এখন হার্ড ইমিউনিটি বাড়িয়ে নেওয়া দরকার। ফাইল চিত্র।
এ বার মনে হচ্ছে একটু দিশাহীন হয়ে পড়ছে পরিকল্পনাটা। সার্স-কোভ-২-এর দ্রুত সংক্রমণ রুখতে লকডাউন একটা সময় পর্যন্ত খুব জরুরি ছিল। কিন্তু এখন আর নতুন করে লকডাউনে গিয়ে কিন্তু কোনও লাভ হওয়ার নেই। বরং ক্ষতিই হচ্ছে। অর্থনীতির কী ক্ষতি হচ্ছে, দেশের অর্থব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে কি না, আমি কিন্তু সে সব নিয়ে বলছি না, ওগুলো আমার বিষয় নয়। আমি বলছি এই রোগের মোকাবিলার কৌশল সম্পর্কেই। এবং নতুন করে লকডাউন এখন রোগের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইকে কী ভাবে সাহায্য করছে, সেটা আমার কাছে আদৌ পরিষ্কার নয়। কোভিড মোকাবিলার কৌশল নিয়ে আমার মতো যাঁরা গোটা বিশ্বে কাজ করছেন বা ভাবছেন, তাঁদেরও অনেকেরই এটাই মত।
আমার প্রশ্ন হল, হঠাৎ হঠাৎ এক দিন-এক দিন করে লকডাউনে গিয়ে কী লাভ? আমার মনে হয় এতে কোনও লাভ হচ্ছে না। যে কোনও পরিকল্পনার মধ্যে তো একটা যৌক্তিক ভিত্তি বা একটা কার্যকারণ সম্পর্ক থাকা দরকার। এই হঠাৎ হঠাৎ লকডাউনে গিয়ে কী উপকার হচ্ছে, যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে আমি তা বুঝতে পারছি না।
লকডাউন কিন্তু জরুরি ছিল, একটা সময় পর্যন্ত সত্যিই জরুরি ছিল। কারণ এ রোগটা তো নতুন। এর মোকাবিলার কোনও পরিকাঠামো আমাদের কাছে ছিল না। পরিকাঠামো বাড়িয়ে নেওয়া দরকার ছিল। কোভিড মোকাবিলার জন্য যে সব উপকরণ (ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন) এবং সরঞ্জাম দরকার, সে সব পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত করে নেওয়া এবং দেশের সর্বত্র প্রয়োজন মতো পৌঁছে দেওয়ার দরকার ছিল। আমাদের হাসপাতালগুলোয় যত শয্যা রয়েছে, সেগুলোর একটা অংশকে কোভিড আক্রান্তদের জন্য নির্দিষ্ট করে নেওয়ার দরকার ছিল। স্থায়ী ব্যবস্থাপনা না হোক, অস্থায়ী ভাবে পরিকাঠামো বাড়িয়ে কোভিড আক্রান্তদের দেখভালের বন্দোবস্ত করা দরকার ছিল। তার জন্য কিছুটা সময় নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কারণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে কোভিড মোকাবিলার মতো করে গুছিয়ে নেওয়ার আগেই যদি রোগের সংক্রমণ হু হু করে বাড়ত, তা হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেত না। কোনও চিকিৎসা না পেয়েই মানুষ মারা যেত। মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ত।
প্রতিষেধক, ওষুধ কোনওটাই এখনও পর্যন্ত তৈরি হয়নি। ফাইল চিত্র।
লকডাউন করে সেইটা আমরা আটকে দিতে পেরেছি। কয়েক মাস গোটা দেশকে মোটের উপর ঘরবন্দি করে রেখে সংক্রমণের গতি কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হল। সেই ফাঁকে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোটাকে যতটা সম্ভব গুছিয়ে নেওয়া হল। তার পরে আনলক প্রক্রিয়া শুরু করা হল। অর্থাৎ এ বার আমরা অনেক মানুষের চিকিৎসার জন্যই প্রস্তুত।
আরও পড়ুন: করোনা মোকাবিলায় কলকাতায় শুরু হল অ্যান্টিজেন টেস্ট, দ্রুত শনাক্ত হবে রোগী
কিন্তু সংক্রমণ কমছে না দেখে এখন আবার নতুন করে লকডাউন শুরু করা হচ্ছে দেখছি। এটা কিন্তু কোনও কাজের কথা নয়। কারণ সংক্রমণ এ ভাবে আটকে রাখা যাবে না। একটা অতিমারিকে এ ভাবে রোখা যায় না। কোভিড রোখার জন্য কী লাগবে? হয় একটা ভ্যাকসিন (প্রতিষেধক) লাগবে, যার মাধ্যমে আমরা কৃত্রিম ভাবে গোটা জনসংখ্যাকে কোভিডের বিরুদ্ধে ‘ইমিউনড’ করে নিতে পারব। অর্থাৎ ভ্যাকসিন নিয়ে আমরা নিজেদের শরীরে কোভিড প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে নিতে পারব। অথবা একটা ওষুধ বা একটা নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি লাগবে, যা এই ভাইরাসকে নির্মূল করতে সক্ষম। এখনও পর্যন্ত এই দুটোর কোনওটাই আমাদের হাতে নেই।
তা হলে উপায় কী? লকডাউন? শোনা যাচ্ছে যে এই লকডাউন এর কারণে সংক্রমণের শৃঙ্খল (চেন অব ট্রান্সমিশন) ভাঙা যাবে। এই ধারণাটা কি সত্যি? সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙতে পারলে অবশ্যই সংক্রমণের বিস্তার কমানো যাবে। কিন্তু, আমার মনে হয় না যে হঠাৎ হঠাৎ এক দিন লকডাউন করে সংক্রমণের শৃঙ্খল উল্লেখযোগ্যভাবে ভাঙা সম্ভব। ভ্যাকসিন বাজারে আসতে কত দিন লাগবে আমরা কেউ জানি না। বেশ কয়েকটা দেশ ভ্যাকসিন তৈরি করে তার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করেছে। ভারতও সেই প্রক্রিয়ার অংশীদার। কিন্তু ভ্যাকসিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনেকগুলো পর্যায় রয়েছে। সব সফল হওয়ার পরে ভ্যাকসিন বাজারে আসার প্রক্রিয়াও খুব সহজ-সরল নয়। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেও কি ভ্যাকসিন বাজারে আসবে? কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং সে আশা কমই বলা চলে। তা হলে আর লকডাউনে গিয়ে লাভ কী? গোটা বছরটা তো আর আমরা সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারব না।
এখন একমাত্র পথ হল ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি করা। অর্থাৎ গোটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাকৃতিক ভাবেই রোগটা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি হতে দেওয়া। সেটা কী ভাবে সম্ভব? কোভিড যত বেশি মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হবে, আমরা ততই হার্ড ইমিউনিটির কাছাকাছি পৌঁছব। কোনও ভাইরাস কারও দেহে সংক্রামিত হলে তাঁর শরীরে ওই ভাইরাস প্রতিরোধ করার শক্তিও তৈরি হতে থাকে। সংক্রামিত হওয়ার পরেও সুস্থ হয়ে উঠলেন মানে আপনার শরীরে ভাইরাসটা হেরে গেল এবং ওই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা জিতে গেল। কোনও কোনও রোগের ক্ষেত্রে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা সারা জীবন থেকে যায়। কোভিডের ক্ষেত্রে তা কত দিন পর্যন্ত থাকে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে নেই। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য ইমিউনিটি তৈরি হয় তো বটেই। অতএব এখন যদি সংক্রমণটা তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে এবং দেশের অধিকাংশ মানুষ যদি সংক্রামিত হন, তা হলে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতাটাও তৈরি হয়ে যাবে। বহু মানুষকে সংক্রামিত করতে করতে এই ভাইরাসটা এক সময়ে দেখবে যে, সে আর নতুন করে কারও দেহে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে না। তখন স্বাভাবিক নিয়মেই সে নির্মূল হয়ে যাবে। এটাকেই বলা হয় ‘হার্ড ইমিউনিটি’। লকডাউন কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটায় বাধা দিচ্ছে।
লকডাউনের ফাঁকে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোটাকে যতটা সম্ভব গুছিয়ে নেওয়া। ফাইল চিত্র।
কোনও বড় জনসংখ্যার মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হওয়ার জন্য সেই জনসংখ্যার অন্তত দুই-তৃতীয়াংশকে ইমিউনড (প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন) হয়ে উঠতে হয়। কিন্তু তার জন্য তো ভাইরাসটার স্বাভাবিক সংক্রমণ জরুরি। লকডাউনের মাধ্যমে জোর করে সংক্রমণের সেই স্বাভাবিক গতিটাকেই আমরা আটকে দিচ্ছি। ফলে হার্ড ইমিউনিটির দিকে আমাদের এগোনোটা আরও বিলম্বিত হচ্ছে।
যে কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ একটা নির্দিষ্ট দিনে তুঙ্গে ওঠে। অর্থাৎ একটা ভাইরাস যত দিন কারও শরীরে থাকে, তার মধ্যে একটা সময় পর্যন্ত ওই শরীরে তার সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। নির্দিষ্ট দিনে সেটা সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছয়। তার পরে ক্রমশ কমতে কমতে নির্মূল হয়ে যায়। যে দিন সংক্রমণটা তুঙ্গে পৌঁছয়, সেই দিনটাকে 'পিক' বলে। কোভিডের ক্ষেত্রে এই পিক-টা কোন দিনে হয়, এখনও জানা যায়নি। ১৪ দিন থেকে ২১ দিন এই ভাইরাস কারও শরীরে থাকে। এর মধ্যে কোন দিনটা পিক, তা এখনও স্পষ্ট নয়। যদি স্পষ্ট হত, তা হলে হঠাৎ হঠাৎ লকডাউনে লাভ হতে পারত।
হয়তো দেখা গেল, দৈনিক সংক্রমণের যে হিসেব, তাতে আজ খুব বেশি সংখ্যক লোকের সংক্রামিত হওয়ার খবর এসেছে। এর পাশাপাশি হয়তো আমরা এও জানি যে, কোভিড সংক্রমণ পিকে ওঠে পঞ্চম দিনে। তা হলে আজকের পর থেকে পঞ্চম দিনে গিয়ে লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়া যেত। কারণ একসঙ্গে অনেক মানুষের দেহে ওই দিন সংক্রমণ তুঙ্গে থাকবে। সে ক্ষেত্রে ওই দিন তাঁদের থেকে আরও অনেকে সংক্রামিত হবেন। হঠাৎ লকডাউন করে সেটা আটকে দেওয়া যাবে।
আরও পড়ুন: অযোধ্যায় ভূমিপূজার আগেই বিপত্তি, মন্দিরের পুরোহিত ও ১৪ পুলিশকর্মী করোনা আক্রান্ত
কিন্তু এই সংক্রমণ কবে তুঙ্গে পৌঁছয়, সে সম্পর্কেও তো যথেষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই। তা হলে কিসের ভিত্তিতে খেয়ালখুশি মতো এক দিন-এক দিনের এই লকডাউন! এর কোনও যুক্তি আমি অন্তত খুঁজে পাচ্ছি না।
প্রথমে যে লকডাউন শুরু হয়েছিল, তার লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে আয়ত্তের মধ্যে আনা। সেটা যখন এসে গিয়েছে, তখন আর লকডাউন করে কী লাভ? এতে তো ভাইরাসের স্বাভাবিক সংক্রমণটাকে আরও দেরি করিয়ে দিচ্ছি আমরা। অনেকে হয়তো ভাবছেন, এই ভাবে সংক্রমণটাকে একটু একটু করে আটকাতে আটকাতে ভ্যাকসিনটা এসে যাবে। সেটা একটা যুক্তি হতে পারে। কিন্তু আবার বলছি, কত দিনে ভ্যাকসিন আসবে, কেউ জানে না। এই বছরের মধ্যে ভ্যাকসিন বাজারে আসবে, এমন আমরা মনে করছি না। সুতরাং হার্ড ইমিউনিটির দিকে এগনোই এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত।
লেখক: ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর প্রেসিডেন্ট তথা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিকস্, কল্যাণীর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক (ন্যাশনাল সায়েন্স চেয়ার)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy