কালীপুজোর রাতে বাজির ধোঁয়ায় ঢেকেছে আকাশ। ছবি: সুমন বল্লভ।
বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার ই এম বাইপাস। মনে হল আকাশের সব মেঘ যেন হঠাৎ করে মাটিতে নেমে এসেছে। রাস্তার ধারে মার্কারি ল্যাম্পগুলি জ্বলছে বটে, কিন্তু তার কোনও কার্যকারিতাই বোঝা যাচ্ছে না। এক ফুট দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির কাচ তুলে যাচ্ছিলাম। শুরু হয়ে গেল ঘাম। অস্বস্তি। কিন্তু কাচ নামাতেই অন্য বিপদ। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল বাইররে ঘন মেঘের আস্তরণ। শুরু হয়ে গেল কাশি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সহযাত্রীর অভিযোগ, তার গলা জ্বালা করছে। চোখ জ্বলতে শুরু করল। তিলজলা থেকে গন্তব্য ছিল নরেন্দ্রপুর। দক্ষিণের দিকে যত এগিয়েছি, তত ঘন হয়েছে কুয়াশার আস্তরণ। বেড়েছে কাশি। সামান্য এই পথও যেন শেষ হচ্ছিল না। অনেকটা প্রাণ হাতে করেই পৌঁছলাম নরেন্দ্রপুর।
নরেন্দ্রপুর থকে ফেরার সময়ে গাড়ির চালক রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলেন। আর এগোনো যাচ্ছে না। গাড়ির হেডলাইটও ফল দিচ্ছে না। টকটকে লাল চোখ তাঁর। জল পড়ছে। বোঝা গেল, রাত্রি জাগরণে নয়। গাড়িতে ঢুকে পড়া মেঘই ওই বিপত্তি ঘটিয়েছে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে মাঝে মাঝে ঘন কুয়াশায় দৃশ্যমানতা অত্যন্ত কমে যায়। বিপর্যস্ত হয় ট্রেন ও বিমান চলাচল। কিন্তু অক্টোবরের শেষে সেই কুয়াশা কেন?
আবহবিদেরা একে কুয়াশা বলতে নারাজ। তা হলে এটা কী? আলিপুর হাওয়া অফিস-এর অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বললেন, “কুয়াশা তৈরি হয় ঠান্ডায় জলকণা ভারী হয়ে মাটির কাছে নেমে আসায়। কিন্তু কালীপুজোর রাতে যেটা হয়েছে, তাতে জলকণার পরিমাণ নগণ্য। আতসবাজি বিশেষ করে তুবড়ি আর রংমশাল যে পরিমাণ ভারী ধোঁয়া বাতাসে ছাড়ে, তা সহজে উপরের দিকে উঠতে পারে না। তার উপরে বাতাসে এখন আর্দ্রতা বেড়েছে। তাই জলীয় বাষ্প রয়েছে। বাজির ধোঁয়ার সংস্পর্শে এসে সেই জলীয় বাষ্পই এই অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
তা ছাড়া বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরের বাতাস আর্দ্রতার জন্য কিছুটা গরম থাকায় নীচের গরম বাতাস উপরে উঠতে পারছে না বলে আবহবিদেরা জানিয়েছেন। গোকুলবাবু বলেন, “বৃহস্পতিবার হাওয়ার গতিবেগ ছিল খুব কম। হাওয়ার গতিবেগ বেশি থাকলে উপরের বাতাসের সঙ্গে নীচের বাতাসের মিশ্রণ ঘটত। সে ক্ষেত্রে গরম বাতাস দ্রুত উপরের দিকে উঠে যেত। এ ক্ষেত্রে মাটির ঠিক উপরের স্তরে জমা হয়েছিল ধূলিকণা মিশ্রিত ধোঁয়ার আস্তরণ। বাইপাসের ধারে জলাশয় থাকায় সেখানে জলীয় বাষ্প বেশি। আর তাই ধোঁয়াশার চাদরও ছিল মোটা।”
এই ধোঁয়ার ফলে কাশি, চোখ জ্বালা, গলা জ্বালা কেন? বক্ষরোগ চিকিৎসক পার্থসারথি ভট্টাচার্য বলেন, “বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ফোন পাচ্ছি। বিশেষত শিশু, বৃদ্ধ এবং যাঁরা ফুসফুস ও হৃদ্পিণ্ডের সমস্যায় (সিওপিডি) ভুগছেন, তাঁদের খুবই কষ্ট হয়েছে। বাজির ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকা বড় কণাগুলি আটকে থাকায় স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধার সৃষ্টি করে। ছোট কণাগুলি সরাসরি ফুসফুসে চলে যায়।” পার্থবাবুর ব্যাখ্যা, বাজির ধোঁয়ার মধ্যে থাকা বড় কণাগুলি চোখ, গলা এবং মুখের মিউকাস পর্দায় আটকে যায়। তাতেই জ্বলুনি হয়। মিউকাস পর্দা বহু ক্ষেত্রে চিরে যায়।
কার্ডিওথোরাসিক চিকিৎসক সত্যজিৎ বসুর কথায়, “বৃহস্পতিবার রাতে সল্টলেকে ছিলাম। আমারই ভীষণ কষ্ট হয়েছে। তা হলে যাঁরা হৃদ্রোগী কিংবা শ্বাসকষ্টের রোগী, তাঁদের কী হচ্ছে, তা সহজেই অনুময়ে। বাইপাসের ধারে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের অবস্থাটা বুঝতে পারছি।”
শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বাজারে বিক্রি বেড়েছে তুবড়ি, রংমশালের মতো আতসবাজির। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তাতে এক ধরনের দূষণ চলে গিয়ে বাড়ছে অন্য এক দূষণ। যা শরীরের ভিতরটাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কলকাতার এখন বায়ুদূষণের যা হাল, তার সঙ্গে বাজি পোড়ার ফলে উৎপন্ন ঢালাও কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং অন্য ক্ষতিকর গ্যাস মিশে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা চিকিৎসক এবং পরিবেশ বিজ্ঞানীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy