অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
বাতাসের বিষ ঝাড়ার ‘ওঝা’ কি তবে এসে গেল? সেই বিষকেই আমাদের বাঁচার জ্বালানিতে বদলে দেওয়ার মন্ত্র জানে যে ওঝা!
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান -জার্নাল ‘প্রসিডিংস অফ ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস’-এর ১৩ নভেম্বেরের সংখ্যায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র সেই ‘ওঝা’র হদিশ দিয়েছে, যা আসলে নিকেল ও লোহা দিয়ে বানানো একটি অনুঘটক বা ক্যাটালিস্ট। এই অনুঘটকই বাতাসের বিষ কার্বন ডাই অক্সাইড অণুকে ভেঙে দিতে পারে, তা থেকে তৈরি করতে পারে এমন একটি পদার্থের অণু যা আমাদের রোজকার জীবনে কাজে লাগার জিনিসপত্রের জন্ম দিতে পারে।
প্রতি মুহূর্তে আমাদের শ্বাসের বাতাস ভরে উঠছে বিষে। সেই বিষের পরিমাণ দিন কে দিন এতই বেড়ে চলেছে যে, বাতাসে শ্বাসের অক্সিজেনের ঘাটতি আমাদের কপালের ভাঁজ বাড়িয়ে দিয়েছে। অক্সিজেনই যে বাঁচিয়ে রাখে আমাদের।
বিপদ একা আসে না। সঙ্গী নিয়ে আসে। বাতাসের বিষও তেমনই ডেকে আনছে আরও একটা বিপদ। গায়ের জ্বর বাড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর। তাতে খুব তেতে উঠছে আমাদের গ্রহ। দুই মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে দ্রুত। অস্বাভাবিক হারে। তার ফলে সমুদ্রের জলের স্তর হুড়মুড়িয়ে ওপরে উঠে আসছে। আমাদের তলিয়ে যাওয়ার দিন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে।
কাজটা বড়ই কঠিন
তাই জরুরি হয়ে পড়েছে বাতাসের বিষ ঝেড়ে ফেলার কাজ। কিন্তু সে তো সাপের বিষ নয় যে, ঝেড়ে ফেলাটা খুব সহজ হবে !
কারণ, বাতাসের সেই বিষ তো বায়ুমণ্ডলের অন্যতম একটি উপাদানও। যার নাম কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস।
তাই বিষ ঝেড়ে তাকে বায়ুমণ্ডল থেকে বের করে এনে তার পরিমাণ কমিয়ে আনতে হলে সেই বিষকেই অন্য কিছুতে বদলে দিতে হবে। আর তা যদি এমন কিছুতে বদলে ফেলা যায় যা আমাদের রোজকার জীবনে খুবই কাজে লাগে, তা হলে তার চেয়ে ভাল আর কীইবা হতে পারে?
কিন্তু বদলাতে গেলে তো ভাঙতে হবে কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুকে।
এই কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের একটি অণু তৈরি হয় একটি কার্বন পরমাণু আর দুটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে। আর সেই কার্বন পরমাণুর সঙ্গে অক্সিজেন পর পরমাণুদুটির বন্ধন (বন্ড)এতই শক্তিশালী যে, কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুকে ভাঙার কাজটা মোটেই সহজ নয়। বহু দিন ধরেই সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীরা।
ফলে, এই ‘ওঝা’র কাজটা যে কতটা কঠিন, তা আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
এত দিন যা করা হচ্ছিল
সেই কঠিন কাজটা এত দিন করা হচ্ছিল একটি তড়িৎ- রাসায়নিক (ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল)পদ্ধতিতে।
যেখানে প্ল্যাটিনাম ধাতুর একটি অনুঘটক ব্যবহার করা হচ্ছিল কার্বন ডাই-অক্সাইড অণু ভেঙে কার্বন মনোক্সাইড অণু বানানোর জন্য। তাতে দুটি কাজ হয়। কার্বন ডাই-অক্সাইড অণু ভেঙে যাওয়ার ফলে বাতাসে বিষের বোঝা কমে। আবার সেই ভাঙার পর তৈরি হওয়া কার্বন মনোক্সাইড অণু অনেকের সঙ্গেই চটপট বিক্রিয়া করে আমাদের রোজকার জীবনে লাগে এমন নানা পদার্থের জন্ম দিতে পারে। তৈরি করতে পারে প্লাস্টিক আর গ্যাসোলিনের মতো বহু প্রয়োজনীয় পদার্থ। যা আমাদের রোজকার জীবনে খুব কাজে লাগে।
অসুবিধাটা কোথায়?
কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে অন্য জায়গায়। যে প্ল্যাটিনাম অনুঘটক দিয়ে এখন কার্বন ডাই-অক্সাইড অণু ভাঙার কাজটা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি, সেই প্ল্যাটিনাম খুব দামি। চট করে পাওয়াও যায় না। ফলে, ‘ওঝা’দের কাজটা মোটেই সহজ হচ্ছিল না। আমাদের জীবনে কাজেও লাগানো যাচ্ছিল না তেমন ভাবে।
এই গবেষণার কৃতিত্ব
নতুন গবেষণার কৃতিত্ব, এ বার সেটা করা যাবে খুব সহজে। আরও দ্রুত। অনেক কম খরচে। শুধু তাই নয়, যে ব্যাটারির মাধ্যমে সেটা করা হবে তার আয়ুও হবে অনেক বেশি।
বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’-এর রসায়নবিদ্যার অধ্যাপক পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সেই অনুঘটক বানানো হয়েছে নিকেল আর লোহার অক্সাইড কার্বোনেট একটি যৌগ দিয়ে। যার মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্র ছিদ্র আছে। তার মধ্যে দিয়ে বিষে ভরা বাতাস গেলে তা বিষ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে টেনে নিয়ে তাকে ভেঙে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসে বদলে দেবে।
এই কাজটা করতে অবশ্য গবেষকদের প্রচুর বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহার করতে হয়েছে। তবে সুবিধেটা এই যে নিকেল আর লোহা, দুটি পদার্থই খুব সহজলভ্য। দামেও প্লাটিনামের তুলনায় খুবই সস্তা।
মোহনপুরে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (আইসার-কলকাতা)’-র রসায়নবিদ্যা বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। এই পদ্ধতিকে বলা হয় অক্সিজেন ইভোল্যুশন রিঅ্যাকশন বা ‘ওইআর’। আরও নানা ধরনের অনুঘটক ব্যবহার করে এই পদ্ধতিতে বাতাসের বিষকে আমাদের রোজকার জীবনে কাজে লাগার পদার্থে বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে নিকেল আর লোহার মতো সস্তা ধাতু দিয়ে অনুঘটক বানিয়ে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ দেখালেন গবেষকরা।’’
বিদ্যুতের বদলে আলো হলে ভাল?
রাহুলের মতে, আরও ভাল হত যদি বিদ্যুৎ না ব্যবহার করেই বাতাসের বিষ কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুকে ভেঙে ফেলা যেত। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুতশক্তি ব্যবহারের খরচটাও আর লাগত না।
রাহুলের কথায়, ‘‘কাজটা ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল না হয়ে আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে(ফোটো-কেমিক্যাল) করা সম্ভব হলে তা সাধারণ মানুষের কাজে আরও বেশি করে লাগানো যেত। তাই এখন দেখতে হবে সূর্যালোক ব্যবহার করেও এই ধরনের অনুঘটক দিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুকে ভাঙা যায় কি না। তা হলে সেটা আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠবে যুগান্তকারী।’’
বাজারে আসছে কতটা সময় লাগবে এই প্রযুক্তির?
গবেষকরা জানিয়েছেন, খুব শীঘ্রই এই প্রযুক্তির বাণিজ্যিকিকরণের চেষ্টা হচ্ছে। মূলত শিল্প কারখানা থেকেই তো বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের মতো বিষ এসে মেশে, তাই প্রযুক্তিকে প্রাথমিক ভাবে মূলত শিল্প সমৃদ্ধ এলাকাগুলিতেই ব্যবহার করা হবে। সেখাকার বাতাসে মিশে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইডের বিষের বোঝা কমাতে ওই গ্যাসকে কার্বন মনোক্সাইডে বদলে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হবে। গবেষকদের আশা, আগামী এক-দেড় দশকের মধ্যেই এই প্রযুক্তির বাস্তবায়ন সম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy