ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অন্দরে।
২০১৬ সালের আগস্ট মাসে কলেজের চাকরি ছেড়ে যখন ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করলাম, তখন ভাবিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনকে দেখার ভঙ্গিকেই পালটে দেবে। এর আগে আমি ছুটিছাটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে এসে ইতিহাস এবং মানবীবিদ্যা বিভাগে পড়িয়েছি, ছাত্রীদের মেধা আর নিষ্ঠা আমাকে চমকে দিয়েছে কিন্তু তাদের খুব কাছে আসার সময় ও সুযোগ পাইনি।
পূর্ণ সময়ের অধ্যাপনায় নিযুক্ত হবার পর ছাত্রীদের কাছে এলাম। ওরা আমার কাছে এল। আমি এখানে আসার আগে কলকাতার যে অভিজাত কলেজে পড়িয়েছি, সেখানে কয়েকজন মেধাবী ছাত্রী বাদ দিলে বাকিদের পড়াশোনায় আগ্রহ কম। নিদেনপক্ষে শিক্ষকের পড়ানো মন দিয়ে শোনার দিকে আগ্রহ কম। কারণ তারা নিশ্চিন্ত, ব্যক্তিগত শিক্ষকের কাছে রেডি নোট পাবে, যা শুধু একবার গলাধঃকরণ আর পরীক্ষার খাতায় বমন করলেই হয়ে গেল। বাকি সময়টা ফেসবুক এবং হোয়াটসআপে বুঁদ হয়ে থাকলে ক্ষতি নেই কোনও। তাই ক্লাসে শিক্ষক যখন বকে যাচ্ছেন, কোলে রাখা মুঠোফোনের ওপর হাত ঘুরছে। অথবা মন ভেসে বেড়াচ্ছে অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে। অবশ্য সবার ক্ষেত্রে এটা সত্যি নয়। উন্মুখ হয়ে শিক্ষকের বক্তৃতা শোনা, প্রশ্ন করা ছাত্রীর সংখ্যা হাতে গোনা হলেও, ছিল। ওই সব ছাত্রীদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা আমার বড় প্রাপ্তি।
কিন্তু ডায়মণ্ড হারবারে এসে দেখলাম, এরা হাতে গোনা নয়, এরাই সংখ্যায় ভারী। স্নাতকোত্তর স্তরে পড়তে এসেছে যারা, পরিবেশ পরিস্থিতি তাদের পড়াশুনো করার তাগিদকে দমন করতে পারেনি বলেই তারা এসেছে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার তাড়না থেকেই এসেছে। এবং তাদের সময় নষ্ট করার অবকাশ নেই কোনও।
অনেককেই দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছতে হয়। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আবার ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে বেরিয়ে পড়তে হয়। উপায় নেই কোনও। পড়াশোনার খরচা জোগাড় করতে হবে তো! সংসারেও সাহায্য করতে হয় অল্প-বিস্তর। তার পর নিজের পড়াশোনা। এবং সে পড়াশোনা ব্যক্তিগত শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই। ঘরের কাজেও হাত লাগাতে হয় নিশ্চয়। তাই প্রতিটা দিন ওদের কাছে মূল্যবান। প্রতিটা মুহুর্তে চিন্তা, সময় যেন বয়ে না যায়।
আরও পড়ুন: তোমাদের রক্তের ঘ্রাণে রঞ্জিত হয়েছে আমার আঙুল
ওদের কাছে পড়াশোনাটা জীবন সংগ্রামের অবলম্বন। স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার একমাত্র হাতিয়ার। আর এই জেদ আমি মুসলিম মেয়েদের মধ্যেও সমানভাবে দেখি। কারণ পড়াশোনা না করলে নিজের পায়ে দাঁড়াবে কী করে? পরিবারের হাল ধরবে কী করে? আর পড়শোনায় ঢিলে দিলেই বাড়ির লোকে বিয়ে দিয়ে দেবে না? মেয়ের বয়স তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। পরিবারের বিশেষ মাথাব্যথা না থাকলেও, আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শীদের তো রাতে ঘুমে নেই। সোজা ব্যাঁকা কথায় অতিষ্ঠ করে তোলে তাকে।
আরও পড়ুন: ভগবান যে ভাবে তৈরি করেছেন, সেই আমিটাকেই ভালবাসুন
হ্যাঁ, মনে হতে পারে, এই একুশ শতকেও পশ্চিমবঙ্গের মতো প্রগতিশীল রাজ্যে মেয়েদের বিয়ে না করে পড়াশোনা করার জন্য কথা শুনতে হচ্ছে? কথাটা অপ্রিয় হলেও সত্যি। মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গ নাবালিকা বিবাহের হিসেবে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। National Family Health Survey-এর ২০১৫-১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী— যেখানে সারা দেশে নাবালিকা বিবাহের শতকরা হিসেবটা হল ২৭.৯, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে হিসেবটা হল ৪৩.৬%। আর যে সব জেলায় নাবালিকা বিবাহের প্রকোপ বেশি তার মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগণা অন্যতম। এই জেলায় ২০-২৪ বয়সসীমার মধ্যে মহিলা, যাদের ১৮ বছর আগেই বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের শতকরা হিসেব হল ৪৮.৮ শতাংশ। একই সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী এই জেলায় ১০ বা ১০ বছরের বেশি স্কুলশিক্ষার অধিকারী মাত্র ২২.৮ শতাংশ মহিলা। সুতরাং যে সব মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছে, তারা এই জেলার পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যতিক্রম।
আমাদের ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই কন্যাশ্রী প্রকল্পের আওতায় অর্থসাহায্য লাভ করেছে। না, এরা কেউ বিয়ে গোপন করে কন্যাশ্রীর সুবিধে গ্রহণ করেনি। তবে, ছাত্রীদের মুখে শুনি নানান গল্প। কী ভাবে কন্যাশ্রীর টাকায় এক বান্ধবীর বরকে সাইকেল কিনে দেওয়া হয়েছে। কী ভাবে পাত্রপক্ষ দাবি করছে, ব্যাঙ্কে জমা পড়া কন্যাশ্রীর টাকা তাদের হাতে তুলে দেওয়া হোক। মেয়েদের মুখে শুনি আরও অনেক কথা। সুদূর গ্রাম থেকে আসা মেয়েটির সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরতে গা ছম ছম করে। মদের ঠেকের পাশ দিয়ে যেতে বুক দুরদুর করে। শুনতে হয় নানা কুমন্তব্য। পড়াশোনা করতে যাচ্ছে না কি অন্য কিছু? কী ভাবে নিরন্তর শুনতে হয় আত্মীয়দের গঞ্জনা। তাদের মুখে সেই বস্তাপচা বুলি— পড়াশোনা শিখে কি মেয়ে জর্জ ব্যারিস্টার হবে? পড়াশোনা শিখে মেয়ে অবাধ্য বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। মুখে মুখে তর্ক করতে শিখেছে। ছাত্রীদের মুখে শুনি হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের কথা— একদিন হঠাৎ তাদের গ্রামের কোনও এক বন্ধুকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের স্বয়ংসিদ্ধা প্রকল্পের কর্ণধারেরা। নারী পাচার ও বাল্যবিবাহ রোধের উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প। অভিজ্ঞতার আদানপ্রদানের উদ্দেশ্যে এসেছিল এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের কাছে মেয়েরা মেলে ধরেছে নিজেদের। ভাগ করে নিয়েছে জমে থাকা অনেক কথা। তারা পাচার বন্ধের জন্য পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে হাত মেলাতে চায়। বাল্যবিবাহ রোধের জন্য স্কুলে স্কুলে সচেতনতাবৃদ্ধি অভিযানে যেতে চায়। শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে চায়। ক্লাসে এদের gender বা নারীবাদ বোঝাতে বেগ পেতে হয় না তাই। কারণ জীবন দিয়ে এরা উপলব্ধি করে সমাজের লিঙ্গনির্মাণের প্রক্রিয়াটিকে। যাপিত জীবনের যন্ত্রণা তাদের বুঝিয়ে দেয় সমাজ কতটা অসম। দাদার জন্মদিন ঘটা করে পালন করা হয়, আর তার জন্মদিন কেউ মনে রাখে না— বলে কেঁদে ফেলে একজন ছাত্রী।
প্রতি বছর দু’একজন বিবাহিত ছাত্রী ভর্তি হয় ক্লাসে, পড়তে পড়তে এক দু’জনের বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু এদের জেদ, পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। সকালে রান্নাবান্না সেরে যেমন তেমন করে শাড়ি পরে ছুটে আসে মিষ্টি মেয়েটা ক্লাস করতে। রাত্রিবেলা সংসারের সব কাজ সেরে তবে পড়তে বসা। তবু কেউ কথা শোনাতে ছাড়ে না, দুঃখ করে মেয়েটি। পান থেকে চুন খসলেই গঞ্জনা। এমফিল করতে চাওয়া একজন মুসলিম ছাত্রী জিজ্ঞেস করে, মেয়েদের কোনও ঘর নেই— এ বিষয়ে গবেষণা করা যায় না? স্বপ্ন দেখা, প্রেম করার বয়সেই বুঝে গেছে সে— মেয়েদের কোনও ঘর নেই। মানবীবিদ্যা বিভাগের এক ছাত্রী কাজ করতে চায় পরিবারের কন্যাসন্তান-পুরুষসন্তানের বৈষম্য বিষয়ে— অবাঞ্ছিত চতুর্থ কন্যাসন্তান সে নিজে। পিতৃতন্ত্রের চেহারাটা ওদের চিনিয়ে দিতে হয় না। জীবনই ওদের চিনিয়ে দিয়েছে লিঙ্গবৈষম্যের নগ্ন বাস্তবতা। তবে ওরা হার মানতে নারাজ— নিজের জীবনকে নিজের শর্ত অনুযায়ী চালিত করার লড়াই ওরা চালিয়ে যাবে। ওদের আশেপাশে আরও পিছিয়ে থাকা মেয়েদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ওরা অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা অবশ্যই পাশে আছি ওদের।
(লেখক ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy