এ-সব বাড়াবাড়ি। দম্ভের প্রকাশ। আমার মনে পড়ে গেল, সেমিফাইনালের আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া সেই মিমের কথা। হোয়াইট হাউস চত্বরে নিজ-নিজ ভঙ্গিমায় পরস্পরের মুখোমুখি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মেগান র্যাপিনো। মাঠের বাইরে ‘চলমান প্রতিবাদ’ মেগানের নিজস্ব লড়াইও তো ছিল! সে কথায় পরে আসছি।
অন্যান্য শিল্প বা খেলাধুলোর মতো ফুটবলেও ‘সিস্টেম্যাটিক ওয়েজ ডিসক্রিমিনেশন’ রয়েছে এখানে। মার্কিন মহিলা দল সমসাময়িক পুরুষ দলের চেয়ে শুধু গড় বেতনের প্রাথমিক স্তরেই প্রায় ৩০,০০০ ডলার কম রোজগার করেন। বোনাসে ফারাকটা আরও বেশি। অথচ এই পুরুষ দল কিন্তু প্রথম ষোলোর মধ্যেও নেই! টিভি রেটিং দিয়ে বিচার করলেও চার বছর ধরে জনপ্রিয়তার নিরিখেও এগিয়ে মহিলা দল। তাই এই বেতন বৈষম্যের বিরুদ্ধে জমছিল ক্ষোভ। মাঠের লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে-নিতেই গত মার্চে প্রাতিষ্ঠানিক লিঙ্গ-বৈষম্যের অভিযোগে আমেরিকান ফুটবল ফেডারেশনের বিরুদ্ধে মামলা করে মেয়েরা। কাপ-যুদ্ধের আগে এ-সব কী! অনেকেই ভুরু কুঁচকেছিলেন। কিন্তু মেগানরা বরাবরই একবগ্গা। কিছুতেই মাথা নোয়াব না। সেই জেদটাই যেন একের পর এক ম্যাচে গোলের মালা পরিয়ে দিল বিপক্ষকে।
শুরুটা হয়েছিল প্রথম ম্যাচে তাইল্যান্ডকে ১৩টা গোল দিয়ে। সেই ম্যাচ, যেখানে জাতীয় সঙ্গীতের সময়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন মেগান। প্রতিবাদে। পুলিশি অত্যাচার ও জাতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ২০১৬-য় সান ফ্রান্সিসকোর প্রাক্তন ফুটবলার কলিন ক্যাপারনিকও একই রকম স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট অবশ্য পাত্তা দেননি। ব্যঙ্গ করেই বলেছিলেন, ‘‘এর মধ্যে প্রতিবাদ কোথায়!’’ তখনই আবার মাস পাঁচেক আগে মেগানের একটা সাক্ষাৎকার ভাইরাল হয়ে যায়। যেখানে মেগানকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘কাপ জিতলেও হোয়াইট হাউসে যাব না।’’ কোয়ার্টার ফাইনালের আগে ফের বললেন— যাব না। তার পর মাঠে নেমে নিজেই দু’গোল দিলেন। ট্রাম্প তখনও তাঁকে বিঁধে চলেছেন— ‘‘আগে তো জিতুন!’’ জানিয়েছিলেন, দল না-জিতলেও হোয়াইট হাউসে আসার আমন্ত্রণ পাবে।
জয়ের পরে চুমু বান্ধবীকে। ছবি: গেটি ইমেজেস।
প্রচ্ছন্ন হঁশিয়ারিও ছিল। কিন্তু মেগান, মেগানই। মাঠের বাইরে, মাঠেও। তাই ফাইনাল জিতে আবেগের বশে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে তাঁর চুমু খাওয়া ‘এলজিবিটি রাইট মুভমেন্ট’-এর স্টেটমেন্ট হয়েছে। মেগানের যুক্তি, এত বড় প্ল্যাটফর্ম পেয়েও তিনি যদি তাঁর আদর্শ বা মতামতকে তুলে ধরতে না-পারেন, তা হলে সেটা বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের প্রতি অবিচার হবে।
‘মন্দ মেয়ে’ মেগান, আপনাকে অভিনন্দন। যাঁরা চাননি, আপনার দল জিতুক, তাঁদের উদ্দেশে আপনার গোলের পরে খোলা হাতের অভিবাদন উপযুক্ত জবাব। খেলা শেষে আপনার বার্তায় অভিভূত। আনন্দে চোখে জল এসেছে। আর আমার চার বছরের মেয়েকে বলেছি, ‘‘মেগান র্যাপিনো তোমার জীবনে আদর্শ হয়ে থাকুক।’’ মেগান আর টিম ইউএসএ আইকন হয়ে থাকল সামাজিক বৈষম্য আর অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুখ হিসেবে।
এখন শুনছি, ট্রাম্প নিজেই ব্যাকফুটে। জয়ের পরে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টদের মতো তিনিও মেগানদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু হোয়াইট হাউসে ডাকবেন কি? সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে সোনালি চুলের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘‘এখনও ভেবে দেখিনি। দেখা যাক।’’
লেখক কলেজ শিক্ষিকা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy