ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
এক জন লক্ষ্মীর ভাঁড়ে চুপিচুপি টাকা জমিয়েছিলেন চাঁদে যাবেন বলে! অন্য জন মায়ের কাছে চেয়েছিলেন লম্বা একটা মই। ধাপ ধরে ধরে চাঁদে উঠবেন বলে!
দু’জনেরই স্বপ্নপূরণ হবে আগামী ১৫ জুলাই গভীর রাতে। চাঁদে ভারতের প্রথম পা ছোঁয়ানোর অভিযান ‘চন্দ্রযান-২’ রওনা হয়ে গেলে। রওনা করানো থেকে চাঁদে নামানো, চাঁদের মাটিতে রোভার ‘প্রজ্ঞান’-এর ঘুরে-চরে বেড়ানো, সেই সব কিছুই তো হবে তাঁদের ‘রিমোট কন্ট্রোলে। এক জন রিতু কারিদহাল শ্রীবাস্তব। চন্দ্রযান-২-এর মিশন ডিরেক্টর। ইসরোর ‘রকেট ওম্যান’দের অন্যতম। অন্য জন বনিতা এম। ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্র অভিযানের প্রজেক্ট ডিরেক্টর। ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযানের দুই নেপথ্যনায়িকা। ফোনে, ই-মেলে দু’জনের কাছেই পৌঁছে গেলেন ‘আনন্দবাজার ডিজিটালে’র এই প্রতিবেদক। তাঁদের ছোটবেলা, বড় হয়ে ওঠা, তাঁদের দায়িত্ব, কাজকর্মের গল্প শুনলেন।
রিতু কারিদহালের গল্প
রাত ভোর হয়ে আসছে, তবু মেয়ে পড়েই চলেছে। মেয়ের চোখে ঘুম নেই। মা-ই বা ঘুমোতে যান কী ভাবে? চোখ জড়িয়ে এলে উঠে গিয়ে চোখে জল দিয়ে আসতেন মা। জেগে থাকতেন রাতভর। একটা-দু’টো দিনের কথা নয়। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। রিতু তখন স্কুলের ছাত্রী। কতই বা বয়স, নয় কি দশ। শুধুই বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা নয়, পড়তে পড়তেই খোলা জানলা দিয়ে রিতুর চোখ চলে যাচ্ছে আকাশে। চাঁদ উঠেছে। চাঁদ দেখলেই চাঁদে যেতে ইচ্ছে করে রিতুর। পড়তে পড়তেই উঠে যায় চাঁদে। ভাল ভাবে ‘চাঁদ পড়বে’ বলে! দেখে, সন্ধ্যায় দেখা শুকতারাটিকে (শুক্র গ্রহ) কেমন লাগছে রাতে। দেখে, সপ্তর্ষিমণ্ডলটা কি একটু চেহারা বদলাল? ওই অতল অন্ধকারের গভীরে কী রহস্য লুকিয়ে রয়েছে?
বুধবার প্রায় মধ্য রাতে লখনউয়ে তাঁর পিত্রালয়ে রিতুকে মোবাইল ফোনে ধরেছিল আনন্দবাজার ডিজিটাল। তার আগে পাঠানো হয়েছিল ই-মেল। ফোনের সময়টা ঠিক করে দিয়েছিলেন রিতুই। রাত পৌনে বারোটা। তাঁর ছোটবেলা, বড় হয়ে ওঠার গল্প বলতে শুরু করলেন রিতু কারিদহাল। এই প্রথম ভারত পা ছোঁয়াবে যে অভিযানে, সেই ‘চন্দ্রযান-২’-এর তিনিই এক নম্বর ব্যক্তিত্ব। যিনি ভারতের আরও একটি গর্বের অভিযান ‘মার্স অরবিটার মিশন (মম)’-এরও ডেপুটি অপারেশন্স ডিরেক্টর। ‘মঙ্গলযান’ কোন পথ ধরে যাবে, উৎক্ষেপণের কত দিন কত ঘণ্টায় তা ঢুকে পড়বে মঙ্গলের প্রথম কোনও কক্ষপথে, সেই সব কিছু চূড়ান্ত করার দায়িত্ব ইসরো যাঁদের হাতে দিয়েছিল, রিতু ছিলেন তাঁদের মধ্যমণি। এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে রিতু থাকেন বেঙ্গালুরুতে।
মা বলেছিলেন, চাঁদ অনেক দূর, যাওয়ার খরচ অনেক...
ওই নয়/দশ বছর বয়সেই মায়ের কাছে বেশ কয়েক বার বায়না ধরেছে রিতু, বলেছে, ‘‘বাবাকে বলো না, আমাদের চাঁদে নিয়ে যেতে।’’ মা বলতেন, ‘‘অনেক দূর। অনেক খরচ। চাঁদে যাওয়া কি মুখের কথা?’’ তা শুনেই তোড়জোড় শুরু করে দিল ছোট্ট রিতু। খেলনা, লজেন্স কেনার জন্য বাবা মাঝেমধ্যে যে টাকা দিতেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাড়িতে এসে আত্মীয়স্বজনরা ভালবেসে যে টাকা দিয়ে যেতেন, সেই সবই ছোট একটি কৌটায় ভরে রাখত রিতু। জমাত, মা, বাবাকে নিয়ে চাঁদে যাওয়ার খরচ জোগাবে বলে। সামলাতে না পেরে মাঝেমধ্যে খুব চটে যেতেন মা। বলতেন, ‘‘আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। আমাদের অত সাধ থাকলে হবে না। ভাল ভাবে পড়াশোনা করলে, তুমি নিজেই এক দিন চাঁদে যেতে পারবে।’’
‘রকেট ওমেন’ রিতু কারিদহাল (বাঁ দিকে) ও বনিতা এম
মায়ের কথা বলতে গিয়ে গলা ভারী হয়ে এল ‘রকেট ওম্যান’-এর!
বলতে বলতে গলাটা ভারী হয়ে গেল রিতু কারিদহালের। বোঝা গেল দূরের টেলিফোনেও। ‘রকেট ওম্যান’-এর ‘কাঠিন্য’ তখন উধাও! রিতু বললেন, ‘‘মায়ের সেই বকুনিটাই আমার টনিকের কাজ করেছিল। উঠেপড়ে লাগলাম রেজাল্ট ভাল করতে। লখনউয়ে আমাদের বাড়িটা ছিল খুবই মধ্যবিত্ত একটা এলাকায়। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। কাজের ব্যস্ততায় বাড়িতে ফিরতেন অনেক রাতে। বাবার সঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়ার পর পড়তে বসতাম। রাতেই পড়াশোনা করতে ভাল লাগত আমার। ওই সময় সুনসান থাকে চার পাশ। পড়ায় মন বসানো যেত। গভীর রাতেও মাকেই পেতাম কাছে। পাশে। মাকে বলতাম, ভাল রেজাল্ট করলে আমি এমন কিছু নিয়ে পড়ব যাতে চাঁদে যেতে পারি! হায়ার সেকেন্ডারি থেকে রেজাল্ট ভাল হতে শুরু করল আমার। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে অনার্স গ্র্যাজুয়েট হলাম। উচ্চশিক্ষার জন্য নানা পরীক্ষা দিতে শুরু করলাম। বসলাম গ্র্যাজুয়েট অ্যাপটিটিউড টেস্ট ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (‘গেট’)। ভাল স্কোর করলাম। অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য চান্স পেয়ে গেলাম বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে। স্নাতকোত্তরেও রেজাল্টটা খুব ভাল হয়েছিল।’’
তারই ভিত্তিতে ইসরোয় চাকরির আবেদন করলেন রিতু। খুব দেরি করতে হয়নি। ডাক এল, পরীক্ষা ও ইন্টারভিউয়ের। যেতে হবে বেঙ্গালুরুতে। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন, পরীক্ষা, ইন্টারভিউ দিলেন। পেয়ে গেলেন ইসরোর চাকরিও।
মঙ্গল-অভিযানের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন রিতু কারিদহাল। দেখুন সেই ভিডিয়ো
২২ বছর আগে আড়াই দিনের পথ!
তার পরেই চিন্তা শুরু হল বাবা, মায়ের। কখনও যে মা, বাবাকে ছেড়ে থাকেনি অন্য কোথাও, সেই রিতুকেই কি না চাকরি করতে যেতে হবে লখনউ থেকে দু’হাজার কিলোমিটার দূরে। বেঙ্গালুরুতে। রিতুর কথায়, ‘‘সেটা ২২ বছর আগেকার কথা। এতটা দূরত্ব পাড়ি দেওয়াটা মুখের কথা নয়। তখন দূরত্বটা শুধুই কিলোমিটারের ছিল না। ছিল দিন আর ঘণ্টার। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি। ট্রেনেই আসা-যাওয়া করতে হত। ট্রেনে সময় লাগত আড়াই দিন। বাবা তখনও চাকরি করছেন লখনউয়ে। তাই আমার বাবা, মায়ের লখনউ ছেড়ে এসে বেঙ্গালুরুতে আমার সঙ্গে থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তার পরেও ওঁরা আমাকে অত দূরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমাকে ছেড়ে থাকার কষ্টটা সহ্য করতে রাজি হয়েছিলেন।’’
মঙ্গলযানের অটোনমি সফ্টওয়্যার তো তাঁরই হাতে গড়া
মঙ্গলযান-এরও গুরুদায়িত্বে ছিলেন রিতু। ছিলেন ডেপুটি অপারেশন্স ডিরেক্টর। ২০০৭ সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি, অধুনা প্রয়াত এ পি জে আবদুল কালামের হাত থেকে পেয়েছিলেন ‘ইয়ং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড’। দায়িত্বে ছিলেন ইসরোর আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযানেরও। বললেন, ‘‘মম’ই ছিল ইসরোয় আমার জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। তার আগে গভীর মহাকাশে (ডিপ স্পেস) আমাদের কোনও মহাকাশযান পাঠানোর অভিজ্ঞতা ছিল না। অত দূরে থাকা কোনও মহাকাশযানে আমাদের গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে সিগন্যাল পাঠাতে হবে আর তার জবাব ফিরে আসতে হবে মাত্র ৪০ মিনিটের মধ্যে। ভাবুন! ফলে, আমাদের প্রযুক্তিকে খুব শক্তিশালী ও নিখুঁত করে তুলতে হয়েছিল। বানাতে হয়েছিল অটোনমি সফ্টওয়্যার। অথচ সেই সব কাজের জন্য আমরা সময় পেয়েছিলাম মাত্র দেড় বছর। আসলে এক বছর সওয়া তিন মাস। আর সেই অটোনমি সফ্টওয়্যারটা আমরা বানিয়েছিলাম মাত্র দশ মাসে।’’
একটু ভুলচুক হলেই মঙ্গলযান হারিয়ে যেত মহাকাশের অন্ধকারে: রিতু
‘‘সে বার আরও সমস্যা হয়েছিল মঙ্গলে যাওয়ার রুট ঠিক করতে। কোন পথে ধরে মঙ্গলে পৌঁছলে কোনও বিঘ্ন ঘটবে না মঙ্গলযানের যাত্রাপথে, তা ঠিক করতে আমাদের ঘাম ছুটে গিয়েছিল। কারণ, হিসাবে মাত্র ০.১ শতাংশ ভুলচুক থেকে গেলেই মঙ্গলযানের পক্ষে আর ‘লাল গ্রহে’র কক্ষপথে ঢুকে পড়া সম্ভব হত না। উৎক্ষেপণের পর ৬০ কোটি কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে মঙ্গলের কক্ষপথে তাকে ঢোকানো (মার্স অরবিটার ইনসার্শান)-র কাজটাও ছিল খুবই কঠিন। সামান্য ভুলচুক হলেই মঙ্গলযান মহাকাশের অতল অন্ধকারে হারিয়ে যেত, মঙ্গলের পাড়ায় না ঢুকে। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিলাম আমরা। কম্পিউটার স্ক্রিনে কিছুতেই ভেসে উঠছিল না মঙ্গলের কক্ষপথে মঙ্গলযানের ঢুকে পড়ার ছবি’’, বললেন রিতু।
আরও পড়ুন- ইসরো মহাকাশে ঘোরাবে আপনাকেও
আরও পড়ুন- খাবার নুন মিলল বৃহস্পতির চাঁদে, রয়েছে আমাদের মতোই মহাসাগর, জানাল নাসা
তবে রিতু জানালেন, এ বার সেই চিন্তাটা কিছুটা কম। কারণ চাঁদ রয়েছে আমাদের অনেকটাই কাছে। মাত্র ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দূরে। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা নামছি চাঁদের দক্ষিণ মেরুর সেই দিকটায় যেখানটা অত উঁচু-নিচু নয়। অনেকটাই সমতল।’’
বনিতা এমের গল্প
বেঙালুরু থেকে ফোনে চন্দ্রযান-২-এর আর এক নেপথ্যনায়িকা বনিতা বললেন, ‘‘ছোটবেলায় মাকে বলেছিলাম লম্বা একটা মই কিনে দিতে। সেটা বেয়ে চাঁদে উঠতে চেয়েছিলাম। বড় হয়ে বইটই পড়ে জানতে পারলাম আমাদের আরও ভাল ভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাঁদকে কতটা প্রয়োজন।’’
ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বনিতা। ২০০৬ সালে তিনি অ্যাস্ট্রোনটিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার দেওয়া ‘সেরা মহিলা বিজ্ঞানী’র পুরস্কার পান।
বনিতার স্কুল, কলেজ তামিলনাড়ুতে। পরে ইসরোর চাকরি নিয়ে বেঙ্গালুরুতে। একটি সন্তান। বনিতা বললেন, ‘‘শুধু আমরা দু’জনই নই। চন্দ্রযান-২ প্রকল্পে যত জন বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ রয়েছেন, তাঁদের ৩০ শতাংশই মহিলা।’’
‘হিলিয়াম-৩’-এর আশায় দিন গুণছেন বনিতা!
বনিতা জানালেন, তিনি আশা করে রয়েছেন ‘হিলিয়াম-৩’ আইসোটোপের মৌল কতটা রয়েছে চাঁদে, তার খবর জানাতে পারবে চন্দ্রযান-২-এর রোভার প্রজ্ঞান। তাতে কী লাভ আমাদের? বনিতা বললেন, ‘‘এই মৌলটা একেবারেই নেই পৃথিবীতে। ওই মৌল যদি পরে কোনও দিন আনা যায় পৃথিবীতে, আমাদের খনিজ সম্পদের ভাঁড়ার তা ভরিয়ে তুলবে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।’’
সেটাই আপাতত বনিতার ছোটবেলার বায়নার মতো চাঁদে ওঠার মই!
ভিডিও সৌজন্যে: রিতু কারিদহাল শ্রীবাস্তব। ইসরো
আমাদের প্রতিবেদনে ভুলবশত হিলিয়াম-৩ এর পরিবর্তে লিথিয়াম-৩ লেখা হয়েছিল আমরা এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য দু:খিত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy