—প্রতীকী চিত্র।
‘ব্রেন অর্গানয়েড’। সহজ বাংলায় যার অর্থ মস্তিষ্কের একগুচ্ছ কোষ। তবে অর্গানয়েডের বিশেষত্ব হল, এটি ল্যাবে তৈরি ত্রিমাত্রিক কোষসমষ্টি। গবেষণাগারে সাধারণত যে সব সেল কালচার করা হয়, তা দ্বিমাত্রিক কোষ নিয়ে হয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে মানুষের স্টেম কোষ থেকে ত্রিমাত্রিক কলাকোষ (ব্রেন অর্গানয়েড) তৈরি করেছেন ইটালিয়ান বিজ্ঞানী পাওলা আরলোটা। আকারে একটা আপেলের বীজের মতো, কিংবা কিশমিশও বলা যায়। ক্ষুদ্র, কিন্তু খালি চোখে দেখা যায় এই কোষসমষ্টিকে। বিজ্ঞানীর দাবি, পরীক্ষাগারে তৈরি এই ব্রেন অর্গানয়েড একেবারে মানুষের মস্তিষ্কের মতোই কাজ করছে। উচ্ছ্বসিত পাওলা বলছেন, ‘‘আমি বলে বোঝাতে পারব না কী অনুভূতি হচ্ছে! একটি শিশু যখন মায়ের গর্ভে একটু একটু করে বড় হয়, একটা কোষ থেকে অনেক কোষ তৈরি হয়ে যায়, আমরা সেই পদ্ধতি দেখতে পাই না। ল্যাবে আমি কোষেদের তৈরি হওয়া দেখতে পাচ্ছি।’’
গবেষণাগারে পাওলা যে অর্গানয়েড তৈরি করেছেন, তা ছোট্ট। আসল মস্তিষ্কের তুলনায় অনেক সহজ-সরল, অত জটিলতা নেই। কিন্তু এ ভাবে গবেষণাগারে একটা কোষ থেকে একাধিক কোষ তৈরি হওয়া দেখতে পাওয়া, একসঙ্গে স্নায়ুকোষের বড় হওয়া, আসল জীবনে যেমন হয়, সে ভাবে সার্কিট মেনে সুসজ্জিত হয়ে যাওয়া— এ সব দেখে যারপরনাই চমৎকৃত বিজ্ঞানীরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, মাতৃগর্ভে যে ভাবে মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি হয়, তারই এক ঝলক এ বার দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা। জীবন-রহস্যের গোড়ার অধ্যায় একটু একটু করে উন্মোচন হচ্ছে।
অর্গানয়েড নিয়ে বিশ্বজুড়ে একাধিক বিজ্ঞানী গবেষণা করছেন। পাওলা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বলেন, ‘‘এ রকম ঘটনার সাক্ষী আমরা আগে কখনও হইনি। নিজের চোখে দেখছি কী ভাবে কোষ তৈরি হয়। ইঁদুর বা অন্য কোনও প্রাণীর কোষ নিয়ে পরীক্ষা করলে এত বিশদে বোঝা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমরা মানবকোষ নিয়ে কাজ করতে পারছি।’’ স্টেম কোষ ও রিজেনারেটিভ বায়োলজি-র অধ্যাপক পাওলা হার্ভার্ড ও এমআইটি-র ‘স্ট্যানলি সেন্টার ফর সাইকায়াট্রিক রিসার্চ’-এর সদস্যাও।
সেরিব্রাল কর্টেক্সের মডেলে অর্গানয়েড তৈরি করেছেন পাওলা। মস্তিষ্কের এই অংশ মানুষের মুখে ভাষা ফোটায়, স্মৃতি মজুত রাখে, কোনও ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করে, অনুভূতি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে। মস্তিষ্কের এই অংশে গোলযোগের জন্যই অটিজ়ম, স্কিটসোফ্রিনিয়া, ডিমেনশিয়ার মতো অসুখ হয়। নিজের গবেষণায় পাওলা অনুসন্ধান করে দেখছেন, সেরিব্রাল কর্টেক্সে ঠিক কী হয়, যার জন্য এ ধরনের অসুখ দেখা দেয়। এর চিকিৎসাই বা কী হতে পারে, সেই সূত্রও খুঁজছেন তিনি।
যেমন ধরা যাক, একটি অটিস্টিক শিশুর মস্তিষ্কে কোন ধরনের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত, সেটা জানতে সাহায্য করবে পাওলার গবেষণা। একটি শিশু অটিজ়মে আক্রান্ত হওয়ার অর্থ, তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকেই ডিসঅর্ডার বা অসুখ শিকড় ছড়াতে শুরু করেছিল। বিজ্ঞানীদের অনুমান, গর্ভাবস্থার প্রথম দিকের সপ্তাহগুলিতেই এটি শুরু হতে থাকে। পাওলা বলেন, ‘‘কোনও অটিজ়মে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসার সন্ধানে আমরা তার মাতৃগর্ভে থাকার সময়ে ফিরতে পারব না। সে সময়টা চলে গিয়েছে।’’ এখন পাওলা যেটা করছেন, সেটা এমন: রোগীর রক্ত বা চামড়ার নমুনা সংগ্রহ করে তাকে স্টেম কোষে রূপান্তরিত করা হয়েছে। তা থেকে অর্গানয়েড তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি কোষ ওই রোগীরই জিন বহন করছে। এ ভাবে একটি কোষ থেকে কোষসমষ্টি তৈরি হওয়ার সময়ে জিনের ত্রুটিবিচ্যুতি ধরতে পারছেন বিজ্ঞানীরা। পাওলার কথায়, ‘‘একটা ফিল্ম ফের গোড়া থেকে দেখার মতো। এ ভাবে কোথায় গলদ থেকে গিয়েছে, তা ধরা ফেলব আমরা। এত দিন কেউ জানত না, কেন এমন হয়। আমরা ধীরে ধীরে সবটা বোঝার চেষ্টা করছি। ‘ব্ল্যাক বক্স’ খোলা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy