গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রায় তিন দশক আগে দুই বাঙালি বিজ্ঞানী বলেছিলেন, তারা আসবে। সেই অজানা অচেনা ‘পাগলা ঘোড়া’রা ঢুকে পড়বেই আমাদের সৌরমণ্ডলে। খুব কম হলেও, এই ব্রহ্মাণ্ডের অন্য মুলুক থেকে আসা সেই ‘ক্ষ্যাপা’দের অন্তত একটির দেখা আমরা পাবই পাব ২০০ বছরের মধ্যে। তা-ই হল!
মিলে গেল দুই বাঙালি বিজ্ঞানীর পূর্বাভাস। গত ৩০ অগস্ট। ২৬ বছরের মাথায়। দুই বাঙালির এক জন শিলচরের। অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের ডিন অশোক সেন। অন্য জন মেদিনীপুরের। অধুনাপ্রয়াত নারায়ণ চন্দ্র রানা। যিনি ছিলেন পুণের ‘ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)’-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক। ১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’-এ তাঁদের সেই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম ছিল ‘অন দ্য মিসিং ইন্টারস্টেলার কমেট্স’।
ভিন মুলুকের কিম্ভূত পাগলা ঘোড়া!
আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে অনেক দূর থেকে আসা এই পাগলা ঘোড়া আমাদের নজরে ধরা পড়েছে সপ্তাহতিনেক আগে। ইউক্রেনের কাছ থেকে বছর পাঁচেক আগে রাশিয়ার ছিনিয়ে নেওয়া ক্রিমিয়ায়। এক অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী গেন্নাদি বরিসভের টেলিস্কোপে। আন্তর্নক্ষত্র মাধ্য়ম থেকে আসা একটি কিম্ভূত ধূমকেতু। বিজ্ঞানীরা আপাতত যার নাম দিয়েছেন, ‘সি/২০১৯ কিউ-৪’। কেউ কেউ তাকে আবিষ্কারকের নামে ইতিমধ্যেই ‘বরিসভ’ বলেও ডাকতে শুরু করে দিয়েছেন।
২৬ বছর আগে দুই বাঙালির গবেষণাপত্র, (ইনসেটে) অধ্যাপক অশোক সেন ও প্রয়াত অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র রানা
বরিসভ যখন প্রথম আমাদের চোখে পড়ে সপ্তাহতিনেক আগে, আমাদের প্রতিবেশী ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলের কক্ষপথ থেকে তখন সে ছিল বেশ কিছুটা দূরে। প্রদক্ষিণ করছে আমাদের সূর্যকে।
পাগলাটে এই ভবঘুরে ঢুকেছিল ৭০/৮০ বছর আগে!
বিজ্ঞানীদের অনুমান, বলা নেই, কওয়া নেই, একেবারেই অজানা, অচেনা ওই আগন্তুক আমাদের সৌরমণ্ডলে ঢুকে পড়েছিল খুব বেশি হলে ৭০/৮০ বছর আগে। তাকে দেখা তো দূরের কথা, ঢুকে পড়ার খরটাও আমরা এর আগে পাইনি!
আরও পড়ুন- চার বছরের মধ্যেই চাঁদের পাড়ায় ‘বাড়ি’ বানাচ্ছে নাসা!
এই পাগলা ঘোড়াটা কোথা থেকে এসে ঢুকে পড়েছে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে আমাদের ‘পাড়া’ এই সৌরমণ্ডলে, তা এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের অজানা। কেউ কেউ বলছেন, পৃথিবীর ধারেকাছেও সেই পাগলাটে ‘অতিথি’র চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, যদি আসেও, তা হলে আমাদের এই নীলাভ গ্রহটি থেকে সেই ক্ষ্যাপা থাকবে বড়জোর ১৯ কোটি মাইল বা ৩০ কোটি কিলোমিটার দূরে। তবে অনেকেরই ধারণা, মঙ্গলের কাছ থেকেই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে সেই ক্ষ্যাপা ঘোড়া ফিরে যাবে আবার আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমে। এমনকি, তা ঢুকে পড়তে পারে পরে আশপাশের অন্য কোনও তারামণ্ডলেও। ‘ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তাকে বাইনোকুলার বা খুব একটা শক্তিশালী নয়, এমন টেলিস্কোপেও খুব ভাল ভাবেই দেখা যাবে’, বলছেন কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-এর অধিকর্তা সন্দীপ চক্রবর্তী। তিনি এও জানিয়েছেন, এখনই সীতাপুরে, আকাশের পূর্ব থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ভোর সাড়ে তিনটে থেকে চারটের মধ্যে দেখা যাচ্ছে সেই পাগলা ঘোড়াকে।
পাগলা ঘোড়া ছুটছে ঝড়ের বেগে, অদ্ভুত ভাবেও...
শুধু এইটুকুই জানা সম্ভব হয়েছে সেই পাগলাটে আগন্তুক ছুটছে অসম্ভব গতিবেগে। সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিচ্ছে সে। যার চেহারাটা লম্বায় খুব বেশি হলে দেড় থেকে দু’কিলোমিটার। আর এমন একটা তল (প্লেন) ধরে সেই ক্ষ্যাপা ছুটছে যে, এই সৌরমণ্ডলের কোনও গ্রহ, উপগ্রহ, এমনকি তার ‘অধীশ্বর’ সূর্যও সেই তলে ঘোরে না। কোনও দিন সেই তলে ঘোরেনি, ঘুরবেও না। আমাদের গ্রহ, উপগ্রহগুলি ঘোরে ‘ইলিপ্টিক’ বা উপবৃত্তাকার কক্ষপথে।
তার ‘গায়ের গন্ধ’ নয় এই সৌরমণ্ডলের!
ওই প্রচণ্ড গতিবেগ আর অন্য একটি বিচিত্র তল ধরে ছোটা দেখেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন সেই পাগলা ঘোড়ার ‘গায়ের গন্ধ’টা আমাদের সূর্য, গ্রহ, উপগ্রহগুলির চেয়ে একেবারেই আলাদা। ফলে, বিজ্ঞানীরা সেই বিচিত্র আগন্তুক সম্পর্কে খুব বেশি কিছু এখনও জানতে না পারলেও, এইটুকু অন্তত বুঝেছেন, সে এসেছে আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে থেকে। ফলে, ‘বিদেশি’। বা, তার কোনও নিজস্ব দেশটেশ নেই। ব্রহ্মাণ্ডের একটা ক্ষ্যাপাটে ভবঘুরে!
এসেছে ভিন মুলুকের অজানা বার্তা নিয়ে...
তবে এই ‘পাগলা ঘোড়া’কে নিয়ে অসম্ভব কৌতূহল এখন বিজ্ঞানীদের। কেন? অশোক বলছেন, ‘‘এই ধূমকেতুরাই বার্তা বয়ে আনে। যে নক্ষত্রমণ্ডলে তার জন্ম হয়েছিল কয়েকশো কোটি বছর আগে, সৃষ্টির সময় সেই তারামণ্ডলে কী কী পদার্থ ছিল, তার খবর থাকে আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যম থেকে আসা ধূমকেতুদের কাছেই। কারণ, আদতে যে তারামণ্ডল তৈরির সময় তারা গড়ে উঠেছিল, সেখানকার নক্ষত্রের মধ্যে সব সময়েই ঘটে চলেছে ‘নিউক্লিয়ার ফিউশনে’র প্রক্রিয়া। তার ফলে, একেবারে সৃষ্টির সময় সেই তারামণ্ডলে কোন কোন পদার্থ ছিল, তা জানাটা এত শত কোটি বছর পর আর সম্ভব হয় না। কিন্তু ধূমকেতুরা সব তারামণ্ডলেই থাকে হাড়জমানো ঠান্ডার স্বর্গরাজ্যে। ফলে, অনেকটা রেফ্রিজারেটরের মতো সেই তারামণ্ডল সৃষ্টির সময়ের পদার্থগুলি অবিকৃত অবস্থায় থেকে যেতে পারে একমাত্র ধূমকেতুগুলিতেই।’’
ভিন মুলুকের ‘রানার’
সৌরমণ্ডলে ঢুকে পড়া এই ধূমকেতু ‘বরিসভ’ও আদতে সেই ভিন মুলুকের এক ‘রানার’। যার হাতে রয়েছে তার জন্মদাতা তারামণ্ডলের সৃষ্টি-রহস্যের গোছা গোছা মুখবন্ধ চিঠি। ওই রানার নিজেও জানে না, তার অন্দরে রয়েছে কী গুপ্তধন? কিন্তু আমাদের যত কাছে আসবে সে আর যত দিন ধরে তাকে দেখা যাবে, তত দিনই স্পেকট্রোস্কোপিক অ্যানালিসিসের মাধ্যমে তার ভিতরে থাকা পদার্থের অনুসন্ধান চলবে বলে জানাচ্ছেন ইলাহাবাদের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইনফরমেশন টেকনোলজির জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক পবন চক্রবর্তী।
এই সেই ভিন মুলুকের পাগলা ঘোড়া! ধূমকেতু ‘সি/২০১৯ কিউ-৪’ বা ‘বরিসভ’। ছবি সৌজন্যে: নাসা
কোথা থেকে এল এই পাগলা ঘোড়া?
বিজ্ঞানীরা এর ঘর-বাড়ি এখনও পর্যন্ত জানেন না সঠিক ভাবে। শুধু এইটুকুই তাঁদের অনুমান, এরা এসেছে আমাদের সৌরমণ্ডল ও তার আশপাশের তারামণ্ডলগুলির মধ্যে কোটি কোটি মাইল জুড়ে থাকা আন্তর্নক্ষত্র একটি মাধ্যম থেকে। দু’টি তারামণ্ডলের মাঝে থাকা সেই আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যম (ইন্টারস্টেলার মিডিয়াম) আদতে দু’টি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে থাকা ‘নো-ম্যান্স ল্যান্ড’। যে এলাকাকে প্রতিবেশী তারামণ্ডলের কোনওটিই তার নিজের এলাকা বলে দাবি করতে পারে না।
এই ভবঘুরের নেই ঘরবাড়ি, নেই কোনও দেশও!
ফলে, সেই আন্তর্নক্ষত্রপুঞ্জ মাধ্যম থেকে আমাদের সৌরমণ্ডলে না জানিয়ে আচমকা ঢুকে পড়া সেই পাগলাটে আগন্তুকেরও কোনও নির্দিষ্ট ‘দেশ’ বা তারামণ্ডল নেই। এমনকি নেই তার কোনও নির্দিষ্ট ঘর-বাড়িও। নো-ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা কোনও মানুষের যেমন পাসপোর্ট, ভিসা বা অন্যান্য পরিচয়পত্রগুলি স্থায়ী ভাবে কাজে লাগে না, এই ক্ষ্যাপা ঘোড়াদের দশাও তেমনটাই। কোটি কোটি বছর আগে কোন তারামণ্ডল থেকে তারা ছিটকে বেরিয়ে এসে ঢুকে পড়েছিল আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমে, চট করে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। কারণ, ক্ষ্যাপা ঘোড়ার ছেড়ে আসা সেই তারামণ্ডলের ‘বাসিন্দা’দের ‘পরিচয়পত্র’টা দেখতে কেমন হয়, সেটাই তো আমরা জানি না!
আরও পড়ুন- বায়ুমণ্ডল ফুঁড়ে বেরোচ্ছে জলের ধোঁয়া! রয়েছে প্রাণ?
পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার কোনও প্রত্যন্ত বাঙালি ঝকঝকে, ঝাঁ চকচকে লস এঞ্জেলসে গিয়ে বা কলকাতার বালিগঞ্জ বা রাজারহাটের বনেদি বাড়ির ছেলে মোজাম্বিকের গ্রামে গিয়ে টানা ১০/১২ বছর থাকলে আমুল বদলে যায় স্বভাবে, আচার, আচরণ, পোশাকআশাকে।
ঠিক তেমন ভাবেই নিজের তারামণ্ডল থেকে ‘গলা ধাক্কা’ খাওয়া এই ক্ষ্যাপা ঘোড়ারাও কোটি কোটি বছর ধরে আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমে থাকতে থাকতে বা এক তারামণ্ডল থেকে অন্য তারামণ্ডলে যেতে-আসতে গিয়ে তার আদত তারামণ্ডলের যাবতীয় ‘পরিচয়পত্র’গুলি হারিয়ে ফেলে।
এই ক্ষ্যাপার জন্য কারও স্নেহ নেই, নেই স্বজনও!
আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমের বিচিত্র পরিবেশ, ‘আবহাওয়া’, তাপমাত্রা, চাপ, আশপাশে থাকা মহাজাগতিক বস্তুগুলির টানের (অভিকর্য বল) বাড়া-কমা তাদের বদলে দেয়। স্বভাবে। আচার। আচরণে। বদলে দেয় তাদের মেজাজ, মর্জিও। কোনও ঘর নেই, বাড়ি নেই, নেই কোনও নিজস্ব দেশ, পরিবার, স্বজন, ফলে কোটি কোটি বছর ধরে আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমে থাকতে থাকতে বা এক তারামণ্ডল থেকে অন্য তারামণ্ডলে বার বার যেতে-আসতে গিয়ে তারা স্বভাবে, আচার, আচরণেও হয়ে যায় ক্ষ্যাপাটে। পাগলাটে। ভবঘুরে। কোনও দায় নেই, কারও দায়িত্বই যে তাদের বইতে হয় না কাঁধে!
কোথায় জন্ম এই ক্ষ্যাপাদের? কে তাদের মা, বাবা?
এখন চরম ক্ষ্যাপাটে হয়ে গেলে কী হবে, তারা বরাবরই ছিল না এমন পাগলাটে। ‘বরিসভ’-এর মতো ব্রহ্মাণ্ডের ভিন মুলুক থেকে সৌরমণ্ডলে ঢুকে পড়া বিচিত্র আগন্তুকদেরও এক সময় ঘর-বাড়ি ছিল। নিজের দেশ ছিল। মা, বাবা তো ছিলই! কিন্তু আমাদের সৌরমণ্ডল বা অন্য নক্ষত্রমণ্ডলগুলির সৃষ্টির সময় তারা গলা ধাক্কা খেয়েছিল। ছাড়তে হয়েছিল মা, বাবা, আত্মীয়স্বজন। ছাড়তে হয়েছিল ঘর, বাড়ি, দেশ। নিজেদের তারামণ্ডল। সাড়ে চারশো বা পাঁচশো কোটি বছর আগে আমাদের সৌরমণ্ডলের সৃষ্টির সময় বৃহস্পতি, শনির মতো বড় বড় গ্রহগুলি তাদের আশপাশে থাকা বা এসে পড়া ছোট ছোট পাথুরে বস্তুগুলিকে গলা ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল এই সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্তে। বলা যায়, নির্বাসনে। যে জায়গাটাকে বলা হয় ‘ওরট ক্লাউড’। পুরু বরফের একটি সুবিশাল গোলক। ত্রিমাত্রিক। যার মানে, তার উচ্চতাও রয়েছে।
গলা ধাক্কা খাওয়া সেই হতভাগ্য পাথুরে বস্তুগুলি গিয়ে জমা হল সেই ওরট ক্লাউডে। অত দূরে থাকায় সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছয় না বললেই চলে। তাই হাড়জমানো ঠান্ডায় তাদের শরীরটাও ঢেকে গেল পুরু বরফের আস্তরণে। তারাই হয়ে উঠল এক একটা ধূমকেতু। এরাই সূর্যকে ‘প্রণাম’ করতে আসে নির্দিষ্ট সময় অন্তর। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তারা ফিরে যায় তাদের স্বর্গরাজ্যে। আবার ফিরে আসে সূর্যের কাছে। যেমনটা এসেছিল ‘হ্যালির ধূমকেতু’।
সূর্যপ্রণামে এলে চড়া দক্ষিণা দিতে হয় ধূমকেতুদের!
আর সূর্যপ্রণামে’ এলে বেশ চড়া মূল্যে ‘দক্ষিণা’ও দিতে হয় ধূমকেতুগুলিকে। সূর্যের তাপ তার গায়ের বরফটা গলিয়ে দেয়, যত বার তার কাছে আসে, তত বারই। তাই প্রথম বার দেখার সময় বরফের উপর সূর্যের আলো পড়ায় যতটা ঝকঝকে দেখি কোনও ধূমকেতুকে, সেই ধূমকেতুই পরে সূর্যের কাছে ফিরে এলে তাকে আমরা ততটা উজ্জ্বল দেখি না।
সেই ভিন মুলুকের ধূমকেতু। দেখুন ভিডিয়ো
ধূমকেতুদের স্বর্গরাজ্য কত দূরে?
আমাদের সৌরমণ্ডল ব্রহ্মাণ্ডে যতটা দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে বলে আমরা জানি (ব্যাসার্ধ ১০০ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (এইউ)। এক ‘এইউ’ বলতে বোঝায়, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব বা ১৪ কোটি ৯৫ লক্ষ ৯৭ হাজার ৮৭১ কিলোমিটার), তার পর বিশাল একটি এলাকা জুড়ে রয়েছে শূন্যতা। ‘জনমনিষ্যি’ নেই গোছের অবস্থা। সূর্য থেকে সেই এলাকাটার দূরত্ব এক লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ এইউ-এর মধ্যে। তার পরেই সেই ওরট ক্লাউড। ধূমকেতুদের স্বর্গরাজ্য!
এক দল বিজ্ঞানী বলেন, জায়গাটা আমাদের সৌরমণ্ডলের নয়। আর যে বিজ্ঞানীরা গ্যালাক্সি নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা বলেন, ওরট ক্লাউড থাকে কম-বেশি সব তারামণ্ডলেরই। আর সেই এলাকাটা সেই তারার ‘সীমান্তে’ (বা সেই তারামণ্ডলের মানচিত্রের) মধ্যেই পড়ে।
স্বর্গরাজ্য থেকেই গলাধাক্কা খেতে হয় কাউকে কাউকে...
আবার সেই ওরট ক্লাউডের কাছাকাছি যখন অন্য কোনও তারামণ্ডল বা কোনও মহাজাগতিক বস্তু এসে পড়ে, তখন তাদের টানে (অভিকর্য বল) আমাদের ধূমকেতুদের তারা ওরট ক্লাউড থেকে টেনে বের করে দেয় আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমে। সেই সংখ্যাটা কত হতে পারে, আজ থেকে ২৭ বছর আগে কম্পিউটার সিম্যুলেশনের মাধ্যমে প্রথম তার একটা হিসেব দিয়েছিলেন আরও এক বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী। বলেছিলেন, ওরট ক্লাউডের প্রতি ৪০০টি ধূমকেতুর মধ্যে অন্তত ১৫টি এই ভাবেই ছিটকে যায় আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমে। মানে, প্রায় ৪ শতাংশ।
তাঁর গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছিল ১৯৯২ সালে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘মান্থলি নোটিসেস অফ দ্য রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’-তে। শিরোনাম ছিল, ‘প্রপার্টিজ অফ ওরট ক্লাউড অ্যান্ড দ্য অরিজিন অফ কামেট্স’। তবে সন্দীপের বক্তব্য, ‘‘দু’বছরে এমন মাত্র দু’টির হদিশ মিলল। আমার হিসেবের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে কি না, তা জানতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। যদি মেলে, তা হলে বুঝতে হবে সূর্যের আশাপাশে থাকা অন্য তারামণ্ডলগুলিতেও রয়েছে গ্রহ, উপগ্রহ।’’
বৃহস্পতির মতো বড় গ্রহগুলি গলা ধাক্কা দিয়ে কাছে থাকা ধূমকেতুগুলিকে পাঠিয়ে দেয় ওরট ক্লাউডের দিকে। সেই সংখ্যাটা যদি হয় ১০০, তা হলে তার মধ্যে মাত্র পাঁচটি আটকা পড়ে থাকে ওরট ক্লাউডে। একই ভাবে আশপাশের নক্ষত্রমণ্ডল থেকেও গলা ধাক্কা খেয়ে বেরিয়ে আসছে এমন সব ধূমকেতু।
‘এমন পাগলা ঘোড়ার অন্তত একটির দেখা মিলবে ২০০ বছরে’
সেই সময়ই দুই বিদেশি বিজ্ঞানী ম্যাগলিন ও চ্যাপম্যানই প্রথম বলেন, আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমে থাকা অমন লক্ষ কোটি ধূমকেতুর মধ্যে তো বেশ কয়েকটির ঢুকে পড়ার কথা আমাদের সৌরমণ্ডলে। তা হলে খালি চোখে ও টেলিস্কোপ দিয়ে ধূমকেতু দেখার ১৫০ বছর পরেও কেন এমন একটিও ধূমকেতু ধরা পড়ল না আমাদের চোখে?
সেখান থেকেই গবেষণা শুরু করেন দুই অধ্যাপক নারায়ণ রানা ও অশোক সেন। তাঁরা দেখান, ২০০ বছরের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের ভিন মুলুক থেকে আসা এমন অন্তত একটি ধূমকেতু আমাদের টেলিস্কোপে ধরা পড়বেই। সেই ২০০ বছরের মধ্যে ১৫০ কেটে গিয়েছিল ১৯৯৩-এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার সময়েই।
‘বরিসভ’ ধূমকেতু, এসেছে আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যম থেকেই
পবন বলছেন, ‘‘ওই সময়ের বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে এও জানা যায়, আমাদের সৌরমণ্ডল সৃষ্টির সময় ওরট ক্লাউড থেকে গলা ধাক্কা খেয়ে আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমে গিয়ে জমা হয়েছিল এক-এর পিঠে ১৪টি শূন্য বসালে যে বিশাল সংখ্যাটা হয়, ততগুলি ধূমকেতু। আর আমাদের ওরট ক্লাউডে এখনও জমা রয়েছে এক-এর পিঠে ১২টি শূন্য বসালে যে বিশাল সংখ্যাটা হয়, ছোট, বড় ততগুলি ধূমকেতু।’’
অশোকের বক্তব্য, সেই পূর্বাভাসের ২৪ বছর পর, ২০১৭-য় আমাদের নজরে এসেছিল ‘ওমুয়ামুয়া’। সেও ছিল আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যম থেকে আসা অতিথি। তবে তার কোনও বরফ ছিল না। অনেকটা ‘সিগার’-এর মতো চেহারার ‘ওমুয়ামুয়া’ ধূমকেতু কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে।
সন্দীপ ও অশোক দু’জনেই বলছেন, ‘‘বরিসভ কিন্তু আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যম থেকে আসা একটি ধূমকেতুই। যা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ফিরে যাবে আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমে। তাই একে অতিথিই বলব। যে তল ধরে এই ধূমকেতু ছুটছে, তাতে আমাদের সৌরমণ্ডলে বাঁধা পড়তে তার কোটি কোটি বছর সময় লেগে যাবে।’’
এমন ‘পাগলা ঘোড়া’র সংখ্যা আরও বাড়বে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা
সন্দীপ ও পবন অবশ্য বলছেন, ‘‘২৬ বছর আগের গবেষণাপত্রে (নারায়ণ রানা ও অশোক সেন) বলা হয়েছিল আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যম থেকে আসা এমন ক্ষ্যাপা ঘোড়াদের একটিকে অন্তত দেখা যাবে ২০০ বছরের মধ্যে। অথচ, গত দু’বছরেই এমন দু’টি (ওমুয়ামুয়া ও বরিসভ)-র দেখা মিলল। টেলিস্কোপের সংখ্যা ও তার ক্ষমতা গত তিন দশকে অনেকটাই বেড়েছে। নিয়মিত ভাবে আকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী পাওয়া সম্ভব হলে ওই ভিন মুলুকের অতিথিদের দেখা মেলার সংখ্যাটা বেড়ে গিয়ে বছরে ৫/৬টি হলেও অবাক হব না।’’
যদিও অশোকের দাবি, তাঁরা হিসেবটা কষেছিলেন সবচেয়ে কম ক’টি দেখা যেতে পারে, তার ভিত্তিতে।
তবে এক হোক বা একাধিক, ‘রানার’রা ঢুকে পড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। ফলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে আশা জেগেছে অন্য তারামণ্ডল কী ভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এ বার তার বার্তা হয়ত আমরা পৃথিবীতে বসেই পেয়ে যাব। সেই আশার কথাই ধরা পড়ল পবনের বক্তব্যে। বললেন, “আমাদের সবচেয়ে কাছের তারামণ্ডল আলফা সেন্টাওরিতে যেতে এখনকার প্রযুক্তিতে অন্তত ৪০ হাজার বছর লাগে। ফলে সেখান গিয়ে সেই তারামণ্ডল সৃষ্টির সময় ঠিক কোন কোন পদার্থ ছিল তার অনুসন্ধান করার কাজটা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। সৌরমণ্ডলের বাইরে থেকে এই ভাবে ‘রানার’রা বার্তা এনে দিলে আমাদের কাজটা তো অনেক সহজ হয়ে যাবে।”
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy