Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Heart Attack

বাংলার মাছই জানে আমাদের হার্টকে সারিয়ে তোলার জাদু, দেখালেন দুই বাঙালি বিজ্ঞানী

গবেষকদল দেখালেন, একটি জিন কী ভাবে জেব্রা ফিশের ক্ষতবিক্ষত হৃদযন্ত্রকে সারিয়ে তুলতে পারে

ইনসেটে, দুই গবেষক চিন্ময় পাত্র (বাঁ দিকে) ও দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

ইনসেটে, দুই গবেষক চিন্ময় পাত্র (বাঁ দিকে) ও দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৯:৫৫
Share: Save:

রীতিমতো জাদুমন্ত্র জানে আমাদের ধানখেতের আলে, খালেবিলে, পুকুরে, নদীতে থাকা ‘ম্যাজিশিয়ান’ মাছ। জেব্রা ফিশ।

হাতের কড়ে আঙুলের আকারের ও গায়ে ডোরাকাটা দাগের গ্রাম বাংলার সেই মাছ জানে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পরেও মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, মেরুদণ্ড-সহ তার শরীরের প্রায় সবক’টি অঙ্গকে নতুন করে গড়ে তুলতে। যা মানুষ পারে না। পারে না কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণীই। এই অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে আরও একটি প্রাণীর। স্যালামান্ডার।

মূলত গ্রাম বাংলা আর উত্তর-পূর্ব ভারতের নদী, পুকুর, খালবিলের এই জেব্রা ফিশের কাছ থেকেই আমাদের দুর্বল হয়ে পড়া হৃদযন্ত্রকে ফের জাগিয়ে তোলার সঞ্জীবনী মন্ত্রটি খুঁজে বের করলেন ভবানীপুরের দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগীরা। পুণের আগরকর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি বিভাগের বিজ্ঞানী চিন্ময় পাত্রের তত্ত্বাবধানে। দেবাঞ্জন এখন ফ্রাঙ্কফুর্টে গোথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর কার্ডিওভাসকুলার রিজেনারেশনের গবেষক।

বিশ্বে প্রথম

চিন্ময়, দেবাঞ্জন-সহ ১০ জনের গবেষকদল পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্বে এই প্রথম দেখালেন, একটি বিশেষ জিন কী ভাবে জেব্রা ফিশের ক্ষতবিক্ষত হৃদযন্ত্রকে (‘মায়োকার্ডিয়াল ইনজুরি’) পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে সাহায্য করে। জিনটির নাম- ‘কানেকটিভ টিস্যু গ্রোথ ফ্যাক্টর (সিটিজিএফ)’। আরও একটি নাম রয়েছে জিনটির। ‘সেলুলার কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ফ্যাক্টর ২-এ’।

এই গবেষণাতেই প্রথম বোঝা গেল, কেন হার্ট অ্যাটাকের পর আমরা আর হৃদযন্ত্রকে আগের অবস্থায় ফিরে পাই না? কেন পায় না কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণী, এমনকি অন্যান্য মাছও? দেখালেন, কেন তৃতীয় বারের হার্ট অ্যাটাকের পর অনিবার্যই হয়ে ওঠে আমাদের মৃত্যু? আর কেনই বা জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্র বার বার ক্ষতবিক্ষত হয়েও পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে প্রায় নতুন হৃদযন্ত্রের মতোই?

দুই ভারতীয়। অধ্যাপক চিন্ময় পাত্র (উপরে বাঁ দিকে) ও গবেষক ছাত্র দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায় (ডান দিকে)।— নিজস্ব চিত্র

দুই ভারতীয়। অধ্যাপক চিন্ময় পাত্র (উপরে বাঁ দিকে) ও গবেষক ছাত্র দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায় (ডান দিকে)।— নিজস্ব চিত্র

গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ডেভেলপমেন্ট’-এ। মূল গবেষক দেবাঞ্জন কাজ করেছেন পুণের ‘আগরকর রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)’-এর ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর চিন্ময় পাত্রের তত্ত্বাবধানে। এআরআই-এর গবেষণাগারে। সহযোগিতা করেছে জার্মানির ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর হার্ট অ্যান্ড লাং রিসার্চ’ এবং আমেরিকার ডারহ্যামের ‘ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়’-এর মেডিক্যাল সেন্টারও।

জেব্রা ফিশের সেই বীজমন্ত্রটা কী?

গবেষকরা জেব্রা ফিশের মধ্যে এমন একটি জিনের হদিস পেয়েছেন যার অঙ্গুলিহেলনেই নিজের ক্ষতবিক্ষত মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, কিডনি-সহ দেহের প্রায় প্রতিটি অঙ্গই নতুন করে গড়ে তোলার বীজমন্ত্রটি পায় গ্রাম বাংলার এই মাছ।

এই জিন যে মানুষের মধ্যে নেই তা কিন্তু নয়। আছে। আমাদের দেহে যে মোট ২৬ হাজার জিন রয়েছে, এই জিনটি তার অন্যতম। তবুও আমাদের হৃদযন্ত্র এই কাজটা করতে পারে না। কিন্তু জেব্রা ফিশ তার ক্ষতবিক্ষত হৃদযন্ত্রকে একেবারে আগের মতোই পুরোদস্তুর পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারে।

এই সিটিজিএফ জিনের সক্রিয়তার দরুনই জেব্রা ফিশের দেহে একটি প্রোটিন তৈরি হয়। তার নাম- ‘সিটিজিএফ প্রোটিন’।

আমাদের সঙ্গে জেব্রা ফিশের ফারাক কোথায়?

গবেষকরা দেখেছেন, জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্র ক্ষতবিক্ষত হলেই তার সিটিজিএফ জিনটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার ফলে তৈরি হয় সিটিজিএফ প্রোটিন। হৃদযন্ত্রের সংকোচন ও প্রসারণ হয় যে কোষগুলির জন্য সেই ‘কার্ডিওমায়োসাইট্‌স’-এর দ্রুত বিভাজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় সিটিজিএফ প্রোটিনই। দ্রুত বিভাজনের পর হৃদযন্ত্রের নতুন নতুন কোষগুলি (কার্ডিওমায়োসাইট্‌স) এগিয়ে যেতে শুরু করে ক্ষতস্থানের দিকে। আর এই ভাবেই নতুন নতুন তরতাজা কোষে ঢাকা পড়ে যায় জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রের ক্ষতস্থান।

যেমন আমাদের হাত, পা কেটে-ছড়ে গেলে ক্ষতস্থান তৈরি হয় আর কিছু দিন পর আশপাশের সুস্থ কোষ গিয়ে সেই ক্ষতস্থান ঢেকে দেয়। হাত, পায়ের সেই ক্ষতবিক্ষত অংশটি আবার আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে যায়।

মানুষ বা কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণীর হৃদযন্ত্রের ক্ষেত্রে এটা হয় না। বিশেষ করে, বয়স ২০ বছর পেরনোর পর। তাই প্রতি বার গুরুতর হার্ট অ্যাটাকে আমাদের হৃদযন্ত্রের মাংসপেশিগুলির অন্তত ২৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। সেই হিসেবে তৃতীয় বার হার্ট অ্যাটাকের পর নষ্ট হয়ে যায় হৃদযন্ত্রের ৭৫ শতাংশ মাংসপেশি। যাকে আমরা ‘মাইল্ড অ্যাটাক’ বলি তাতে নষ্ট হয় হৃদযন্ত্রের প্রায় ৫ শতাংশ মাংসপেশি। নষ্ট হয়ে যাওয়া এই মাংসপেশিগুলিকে কিছুতেই আর পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হয় না আমাদের পক্ষে। হৃদযন্ত্রের সংকোচন ও প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থাকে এই মাংসপেশিগুলির। তাই প্রতি বার হার্ট অ্যাটাকের পর হৃদযন্ত্রের কর্মক্ষমতা কমতে শুরু করে। তাই তৃতীয় বার হার্ট অ্যাটাকের পর কর্মক্ষমতার ৪ ভাগের ৩ ভাগই হারিয়ে ফেলে আমাদের হৃদযন্ত্র।

সাম্প্রতিক কয়েকটি গবেষণা অবশ্য জানিয়েছে, ২০ বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের হৃদযন্ত্র তার ক্ষত কিছুটা হলেও সারাতে পারে। তার মানে, ওই সময় অ্যাটাকের পর যদি হৃদযন্ত্রের ২৫ শতাংশ মাংসপেশি নষ্ট হয়ে যায়, তা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্তত ৫ শতাংশ মাংসপেশির পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমাদের বয়স ২০ বছর পেরিয়ে গেলে হৃদযন্ত্র আর সেটাও করতে পারে না।

ধানক্ষেত, পুকুর, নদীর মাছ এই জেব্রা ফিশ।

ধানক্ষেত, পুকুর, নদীর মাছ এই জেব্রা ফিশ।

তাই আমাদের হাত, পায়ের ক্ষতচিহ্ন যেমন কিছু দিন পর নতুন নতুন কোষ দিয়ে ঢাকা পড়ে যায় আমাদের হৃদযন্ত্রের ক্ষতস্থান সে ভাবে নতুন কোষে ঢাকা পড়ে না। ক্ষতস্থান চিরস্থায়ী হয়। তখন আমরা বলি, ‘ফাইব্রোসিস’ হয়েছে।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ভারতে প্রতি ৪ জনের মধ্যে ১ জনের মৃত্যু হয় নানা ধরনের হৃদরোগে। এদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকই সবচেয়ে বড় ঘাতক। শুধু তাই নয়, এ দেশে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সিদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক-সহ নানা ধরনের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।

চালু ধারণায় ভুলটা কোথায়?

আগেই জানা ছিল, ফাইব্রোসিস হলে আমাদের দেহে, ইঁদুরের দেহেও সিটিজিএফ জিনের সক্রিয়তা বেড়ে যায়। ফলে হৃদযন্ত্রে বেড়ে যায় সিটিজিএফ প্রোটিনের মাত্রা। তাই এত দিন আমাদের ধারণা ছিল, এই জিনের সক্রিয়তা বৃদ্ধি আর তার ফলে ওই প্রোটিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্যই ফাইব্রোসিস হয়।

গবেষকরাই প্রথম দেখালেন ধারণাটা আমাদের ভুল ছিল। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখলেন জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রে ক্ষত সৃষ্টির পর যদি তার শরীর থেকে সিটিজিএফ জিনটিকে বার করে নেওয়া হয় তা হলে তার হৃদযন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারছে না। মাছের হৃদযন্ত্রের কার্ডিওমায়োসাইট কোষগুলির প্রসারণ প্রায় ৯০ শতাংশ কমে যাচ্ছে। ফলে, আমাদের হৃদযন্ত্রের মতোই তাদের হৃদযন্ত্রেও সেই ক্ষতস্থান দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।

এই পরীক্ষাই দেখিয়ে দিল, জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রের পুনরুজ্জীবনে সিটিজিএফ জিনের ভূমিকা কী এবং কতটা?

জেব্রা ফিশের হৃদপিণ্ড

জেব্রা ফিশের হৃদপিণ্ড

কিন্তু সিটিজিএফ জিনটি শরীরে থাকলে জেব্রা ফিশ তার হৃদযন্ত্রের ক্ষতস্থান ২ মাসের মধ্যেই নতুন নতুন কোষে ভরিয়ে ফেলতে পারে। হৃদযন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারে।

তার পর আরও একটা পরীক্ষা চালালেন গবেষকরা। জেব্রা ফিশ গবেষণাগারে সাধারণত বাঁচে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। গবেষকরা মাছটিকে গবেষণাগারে টানা ১ মাস ধরে প্রতি দিন ১ ঘণ্টা করে রাখলেন ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তার শরীরে সিটিজিএফ জিনের সক্রিয়তা এবং সিটিজিএফ প্রোটিনের কার্যক্ষমতা বাড়াতে। দেখলেন, তাতে ক্ষতস্থান তৈরি হওয়ার পর মাছটির হৃদযন্ত্রের কার্ডিওমায়োসাইট কোষগুলির বিভাজন ঘটছে দ্বিগুণ হারে। তাদের প্রসারণও দ্বিগুণ হচ্ছে। ফলে, মাছের হৃদযন্ত্রের ক্ষতস্থান প্রায় স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে ঢাকা পড়ছে। এতে বোঝা গেল, সিটিজিএফ প্রোটিনই জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রে কার্ডিওমায়োসাইট কোষগুলির প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

জিনটি না থাকলে জেব্রা ফিশেরও ফাইব্রোসিস হয়

এও দেখা গিয়েছে জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রে ক্ষতস্থান তৈরি হলেই প্রথমে তৈরি হয় নতুন নতুন রক্তজালিকা (‘ব্লাড ভেসেল্‌স’)। শুরু হয় কার্ডিওমায়োসাইট কোষগুলির বিভাজনও। নতুন নতুন সুস্থ কোষ তৈরি হয়। কিন্তু শুধুই নতুন নতুন সুস্থ কোষ তৈরি হলেই তো হবে না। সেগুলিকে ক্ষতস্থানের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সেখানে পৌঁছতে হবে ক্ষতস্থান পুরোপুরি ঢেকে দেওয়ার জন্য।

গবেষকরা দেখেছেন, সিটিজিএফ প্রোটিনের অনুপস্থিতিতে জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রে ক্ষতস্থান তৈরির পর নতুন নতুন রক্তজালিকা তৈরি হলেও নতুন নতুন সুস্থ কার্ডিওমায়োসাইট কোষগুলি ক্ষতস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না। তার মানে, তাদেরও ফাইব্রোসিস দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে আমাদের মতোই।

কী দেখা গেল? ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে বুঝিয়ে বলছেন গবেষক দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়

এর থেকে বোঝা গেল, সিটিজিএফ প্রোটিন যে শুধুই ক্ষতস্থান তৈরি হওয়ার পর কার্ডিওমায়োসাইট কোষগুলির বিভাজনে মদত দিচ্ছে, তা-ই নয়; সুস্থ কোষগুলিকে ক্ষতস্থানের দিকে এগিয়ে যেতেও প্ররোচিত করছে। যার ফলে ক্ষতস্থান ঢাকা পড়ছে নতুন নতুন সুস্থ কোষে।

পুণের আগরকর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডেভেলপমেন্ট বায়োলজির বিজ্ঞানী চিন্ময় পাত্র বলছেন, ‘‘প্রায় গত ৩ দশক ধরে আমাদের ধারণা ছিল সিটিজিএফ প্রোটিনের জন্যই আমাদের ফাইব্রোসিস হয়। আমাদের হৃদযন্ত্র তার ক্ষতস্থানকে নতুন সুস্থ কোষে ঢেকে ফেলতে পারে না। তাই এই প্রোটিনকে রোখার নানা পথ নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছিল। আমাদের গবেষণা দেখাল এ বার অন্য কথা ভাবতে হবে। হার্ট অ্যাটাকের পর ক্ষতস্থান তৈরি হলে কী ভাবে সিটিজিএফ প্রোটিনের মাত্রা আমাদের হৃদযন্ত্রে বাড়ানো যায় এ বার বরং সেই দিকগুলি খতিয়ে দেখতে হবে।’’

কেন বেছে নেওয়া হল জেব্রা ফিশ?

জেব্রা ফিশ বাঁচে সাধারণত ২ থেকে ৩ বছর। তাই ৩ মাস বয়স হয়ে গেলেই এই মাছ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে। গবেষকরা কাজটা করেছেন অন্তত ৬ মাস বয়সি জেব্রা ফিশ নিয়ে। ফলে সেগুলি ছিল প্রাপ্তবয়স্ক জেব্রা ফিশ। হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা ও আশঙ্কা যেহেতু শিশুদের চেয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বেশি, প্রবীণদের ক্ষেত্রে আরও বেশি, গবেষকরা তাই কাজটা করেছেন প্রাপ্তবয়স্ক জেব্রা ফিশ নিয়ে।

জেব্রা ফিশ নিয়ে কাজ করার একটা সুবিধা হল, জন্মের পর ১০/১৫ দিন পর্যন্ত বাইরে থেকেই তাদের হৃদযন্ত্র, যকৃত, অগ্ন্যাশয়-সহ শরীরের সবক’টি অঙ্গের বিকশিত হয়ে ওঠা আর তাদের কাজকর্ম চাক্ষুষ করা যায়। কী ভাবে হৃদযন্ত্রের ভাল্ভ তৈরি হচ্ছে, তা-ও দেখা যায়। একেবারে কোষের স্তরে গিয়েও। এমনকি, দেখা যায় এদের কোষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাইটোকনড্রিয়াও।

আর একটা সুবিধা, আমাদের দেহে থাকা জিনগুলির ৭০ শতাংশের সঙ্গে যথেষ্টই মিল রয়েছে জেব্রা ফিশের জিনগুলির। ইঁদুরের জিনের সঙ্গেও তাদের জিনের মিল ৭০ শতাংশ। বাকি জিনগুলি জেব্রা ফিশ প্রজাতির নিজস্ব। ফলে, জেব্রা ফিশের বেশির ভাগ কার্যকরী জিনের (প্রাণী বা উদ্ভিদের অনেক জিনই কার্যকরী থাকে না) সঙ্গেই মানুষ ও ইঁদুরের কার্যকরী জিনগুলির খুব সাদৃশ্য রয়েছে।

তাই এই মাছটিকে নিয়ে গবেষণায় অনেক সুবিধা, আমাদের শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির কাজ বোঝার জন্য। গত শতাব্দীর ৬-এর দশক থেকেই গ্রাম বাংলার এই ‘ম্যাজিশিয়ান’ মাছটিকে নিয়ে বিদেশে শুরু হয় গবেষণা। এখন বিশ্বের প্রায় ১ হাজারটি গবেষণাগারে জেব্রা ফিশ নিয়ে গবেষণা চলছে।

ক্ষতস্থান ঢাকতেও ভূমিকা সিটিজিএফ প্রোটিনের

পরীক্ষার আরও একটি ধাপ রয়েছে। ওই জিনটি আছে, এমন একটি জেব্রা ফিশের দেহে গবেষকরা আরও বেশি পরিমাণে সিটিজিএফ প্রোটিন ঢোকালেন। তাতে দেখলেন, ওই প্রোটিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রের কোষগুলির যে হারে বিভাজন ঘটে আর সেই সুস্থ কোষগুলি যে হারে এগিয়ে যায় ক্ষতস্থানের দিকে, সিটিজিএফ প্রোটিনের মাত্রা বাড়ালে সেই দু’টি হারই প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।

সিটিজিএফ জিন থাকলে বা না থাকলে যা যা ঘটে জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রে।

সিটিজিএফ জিন থাকলে বা না থাকলে যা যা ঘটে জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রে।

এই পরীক্ষাই দেখাল, সিটিজিএফ প্রোটিনই জেব্রা ফিশের ক্ষতবিক্ষত হৃদযন্ত্রের কোষগুলির দ্রুত বিভাজন ও সুস্থ কোষগুলিকে ক্ষতস্থানের দিকে এগিয়ে যেতে মদত দিচ্ছে।

এর পরের ধাপ

গবেষকদের লক্ষ্য, একই ভাবে কোনও ওষুধের মাধ্যমে সিটিজিএফ প্রোটিন মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে ক্ষতবিক্ষত হৃদযন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা। যাতে ফাইব্রোসিসের হাত থেকে আমাদের রেহাই মেলে।

তার জন্য এ বার পরের ধাপে এগোবেন গবেষকরা। পরীক্ষা চালাবেন উন্নততর প্রাণীর উপর।

এ বার কি ইঁদুরকে বেছে নেওয়া হবে?

দেবাঞ্জন বলছেন, ‘‘জন্মের থেকে ৫ দিন পর্যন্ত ইঁদুর তাদের ক্ষতবিক্ষত হৃদযন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারে। কিন্তু তার পর তারা আর এটা করতে পারে না। হৃদযন্ত্রের সমস্যাটা হয় মূলত প্রাপ্তবয়স্কদেরই। তাই ইঁদুরদের উপর এই পরীক্ষা না চালিয়ে ভবিষ্যতে সরাসরি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হৃদযন্ত্রের কোষের উপরে পরীক্ষাটা চালালে ভাল হয়।’’

দেবাঞ্জন এও জানাচ্ছেন, মানুষের হৃদযন্ত্রের কোষের উপর পরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্রে জার্মানির আইনকানুনেও তেমন কোনও জটিলতা নেই।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

দিল্লির ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি দিল্লি)’র টেক্সটাইল ও ফাইবার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ার প্রফেসর সৌরভ ঘোষ বলছেন, ‘‘এই গবেষণা দেখাল জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রে ক্ষতস্থান তৈরি হলে কার্ডিওমায়োসাইট কোষগুলির মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য বিশেষ একটি জিনের (সিটিজিএফ) সংকেত পাঠানোর গতি বেড়ে যায়। যা ওই কোষগুলির বিভাজন ও প্রসারণে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি, নতুন নতুন সুস্থ কোষ তৈরির জন্য প্রদাহ সৃষ্টিকারী কোষ (‘ইনফ্ল্যামেটরি সেল’) তৈরির সংকেতও কমিয়ে দেয় জিনটি। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা।’’

মতামতে। অধ্যাপক সৌরভ ঘোষ (বাঁ দিকে) এবং অধ্যাপক দণ্ডপাণি পেরুনদুরাই।

মতামতে। অধ্যাপক সৌরভ ঘোষ (বাঁ দিকে) এবং অধ্যাপক দণ্ডপাণি পেরুনদুরাই।

সৌরভ জানাচ্ছেন, হার্ট অ্যাটাক আর নানা ধরনের কার্ডিওভাসকুলার রোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হল, হৃদযন্ত্রের রক্তজালিকাগুলি ‘ব্লক্‌ড’ হয়ে যায়। ফলে, ব্যাঘাত ঘটে রক্ত সংবহনে। একেই বলা হয়, ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কেশন’। যার জন্য হৃদযন্ত্রের মাংসপেশিগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পৌঁছয় না। তাই নতুন নতুন সুস্থ কোষও তৈরি হয় না আমাদের হৃদযন্ত্রে। সেই জায়গায় ক্ষতস্থানের দুর্বল কোষগুলিই থেকে যায়। সেগুলির সংখ্যাও বাড়ে। প্রদাহ সৃষ্টিকারী কোষগুলির জন্য। সুস্থ, সবল হৃদযন্ত্রের নিয়মিত সংকোচন ও প্রসারণের জন্য জরুরি বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক সংকেত বা উদ্দীপনাগুলি তখন ক্ষতস্থানের মাংসপেশিগুলি আর বহন করতে পারে না। জেব্রা ফিশ কেন সেটা করতে পারছে, এটা যদি আমরা সঠিক ভাবে বুঝে উঠতে পারি তা হলে আগামী দিনে আমাদের হৃদযন্ত্রের ফাইব্রোসিস সারাতে নতুন ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কার সম্ভব হতে পারে।

সৌরভের কথায়, ‘‘তার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। তা কোনও ওষুধের ছোট অণুর আবিষ্কারও হতে পারে। আবার তা হতে পারে বাইরে থেকে ব্যবহার করে ওই প্রোটিনের মাত্রা বাড়ানো যায় এমন কোনও বায়োমেটিরিয়াল উদ্ভাবনের মাধ্যমেও। যাতে ক্ষতস্থান তৈরি হওয়ার পর মানুষের হৃদযন্ত্রও জেব্রা ফিশের মতোই নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারে।’’

বেঙ্গালুরুর ‘ইনস্টিটিউট ফর স্টেম সেল সায়েন্স অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন (ইনস্টেম)’-এর অধ্যাপক দণ্ডপাণি পেরুনদুরাইও মনে করেন চিন্ময়, দেবাঞ্জন ও তাঁর সহযোগীদের এই গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁরাই প্রথম সেই জিনটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন, জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রে ক্ষত সৃষ্টি হলে যে জিনটি কার্ডিওমায়োসাইট কোষগুলির বিভাজন, প্রসারণ ও ক্ষতস্থানের দিকে নতুন নতুন সুস্থ কার্ডিওমায়োসাইট কোষগুলির এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা নেয়।

তাঁর কথায়, ‘‘এর আগে বিভিন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত লিগামেন্ট ও মেরুদণ্ডের পুনরুজ্জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই জিনের। এমনকি, অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলির প্রসারণেও বড় ভূমিকা নেয় এই জিনটি। এই গবেষণা দেখাল প্রাপ্তবয়স্ক জেব্রা ফিশের ক্ষতবিক্ষত হৃদযন্ত্রের পুনরুজ্জীবনেও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রয়েছে এই জিনের। সেটা কী ভাবে হয়, একেবারে আণবিক পর্যায়ে গিয়ে তার পথটাও দেখাতে পেরেছেন গবেষকরা। এটাই এই গবেষণার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। তাঁরা এও দেখাতে পেরেছেন এই জিনের সক্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হলে জেব্রা ফিশের হৃদযন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের গতি দ্বিগুণ করে দেয়। এবং প্রদাহ সৃষ্টিকারী কোষ তৈরির সংকেত কমিয়ে দেয় ওই জিন।’’

ছবি সৌজন্যে: ডেভেলপমেন্টজার্নাল।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

অন্য বিষয়গুলি:

Heart Attack Heart Disease heart failure
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy