ধরুন, এক মহাপ্রলয়ে ধ্বংস হয়ে গেল পৃথিবী। সব কিছু হয়ে গেল ওলটপালট। বিজ্ঞান সাধনার এক-একটা ল্যাবরেটরি হল ধ্বংসস্তূপ। ওই সম্ভাবনার কথা লিখে বিজ্ঞান সাংবাদিক জর্জ জনসন আলোচনা করেছিলেন জেনিভা শহরের অদূরে সার্ন গবেষণাগারের কথা। বলেছিলেন, মহাপ্রলয়ের পরে মাটি খুঁড়ে মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখবে ২৭ কিলোমিটার লম্বা এক টানেলে পেল্লায় এক যন্ত্র। তার পর মানুষ যখন জানতে পারবে ওই যন্ত্র বানানো হয়েছিল শুধু কোনও কোনও প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায়, তখন তারা থ’ বনে যাবে। জিজ্ঞাসার উত্তরের জন্য এত রাজসূয় আয়োজন!
সার্ন-এর নবতম পরিকল্পনার খবর শুনে জনসনের লেখা মনে পড়ে গেল। ওই ল্যাবরেটরি চায় ভূগর্ভে ১০০ কিলোমিটার লম্বা বৃত্তাকার এক সুপারকোলাইডার বানাতে। সুপারকোলাইডার? হ্যাঁ, তাই।
কোলাইডার হল, কণায়-কণায় ঠোকাঠুকি করার যন্ত্র। প্রায় আলোর বেগে (সেকেন্ডে ৩০০,০০০ কিলোমিটার) ছুটন্ত বিপরীতমুখী কণার স্রোত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মেলে প্রচণ্ড এনার্জি। সে এনার্জি আলবার্ট আইনস্টাইনের আবিষ্কৃত ফর্মুলা মেনে পরিণত হয় পদার্থকণায়। এ ভাবে জানা যায় মুখোমুখি লিপ্ত কণাদের উপাদান। কোন কণা, কোন কণা দিয়ে তৈরি।
পদার্থ কী দিয়ে গড়া? এ মানুষের শাশ্বত প্রশ্ন। আমাদের চারপাশে হাজারো-লাখো বস্তু। যখন থেকে জানা গিয়েছে, ঘর-বাড়ি, টেবিল-চেয়ার, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, নদীনালা— এমনকি নক্ষত্র কিংবা গ্যালাক্সি পর্যন্ত মাত্র শ’খানেক মৌলের পরমাণু বা অ্যাটম দিয়ে গড়া, তখন থেকেই বেড়েছে মানুষের কৌতূহল। অ্যাটম তা হলে কী দিয়ে গড়া? ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন। ও সব আবার কী দিয়ে গড়া? আছে নাকি এমন কোনও উপাদান, যা দিয়ে সব কিছু তৈরি? খোঁজো তাকে।
সুতরাং, ভেঙে যাও অনন্ত বাদাম। অথবা, সেই উপনিষদের কাহিনি। ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের দুই ঘরনি। কাত্যায়নী ও মৈত্রেয়ী। কাত্যায়নী এক সহস্র গাভী পেয়ে খুশি। মৈত্রেয়ী তা নয়। তাঁর চাই প্রশ্নের উত্তর। যাজ্ঞবল্ক্য জ্ঞানী। তাঁকে প্রশ্ন করে চলেছেন মৈত্রেয়ী। একের পর এক। এটা কার মধ্যে নিহিত থাকে? ওটার মধ্যে। তা হলে ওটা কার মধ্যে নিহিত থাকে? সেটার মধ্যে। তা হলে সেটা কার মধ্যে নিহিত থাকে? এ ভাবে ক্রমাগত জিজ্ঞাসা। জবাব দিতে দিতে যাজ্ঞবল্ক্য ক্লান্ত। আর পারছেন না। তাঁর জ্ঞান নিঃশেষিত। অপারগ যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীকে ধমকালেন, আর জানতে চেয়ো না। তোমার মাথা খসে পড়বে! বিজ্ঞানীরা যেন মৈত্রেয়ী। তাঁদের মাথা খসে পড়ার ভয় নেই। প্রশ্ন করায়, জ্ঞানার্জনে তাঁরা ক্লান্তিহীন। তাঁরা জানতে চান, পদার্থের শেষতম উপাদান কী?
উপাদান জানতে পদার্থকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে হবে। করে দেখতে হবে। যে সব কণার সংঘর্ষে নতুন কণা জন্মাচ্ছে, তাদের চিনতে হবে। এ কারণে কোলাইডার যন্ত্রকে বলে ‘ম্যাটার মাইক্রোস্কোপ’। মুশকিল হল, কণার উপাদান ক্ষুদ্রতর কণা যত ছোট, তা শনাক্ত করার জন্য তত পেল্লায় সাইজ়ের কোলাইডার যন্ত্র প্রয়োজন। কণা যত ছোট হয়, তা দেখার জন্য যেমন বেশি ক্ষমতাবান মাইক্রোস্কোপ দরকার।
এত দিন পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কোলাইডার সার্ন-এর লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (এলএইচসি)। ১৯৯৮ সাল থেকে বানানো শুরু। শেষ হয় ২০০৮ সালে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৭৫ মিটার নীচে পাতালে ২৭ কিলোমিটার লম্বা উপবৃত্তাকার টানেল। পৃথিবীর ১০০টি দেশের ১০,০০০ বিজ্ঞানী কাজ করেছিলেন এলএইচসি-তে।
২০১২ সালে ওই এলএইচসি-তে শনাক্ত হয়েছিল হিগস-বোসন ওরফে ঈশ্বরকণা, যা অন্য সব কণাকে তাদের ভর জোগান দেয়। কণাদের ভর আছে বলে মহা সুবিধে। ভর আছে বলে গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি সব জমাট বেঁধে রয়েছে মহাকর্ষের টানে। ভর না থাকলে ও সব তৈরি হত না। জীবদেহ তো কণার পাহাড়। ভর না থাকলে আমরা মানুষরা আটকে থাকতাম না পৃথিবী নামের এই গ্রহের পিঠে, মহাশূন্যে ভেসে বেড়াতাম। অবশ্য, আমাদের এই জীবদেহ তৈরিই যে হত না আগেভাগে, সে তো বলাই বাহুল্য। অন্য কণাকে ভর জোগায় যে কণা, তা ২০১২ সালের আগে শনাক্ত করা যায়নি। তাই ও কাজ খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। কত জরুরি, তা প্রমাণ করবে এই তথ্য। এলএইচসি-তে হিগস-বোসন খুঁজে পাওয়ার এক বছরের মাথায় নোবেল প্রাইজ় দেওয়া হয় সেই দুই বিজ্ঞানীকে, যাঁরা বলেছিলেন হিগস-বোসন কী ভাবে অন্য কণাকে ভারী করে তোলে।
যাঁরা ভেবেছিলেন, হিগস-বোসন খুঁজে পাওয়াতেই সার্ন-এর কাজ খতম, তাঁদের ধারণা ভুল। হিগস-বোসন তো মিলেছে, এবার সে কণার চরিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝতে হবে। বেশি বেশি করে হিগস-বোসন কণা উৎপাদন করতে হবে সে কারণে। ধাক্কাধাক্কিটা এমন ধুন্ধুমার হতে হবে, যাতে সে এনার্জি থেকে প্রচুর হিগস-বোসন উৎপাদিত হতে পারে। সে জন্য চাই ওই সুপারকোলাইডার। যার মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে ইলেকট্রন আর পজ়িট্রন (ধর্মে এক, কেবল চার্জ ইলেকট্রনের উল্টো) কণার।
একটা-দুটো নয়, প্রচুর হিগস-বোসন পেতে হবে। ইলেকট্রন পজ়িট্রন সংঘর্ষের এনার্জি বাড়াতে হবে। কত গুণ? এলএইচসি-তে যে এনার্জিতে হিগস-বোসন মিলেছিল, তার প্রায় সাড়ে ছ’গুণ। সে কারণে সুপারকোলাইডার হবে ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। বিপরীতমুখে ওই টানেলে ছুটবে ইলেকট্রন এবং পজ়িট্রন কণার স্রোত। বার বার ঘুরিয়ে প্রায় আলোর স্পিডে পৌঁছলে সংঘর্ষ।
সুপারকোলাইডার প্ল্যান করায় দারুণ খুশি সার্ন-এর ডিরেক্টর-জেনারেল ফাবিয়োলা গিয়ানোত্তি। বলেছেন, ‘‘ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। সার্ন-এর পক্ষে যেমন, তেমন কণা পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রেও।’’ খুশি সার্ন-এর প্রাক্তন ডিরেক্টর-জেনারেল ক্রিস লিয়োয়েলিন-স্মিথ। বলেছেন, ‘‘সুপারকোলাইডার বানালে তা হবে সার্নের নতুন পথে যাত্রা।’’
২০৩৮ সালে শুরু হবে সুপারকোলাইডার তৈরির কাজ। এত দেরিতে কেন? খরচ। হ্যাঁ, সুপারকোলাইডার বানাতে খরচ হবে ২১০০ কোটি ইউরো। ওই বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সুপারকোলাইডার তৈরি হবে না। সার্ন-কে অর্থ জোগায় সদস্য রাষ্ট্রগুলো। অনেক রকম সদস্যপদ আছে, স্থায়ী এবং অস্থায়ী। সদস্যদের অনুদানে সার্ন তার ব্যয়ভার বহন করে। পরিবর্তে সার্ন তার ল্যাবরেটরিতে সদস্য রাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের গবেষণার সুযোগ দেয়।
বিপুল ব্যয়ের কথা চিন্তা করে প্রস্তাবিত সুপারকোলাইডার নির্মাণের বিরোধিতা করেছেন কেউ কেউ। যেমন, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট-এ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ়-এর বিজ্ঞানী স্যাবাইন হোসেনফেল্ডার। তিনি বলেছেন, “আমি মনে করি সুপারকোলাইডার বানানো ভাল প্ল্যান নয়। গবেষণায় কী এগোবে এত বিপুল অর্থ ঢেলে?”
হ্যাঁ, খরচ বড় বালাই। খরচের কথায় মনে পড়ছে আর এক সুপারকোলাইডার-এর কথা। সুপারকন্ডাকটিং সুপারকোলাইডার (এসএসসি)। যা হতে পারত সার্ন এলএইচসি-র প্রায় তিন গুণ ক্ষমতার। হতে পারত, কিন্তু হয়নি। তৈরি হলে, বিশেষজ্ঞদের ধারণা, হিগস-বোসন শনাক্ত হত এলএইচসি-তে নয়, ওই এসএসসি-তে।
গবেষণা চিরকাল প্রতিযোগিতামূলক। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে কণা পদার্থবিদ্যার পীঠস্থান ছিল ইউরোপ। একের পর এক কণা আবিষ্কৃত হয়েছিল ওই মহাদেশের নানা রাষ্ট্রে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উল্টে যায় পাশা। আমেরিকায় তৈরি হয় নানা কোলাইডার। প্ল্যান করা হয় সবচেয়ে বড় কোলাইডারের— এসএসসি। প্রায় বৃত্তাকার ৮৭ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল। যার মধ্যে বিপরীতমুখে ছুটবে প্রোটন কণার দুই স্রোত। তাদের মধ্যে সংঘর্ষ। রোনাল্ড রেগান, সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর মতোই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ পলিসিতে বিশ্বাস করতেন, তিনি ১৯৮৭ সালে অনুমোদন করেন এসএসসি।
খরচ? ১১০০ কোটি ডলার (আজকের হিসেবে ১৯০০ কোটি ডলার)। ব্যয়ের প্রশ্নে আপত্তি উঠেছিল প্রথম থেকেই। কণা পদার্থবিদ্যা গবেষণায় অত খরচ করলে অন্য গবেষণা (যার মধ্যে আছে সলিড স্টেট ফিজ়িক্স, যা কম্পিউটার চিপ তৈরিতে কাজে লাগে) মার খায় যে। বিতর্ক উঠল চরমে। অবশেষে নির্মাণের কাজ ২০ শতাংশ শেষ হওয়ার (২৪ কিলোমিটার টানেল খোঁড়া এবং ২০০ কোটি ডলার খরচ হওয়ার) পরে মার্কিন কংগ্রেস ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে বাতিল করল সুপারকোলাইডার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy