প্রতীকী ছবি
আবার ভানুমতীর খেল দেখাল কার্বন মৌল! আমাদের চোখে ধরা দিল এক অদ্ভুত রূপে। অবিকল আংটির মতো। যা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি কোনও দিন। ধরা দিয়ে উধাও হতেও বেশি সময় নেয়নি কার্বনের সেই রূপ। দিল শুধু তার ছবি তোলার সময়টুকু। উস্কে দিল বহু প্রশ্ন, কৌতূহলও।
বহুরূপী কার্বন মৌলটি কি ‘ঈশ্বর’ হয়ে উঠছে দিনে দিনে? যেমন ‘বহু রূপে সম্মুখে’ আবির্ভূত হন ঈশ্বর! যত দিন যাচ্ছে, ততই অচেনা, অজানা নানা রূপে দেখা দিচ্ছে প্রাণ সৃষ্টির প্রথম ও প্রধান মৌলটি। দেখাচ্ছে তার নিত্যনতুন রূপ। নিত্যনতুন ভানুমতীর খেল!
সুইৎজারল্যান্ডের জুরিখে আইবিএম-এর গবেষণাগারে আংটির মতো সেই অদ্ভুত রূপে ধরা দিল কার্বনের অণু। যা তৈরি হয়েছে ১৮টি কার্বন পরমাণু দিয়ে।
অপচয় ছাড়াই বিদ্যুৎশক্তি পরিবহণ!
দেখা গেল, কার্বনের সেই অণুর মধ্যে দিয়ে কোনও বাধা ছাড়াই বিদ্যুৎশক্তির পরিবহণ সম্ভব। ফলে, বিদ্যুতশক্তির পরিবহণে আর অপচয়ের আশঙ্কা থাকবে না যদি সেই ধরনের কার্বন অণু দিয়ে কোনও পরিবাহী তার আগামী দিনে বানানো সম্ভব হয়। যা হয়তো কোনও দিন মরুভূমির সৌরবিদ্যুৎকেও পৌঁছে দিতে পারে বহু বহু দূরে, কোনও অপচয় ছাড়াই, অনেকটাই সুলভে।
কার্বনের বিরল রূপ (ডান দিকে), যে ভাবে কার্বন পরমাণুগুলি দু’পাশের কার্বন পরমাণুগুলির হাত ধরে রয়েছে (বাঁ দিকে)
এই কৌতূহলও দানা বাঁধতে শুরু করেছে, ভিনগ্রহে প্রাণ খুঁজতে আমরা যে রোজকার জীবনে দেখা কার্বনভিত্তিক জীবনের কথা ভাবি, ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোনওখানে কি প্রাণের জন্ম হয়েছে সেই অন্য ধরনের বা ভিন্ন রূপের কার্বনের উপর ভর করেই?
আরও পড়ুন- ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্যের জট খুলতে আরও রোমাঞ্চকর অভিযানের পথে ইসরো
আরও পড়ুন- চাঁদে এখন না নামলে পরে খুবই পস্তাতে হত ভারতকে!
‘আনন্দবাজার ডিজিটালে’র পাঠানো প্রশ্নের জবাবে সহযোগী গবেষক, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লরেল স্ক্রিভেন ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘খুব বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয়নি গবেষণাগারে আমাদের বানানো কার্বন অণুর সেই অদ্ভুত রূপ। কিন্তু সেই অল্প সময়ের মধ্যেই কার্বনের সেই নতুন রূপ দেখিয়ে দিয়েছে তার অতিপরিবাহিতা ধর্ম। যা আগামী দিনে অপচয় ছাড়া বিদ্যুৎশক্তি পরিবহণে বড় ভূমিকা নিতে পারে। সহায়ক হয়ে উঠতে পারে একটি অণুর আকারের ট্রানজিস্টর তৈরির ক্ষেত্রেও।’’
আপনজনের হাত ধরতে দ্বিধা নেই কার্বনের
আপনজনের হাতে হাত মেলানো আর সেই হ্যান্ডশেককে খুব জোরালো করে রাখার ব্যাপারে মৌলিক পদার্থের জগতে কার্বনের জুড়ি মেলা ভার। কার্বনের এই ধর্মকে বলা হয়, ‘ক্যাটিনেশান প্রপার্টি’। যার জন্য একটি কার্বন পরমাণু অন্য একটি কার্বন পরমাণুর সঙ্গে হাত মেলায় চট করে। আর সেই বন্ধনকে চট করে ভাঙাও সম্ভব হয় না। অক্সিজেন, সালফার, ফসফরাস, সিলিকনের মতো আরও কয়েকটি মৌলের এই ধর্ম রয়েছে। তবে কার্বন তাদের সকলকেই ছাপিয়ে দিয়েছে।
কার্বন পরমাণুর থাকে চারটি হাত। সেই হাতগুলি দিয়ে তারা দু’পাশের অন্য কার্বন পরমাণুর হাত ধরে লম্বা শৃঙ্খল তৈরি করতে পারে। আর সেটা পারে বলেই, বড় বড় অণুর জন্ম দিতে পারে কার্বন পরমাণু। প্রাণ সৃষ্টিও সম্ভব হত না কার্বন পরমাণুরা সেই লম্বা লম্বা শৃঙ্খল তৈরি করতে না পারলে।
কেমন হয় কার্বনের বহু রূপ? দেখুন ভিডিয়ো
সেই লম্বা লম্বা শৃঙ্খল তৈরির ক্ষেত্রে একটি কার্বন পরমাণু তার দু’পাশের কার্বন পরমাণুকে দু’টি করে হাত (ডাবল বন্ড) দিয়ে আঁকড়ে ধরতে পারে। আবার এক পাশে অন্য একটি কার্বন পরমাণুকে এক হাত দিয়ে ধরে অন্য পাশে আর একটি কার্বন পরমাণুকে তিনটি হাত (ট্রিপ্ল বন্ড) দিয়ে আঁকড়ে ধরতে পারে।
কলকাতার ইন্ডিয়ান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার)-এর অধ্যাপক রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আইবিএম-এর গবেষকদের কৃতিত্ব এটাই যে, তাঁরা এমন একটি কার্বন অণু গবেষণাগারে বানাতে পেরেছেন, যা এর আগে আর কেউ পারেননি। যেখানে এক পাশে একটি কার্বন পরমাণুকে তিনটি হাত (ট্রিপ্ল বন্ড) দিয়ে ও অন্য পাশে আর একটি কার্বন পরমাণুকে একটি হাত (সিঙ্গল বন্ড) দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে। আর সেটা হয়েছে একটি কার্বন পরমাণু অন্তর। ফলে, ওই অদ্ভুতদর্শন কার্বন অণুতে ৯টি কার্বন পরমাণু একে অন্যকে ধরে রেখেছে একটি হাত (সিঙ্গল বন্ড) দিয়ে। আর বাকি ৯টি কার্বন পরমাণু একে অন্যকে আঁকড়ে ধরেছে তিনটি হাত (ট্রিপল বন্ড) দিয়ে।’’
বহুরূপী কার্বন দেখাচ্ছে নিত্যনতুন রূপ!
কার্বন মৌলটি দিনে দিনে হয়ে উঠছে আক্ষরিক অর্থেই, বহুরূপী! যা কখনও বিদ্ঘুটে কালো হলে, কখনও তা জ্বলে ওঠে হিরের দ্যুতিতে। কখনও যেমন তাকে ছাড়া কাটা যায় না কাচ, তেমনই কখনও তা পেন্সিলের সিসের মতো হয়ে ওঠে ঝুরঝুরে, নরম। কখনও যদি তার চেহারাটা হয় ফুটবলের মতো, তা হলে কখনও তা দেখতে হয় চোঙের মতো! এই ভাবেই উত্তরোত্তর ‘ভাই’য়ের সংখ্যা বাড়ছে কার্বনের।
কার্বন-১৮ অণুর ত্রিমাত্রিক ছবি। তোলা হয়েছে অ্যাটমিক ফোর্স মাইক্রোস্কোপ দিয়ে।
ছোটবেলায় পর্যায় সারণি বা পিরিয়ডিক টেবিল পড়েছিলেন, মনে আছে? সেই সারণিতে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম থেকে শুরু করে ইউরেনিয়াম, থোরিয়ামের মতো যত তেজস্ক্রিয় মৌল রয়েছে, তাদের কারওরই নেই এই বহু রূপ!
কালো কার্বনেরই আরেক রূপ উজ্জ্বল হিরে!
এর আগেও এই ব্রহ্মাণ্ডের জানা মৌলিক পদার্থের জগতকে কয়েক বার চমকে দিয়েছে কার্বনের অণু। তার নিত্যনতুন রূপ দেখিয়ে। একেবারে গোড়ায় আমরা জানতাম, কার্বনের ‘ভাই’য়ের সংখ্যা আসলে দুই। তার দু’টি রূপ। একটি- অসম্ভব শক্ত। আর দারুণ উজ্জ্বল। যেমন, হিরে। অন্যটি- খুব নরম, ঝুরঝুরে। গ্রাফাইট। যেমন পেন্সিলের সিস।
যুগান্তকারী আবিষ্কার, বলছেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা
কলকাতার ইন্ডিয়ান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার)-এর অধ্যাপক স্বাধীন মণ্ডল বলছেন, ‘‘গত শতকের আটের দশকে আমাদের সেই ধারণাটা পুরোপুরি বদলে দেয় কার্বনের বিশেষ একটি রূপ। যার নাম- ‘বাকিবল’ বা ‘ফুলারিন’। যার জন্য দেওয়া হয় নোবেল পুরস্কারও। যে কার্বন অণুগুলি দেখতে অবিকল ফুটবলের মতো। শুধুই চেহারায় নয়। আকারে, আকৃতিতেও। তার পর আরও একটি রূপে আমাদের চোখে ধরা পড়েছিল কার্বন। যার নাম- কার্বন ন্যানোটিউব। যা দেখতে একেবারে একটি চোঙের মতো। সেখানেই শেষ নয়। ২০০৪ সালে কার্বনের আরও একটি রূপ (গ্রাফিন) তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করে সাড়া ফেলে দেন দুই ইংরেজ বিজ্ঞানী আন্দ্রে জিম ও কোস্তা নোভোসেলভ। পরে তাঁদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু আগের কোনও রূপের সঙ্গেই কার্বনের এই রূপের কোনও মিল নেই। কারণ, এখানে একটি কার্বন পরমাণু তার এক পাশের অন্য একটি কার্বন পরমাণুকে ধরে রয়েছে তিনটি হাতে। অন্য পাশে একটি হাত দিয়ে আঁকড়ে রয়েছে আর একটি কার্বন পরমাণুকে। যা এর আগে দেখা যায়নি। এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার।’’
কী রূপে এ বার ধরা দিল কার্বন? দেখুন ভিডিয়ো
এ বার কি ধরা দেবে ৩৬/৫৪ পরমাণুর কার্বন অণু?
রাহুল জানাচ্ছেন, আগামী দিনে আমরা কার্বনের যে আরও নতুন নতুন রূপ দেখতে পারি, এই আবিষ্কার সেই সম্ভাবনা আরও জোরালো করে তুলল। রাহুলের কথায়, ‘‘অবাক হব না, যদি দেখি আগামী দিনে ৩৬টি বা ৫৪টি কার্বনের পরমাণু দিয়ে আরও একটি অদ্ভুতদর্শন কার্বন অণুর দেখা মেলে। ফলে, এই আবিষ্কার কার্বনের নিত্যনতুন রূপ আবিষ্কারের দরজাটা খুলে দিল বলেই মনে হচ্ছে।’’
আরও পড়ুন- ৩০ বছরের মধ্যেই চাঁদে বড় শিল্পাঞ্চল গড়ে ফেলবে মানুষ!
আরও পড়ুন- চার বছরের মধ্যেই চাঁদের পাড়ায় ‘বাড়ি’ বানাচ্ছে নাসা!
কার্বনের এই রূপের স্থায়িত্বটাই বেশি জরুরি
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর অধ্যাপক পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘গবেষকদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, তাঁরা গবেষণাগারে এই বিরল রূপটি তৈরি করতে পেরেছেন কার্বনের আর তার ছবিও তুলতে পেরেছেন।আপাতত তাঁদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, সদ্য আবিষ্কৃত কার্বন অণুটির স্থায়ীত্ব বাড়ানো। তা হলেই তাকে আমাদের রোজকার জীবনে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। তার অতিপরিবাহিতা (সুপারকন্ডাকটিভিটি) ধর্মটিকে কাজে লাগানো যাবে।’’
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: আইবিএম
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy