এ যুগের ‘হলমার্ক’ একাকিত্ব।
করোনাভাইরাসের দৌলতে আজকাল একা থাকা ব্যাপারটা অনেক প্রকট। আগেও একাকিত্ব ছিল না এমন তো নয়, তবে এই মুহূর্তে সমস্যাটা অনেক বেশি সামনে চলে এসেছে— প্রত্যেক পরিবারে, প্রত্যেক পাড়ায়। একাকিত্ব আমাদের যুগের একটা ‘হলমার্ক’ বললে খুব ভুল হবে না। সিগারেট খাওয়া, ডায়াবেটিস, বা স্থূলতার মতো একাকিত্বও মানুষকে কুরে কুরে খায়, এবং অকালমৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে প্রায় তিরিশ শতাংশ।
একাকিত্বকে মোটামুটি এক সামাজিক অসুখের পর্যায়ে ফেলে ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর প্রথম ‘একাকিত্বের মন্ত্রী’ পদ তৈরি করেন গত বছর । চিন ও জাপানের অনেক শহরে মানুষের মাপের পুতুল/ রোবট শুধু বাচ্চাদের জন্যেই নয়, বড়দের জন্যেও বিক্রি হয়। উদ্দেশ্য একটাই— যাতে একা না লাগে। কিন্তু একা না থাকার , একা না লাগার জন্যে যে এত চেষ্টা, তাতে একটা প্রশ্ন ওঠে। কোথা থেকে আসে এই ‘অন্যদের চাহিদা ’?
এই চাহিদার খোঁজে আমাদের চলে যেতে হবে মানুষের ছোটবেলায়— মোটামুটি জন্মলগ্নে। নব্বইয়ের দশকে জন মর্টন আর মার্ক জনসন নামের দুই বৈজ্ঞানিক সদ্যজাত শিশুদেরকে নিয়ে খুব সুন্দর সহজ একটা পরীক্ষা করেন। ওঁরা একটা গোল করে কাটা কাগজে একটা মানুষের মুখের প্রতিকৃতি আঁকেন। দুটো চোখ, একটা মুখ— ঠিক যেমন আমরা তাড়াহুড়ো করে আঁকি। অন্য আর একটা কাগজে ওঁরা আঁকেন আর একটা প্যাটার্ন — যাতে সব লাইন এবং আকৃতির সংখ্যা সমান থাকলেও সম্পূর্ণ ছবিটা একদমই মুখের মতো নয়। সদ্যজাত বাচ্চাদের যখন এই দু়’টি ছবি একটার পরে একটা দেখানো হয়, তখন তারা মুখাকৃতি ছবিটাকে অনেক বেশি মন দিয়ে দেখে, এবং অনুসরণ করে। অন্য ছবিটাতে সমান সংখ্যার লাইন ইত্যাদি থাকা সত্বেও বাচ্চারা তাতে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করে না। অন্য মানুষের প্রতি এই যে জন্মগত আগ্রহ, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই পরীক্ষা থেকে। পরবর্তী বছরগুলিতে এই ‘অন্যাগ্রহ’ কে অনেক বিশদ ভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে— এবং প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে দৃষ্টিমাপক (আইট্র্যাকার) এবং মস্তিস্কপ্রবাহমাপক (ইইজি) যন্ত্রের সাহায্যে।
আরও পড়ুন: করোনায় ক্ষতি হয় কিডনির, কী কী উপায়ে সচেতন হবেন
খেয়াল রাখা দরকার, যে কোনও কিছু জন্মগত মানেই যে জীবদ্দশায় তার কোনও তারতম্য ঘটবেনা তা একেবারেই নয়। এক্ষেত্রে ‘অন্যাগ্রহ’-ও কোনও ব্যতিক্রম নয়। ঠিক যে সময়ে মর্টন আর জনসন নিজেদের পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন , গ্লাসনস্ত পেরেস্ত্রোইকার প্রভাবে সোভিয়েত সাম্রাজ্য ও সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল। এ সময়ে রোমানিয়া থেকে বহু অনাথ ছেলেমেয়ে চলে আসে ব্রিটেনে। ছোটবেলার নিদারুণ কষ্টের অভিজ্ঞতা ছাপ রেখে যায় এদের মনে— আর অনেকের মধ্যেই দেখা যায় এই সহজাত অন্যাগ্রহের অভাব। অন্যান্য অনেক ব্যক্তিগত বৈশিষ্টের মতো এতেও প্রকৃতি ও প্রতিপালন (পাশ্চাত্যের ‘নেচার ও নার্চার’, আমাদের শাস্ত্রে ‘ভাগ্য ও পুরুষকার’-এর সমকক্ষ), দুইয়েরই হাত রয়েছে। প্রতিপালন-এর দিকটা বোঝা অপেক্ষাকৃত ভাবে সহজ। যদি কোনও বাচ্চা ছোটবেলা থেকে দুর্ব্যবহার বা অবহেলার শিকার হয়ে থাকে, তার পক্ষে অন্যদের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মানো স্বাভাবিক। তাই সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যে রকম প্রয়োজন শারীরিক পুষ্টির, ততটাই প্রয়োজন মানসিক পুষ্টির— যার অন্যতম সূচক হল অন্যদের প্রতি আগ্রহ। বিজ্ঞানের কাছে অনেক কঠিন প্রশ্ন হল এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রকৃতির প্রভাবকে বোঝা। কী করে নির্ধারিত হয় আমাদের এই সহজাত আগ্রহ একে অপরের প্রতি?
ডারউইন-এর ক্রমবিবর্তন (‘ইভলিউশন’) তত্ত্বের পরিকাঠামো থেকে ভাবলে ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়ায়। লক্ষাধিক বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা জোট বেঁধে থাকার সুবিধাগুলো অনেকটা ঠেকেই শিখেছিলেন। আমরা মানুষেরা না বাঘ-সিংহের মতো শক্তিশালী, না হরিণ-ঘোড়ার মতো দ্রুতগামী। কিন্তু একজোট হয়ে থাকলে আমরা বিপদসংকুল জঙ্গলেও নিজেদের একটা জায়গা করে নিতে পারি। ক্রমবিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী যারা এই জোটবদ্ধ হওয়ার সুবিধাগুলো শেখেনি , তারা বা তাদের উত্তরসূরীরা আর আমাদের মধ্যে নেই। সুতরাং আমাদের অন্যদের প্রতি এই জন্মগত আগ্রহের প্রাথমিক কারণ আমাদের নিজেদের বাঁচার তাগিদ। বাঘ ভাল্লুকের ভয় এখন সেরকম না থাকলেও এই অন্যদের চাহিদা এখন আমাদের মজ্জাগত। ডারউইনীয় ব্যাখ্যার একটাই অসুবিধা যে, এই ব্যাখ্যাকে ঠিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা যায় না।
যে কোনও প্রবৃত্তির আসল হদিশ পেতে গেলে আমাদের যেতে হবে রসায়নের দুনিয়ায়।বলিউডের চলচ্চিত্র ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’-এর প্রধান চরিত্র শেষ দৃশ্যে এসে বোঝে যে, নিজের মাথার মধ্যে ‘কেমিক্যাল লোচা’ র জন্যই সে মাঝে মাঝে গাঁধীজিকে দেখতে পেত। আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে আমাদের প্রত্যেকের মাথার মধ্যে যে সব ভাবনাচিন্তা চলে, যা প্রবৃত্তি প্রকাশ পায়, সবার ভিতরে চলছে বিভিন্ন রকমের রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ। বিভিন্ন রকম ইঁদুরের উপর গবেষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই বৈজ্ঞানিক ল্যারি ইয়াং ও টম ইনসেল এই সহজাত অন্যাগ্রহের চাবিকাঠি খুঁজে পান দু’টি প্রোটিনে — তাদের নাম অক্সিটোসিন এবং ভ্যাসোপ্রেসিন। মস্তিষ্কের কতগুলো বিশেষ অংশ আমাদের খুশি বা আনন্দের অনুভবের জন্য খুব দরকারি। যখন ফেলুদাকে কোনও রহস্যের জট খুলতে দেখি, বা আরসালানে বিরিয়ানি খাই— আমাদের পরিতোষের পরিকাঠামো জোগায় ভেন্ট্রাল স্ট্রায়াটাম আর অরবিটোফ্রন্টাল কর্টেক্স নামের মস্তিষ্কের এই অংশগুলো। মস্তিষ্কের এই ‘আনন্দ-অংশ’গুলোতে কী ভাবে কতটা অক্সিটোসিন আর ভ্যাসোপ্রেসিন নিঃসরণ হচ্ছে, তা দিয়েই অনেকটা নির্ধারিত হয় কে কতটা অন্যদের প্রতি আগ্রহী। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাহায্যে এই প্রোটিনগুলোকে যদি উদ্ভব হওয়া থেকে আটকানো যায়, তা হলে দেখা যায় সেই ইঁদুরগুলোর একে পরস্পরের প্রতি ব্যবহার নিতান্তই অদ্ভুত। মানুষদের উপর পরীক্ষা চালিয়ে ইসরায়েলের বৈজ্ঞানিক রুথ ফেল্ডম্যান দেখান যে, বাবা-মায়েরা যখন তাঁদের ছোট শিশুদের সঙ্গে খেলেন, তখন তাঁদের মধ্যে অক্সিটোসিনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। তবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, এই দু’টি প্রোটিন কিন্তু যে কোনও রকমের আনন্দ অনুভবের সঙ্গে যুক্ত নয়। রসগোল্লা খেলে তৃপ্তি হয় ঠিকই, তবে তাতে অক্সিটোসিনের কোনও হাত নেই। কয়েক বছর আগে আমরা এই সূত্র ধরে চেষ্টা করি এই অন্যের প্রতি আগ্রহকে রাসায়নিক ভাবে বদলানোর। পরীক্ষাটা আপাত ভাবে সহজ— অংশগ্রহণকারীরা একটা ‘ইনহেলার’থেকে শ্বাসগ্রহণ করে নিয়ে পরীক্ষকের সঙ্গে স্কাইপে কথা বলবেন। ইনহেলারের মধ্যে দেওয়া আছে অক্সিটোসিন অথবা প্লাসিবো, তবে যাঁরা অংশ নিচ্ছেন তাঁরা কেউ সেটা জানেন না। বিশ্লেষণের পরে আমরা দেখি— যাঁদেরকে অক্সিটোসিন দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা অনেক বেশি অন্যদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন। অন্যের প্রতি আগ্রহকে সম্পূর্ণ ভাবে ল্যাবরেটরিতে মাপা সোজা নয়, তবে আগ্রহ বেশি থাকলে আমরা অন্যদের চোখের দিকে বেশি তাকাই।
আরও পড়ুন: দীর্ঘতম দিনে সূর্যগ্রহণে বাধা হবে কি বৃষ্টি
যেখানে শুরু করেছিলাম, সেখানে ফেরা যাক। এই লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেরই মন কেমন করছে অন্যদের সঙ্গে দেখা করার, সঙ্গ পাওয়ার। কিন্তু এই অন্যের চাহিদার মধ্যেও আছে অনেক ব্যক্তিগত তারতম্য— কেউ কেউ বাড়িতে ছটফট করছেন, আবার কেউ কেউ মনে মনে খুশি-ই আছেন লোকজনের সংস্পর্শ থেকে দূরে থেকে। এই পার্থক্যের ভিতরে হাত সেই প্রকৃতি এবং পরিপালনের। প্রকৃতির তরফে অক্সিটোসিন এবং ভাসোপ্রেসিন সংক্রান্ত জিন-এর সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ প্রভেদে ফারাক পড়তে পারে, কে কতটা চায় অন্যদের। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই ধরণের জিন-গত কারণে প্রকট হয় বিভিন্ন রকমের মানসিক অসুবিধা। অটিজমে প্রভাবিত ছেলেমেয়েরা এর নিদর্শন। এদের অনেকের মধ্যেই অন্য মানুষের সঙ্গ পাওয়ার চাহিদা কম থাকে। আবার পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ, জীবনের বিভিন্ন ঘটনাও বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে এই চাহিদার ওপর।
আরও বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতে ভাবলে দেখতে পাই বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন সমাজের নীতিনিয়মের পার্থক্য। বাঙালি সমাজে বা দক্ষিণ ইউরোপের সমাজে আড্ডা মারার কালচারের মূলেও হল অন্যের সঙ্গ পাওয়ার চাহিদা। কিন্তু এর পিছনেও কি জিন-এর কেরামতি, নাকি কোনও কোনও সমাজব্যবস্থায় ‘সামাজিক’ হওয়াকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়? এই প্রশ্ন তোলা থাক পন্ডিতদের জন্য। আপাতত স্কাইপ বা হোয়াটস্যাপ-এর সাহায্যে মনুষ্যসঙ্গের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাক কিছুদিন।
(লেখক ইউনিভার্সিটি অব রিডিং-এর স্কুল অব সাইকোলজি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ-এর অধ্যাপক )
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy