Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Venus

শুকতারায় প্রাণ?

শুক্রগ্রহের মেঘের স্তরে মিলেছে ফসফিন। কিছু ব্যাকটিরিয়াও তৈরি করতে পারে এই গ্যাসগালিলেয়ো দেখেছিলেন, শুক্র গ্রহ কেমন যেন দুর্ভেদ্য। মনে হয়, ঘন মেঘের আস্তরণে ঢাকা। মাটি দেখা যায় না।

অনির্বাণ মিত্র
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২০ ০২:৫৮
Share: Save:

আমরা কি একা এই চরাচরে? অন্য গ্রহে কি আছে প্রাণের বসতি? এই প্রশ্নের তাড়নায় দুনিয়াসুদ্ধ গবেষকরা কত কসরতই না করেছেন! পাহাড়ের ওপরে ইয়া বড় টেলিস্কোপ বসিয়ে তাতে চোখ রেখেছেন, মহাকাশে পাড়ি দিয়েছেন, মহাবিশ্বে সঙ্কেতবার্তা পাঠিয়েছেন! রহস্য সমাধান হয়নি।

১৬১০ সাল, ইটালির পাদুয়া শহর। নিজের তৈরি দূরবিনে চোখ রেখে গালিলেয়ো দেখলেন যে, শুক্র কেমন যেন দুর্ভেদ্য, মনে হয় ঘন মেঘে ঢাকা, তাই তার মাটি দেখাই যায় না। শুক্রের আকাশে তা হলে ঘন মেঘ? আর মেঘ মানেই বৃষ্টি। তার মানে নিশ্চয়ই শুক্রতে খুব বৃষ্টি হয়। তার মানে শুক্রের ভূপৃষ্ঠ ডোবা আর জলাভূমিতে ভর্তি। আর চার দিকে যখন এত জলাভূমি, তখন কি উদ্ভিদ, গাছপালা, পোকামাকড় থাকবে না? কল্পবিজ্ঞান নয়, কয়েক শতক ধরে এই বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানীরা।

বাধ সাধল আধুনিক গবেষণার ফলাফল। বহু চেষ্টা করেও শুক্রের মেঘে-ঢাকা আকাশের ওপরের স্তরে জলীয় বাষ্পের সন্ধান খুব একটা পাওয়া গেল না। বায়ুমণ্ডলে জল আছে যৎসামান্য, কিন্তু মাটি থেকে ষাট কিলোমিটার ওপরে যে ঘন মেঘ, তা ভর্তি সালফিউরিক অ্যাসিডে! তা ছাড়া শুকতারার বায়ুমণ্ডলে ৯৬ শতাংশ কার্বন ডাইঅক্সাইড। শুধু তা-ই না, শুক্রের মাটি যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। তাপমাত্রা ৪৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তার ঘন বায়ুমণ্ডলের চাপ পৃথিবীর ৯০ গুণ! অকাট্য প্রমাণ মিলল সত্তরের দশকে, যখন শুক্রকে প্রদক্ষিণ করল মার্কিন পায়োনিয়ার মহাকাশযান, আর শুক্রের মাটিতে অবতরণ করল সোভিয়েট ভেনেরা মহাকাশযান। সত্যি, শুক্র এমন এক ভয়ঙ্কর নরক, যেখানে কোনও প্রাণীর পক্ষে বাঁচা অসম্ভব।

তা হলে কি শুক্রগ্রহে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা একেবারেই নেই? হয়তো আমরা ঠিক জায়গায় খোঁজার কথা ভাবিনি। এ বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান-প্রচারক কার্ল সাগান। ১৯৬৭ সালে তিনি নেচার পত্রিকায় লেখেন, শুক্রের ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৮-৬০ কিলোমিটার ওপরে বায়ুমণ্ডলের পরিবেশ ‘মন্দ নয়’। তাপমাত্রা আর বায়ুমণ্ডলের চাপও পৃথিবীর মতো। তা ছাড়া, যথেষ্ট কার্বন ডাইঅক্সাইড আছে, সূর্যের আলোর অভাব নেই, এমনকি কিছুটা জলীয় বাষ্প আর মেঘে বরফের কণাও রয়েছে। যদি কোনও ব্যাকটিরিয়া বা শেওলা সেখানে বাসা বেঁধে থাকে?

গত কয়েক দশকে সাগানের হাইপোথিসিসের সমর্থনে মাঝে মধ্যেই বিজ্ঞানীরা গবেষণা প্রকাশ করেছেন। যেমন, শুক্রের বায়ুমণ্ডলের ওপর দিকে কিছু কালো কালো ছোপ ঘুরেফিরে বেড়ায় এবং সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি শুষে নেয়। সেগুলি কী? ফেরিক ক্লোরাইড বা সালফার হতে পারে। এককোষী প্রাণীও হতে পারে, ঠিক যেমন আমাদের পুকুরে শেওলার স্তর হয়।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই এসে পড়েছে ব্রিটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা জেন গ্রিভস-এর গবেষণাগারের ফলাফল। প্রকাশিত হয়েছে নেচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে। এই গবেষণা প্রমাণ করল, শুক্রের মেঘের স্তরে ফসফিন গ্যাস রয়েছে। ২০১৭ সালের জুন মাসে হাওয়াই দ্বীপে স্থাপিত জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল দূরবিনের হাত ধরে প্রথম প্রমাণ মেলে। গ্রিভসের কথায়, ‘‘আমরা ফসফিন খুঁজছিলামও না। তাই প্রথম বার ফলাফল দেখে চমকে উঠি।’’ নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্যে ২০১৯ সালে ওঁরা চলে যান দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে। সেখানে আটাকামা মরুভূমিতে বসানো ৪৫টি টেলিস্কোপের সমষ্টিতে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে, দুই কেন্দ্রের ফলাফল মিলিয়ে দেখে, বহু সিগনালের ভিড় থেকে ফসফিন সিগনালকে শনাক্ত করেছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লারা সউসা-সিলভা। হ্যাঁ, শুক্রের বায়ুমণ্ডলের ৫৫ কিলোমিটার উচ্চতায়, মূলত বিষুবরেখার কাছাকাছি, ফসফিন সত্যিই ‘দেখা যাচ্ছে’। উল্লেখ্য, ওই উচ্চতায় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর বাতাসের চাপ পৃথিবীর মতোই। এ সমাপতন হতে পারে না, কারণ দু’টি আলাদা বছরে দুই মহাদেশে দু’টি টেলিস্কোপ ব্যবহার করে একই সিগনাল পাওয়া গিয়েছে।

ফসফিন কী? ফসফিনের উপস্থিতির প্রমাণ মেলা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? তিনটি হাইড্রোজেন ও একটি ফসফরাস পরমাণু মিলে একটি ফসফিন অণু। বিষাক্ত গ্যাস বলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। এখনও পোকামাকড় মারতে কাজে লাগে। প্রকৃতিতে ফসফিন খুবই কম পরিমাণে মেলে। কারণ, পৃথিবীর পরিবেশে কোনও অজৈব প্রক্রিয়ায় ফসফিন তৈরি করা খুবই কঠিন। অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে এবং ৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি তাপমাত্রা নিয়ে গেলে তবেই হাইড্রোজেন এবং ফসফরাস মিলে তৈরি হয় ফসফিন। যেমন, বৃহস্পতি আর শনি— দুই দৈত্যকার গ্রহের বায়ুমণ্ডলের অভ্যন্তরে এই রকম উচ্চতাপ ও উচ্চচাপের পরিবেশ আছে, তাই সেখানে ফসফিন তৈরি হয়। পৃথিবী বা শুক্রের মতো জারণ-প্রক্রিয়াকারী পরিবেশে কোনও অজৈব উৎস থেকে অক্সিজেন ভর্তি ফসফেট অণু বা ফসফরিক অ্যাসিড তৈরি হওয়া যেমন সহজ, তেমনই হাইড্রোজেন-ভর্তি ফসফিন হওয়া কঠিন। কিন্তু, কথায় আছে, প্রাণ ঠিক পথ খুঁজে নেয়। কিছু ব্যাকটিরিয়া পৃথিবীর সাধারণ তাপমাত্রাতেই ফসফিন তৈরি করতে পারে।

কোন কোন ব্যাকটিরিয়া ফসফিন বানায়, তা অজানা। তবে দেখা গিয়েছে, যে সব পরিবেশে অক্সিজেন একদমই নেই, সেখানেই এদের বাস। যেমন কাদা, পাঁক এবং জলাভূমি। কেন এরা ফসফিন বানায়, তাও বিজ্ঞানের অজানা।

তবে, এই কারণেই শুক্রের মেঘের স্তরে ফসফিন দেখে চমকে উঠেছে বিজ্ঞানীমহল। ফসফিন খুঁজে পাওয়া মানে ওখানে প্রাণের অস্তিত্বের পক্ষে একটা বড় পরোক্ষ প্রমাণ বইকি। সাগান কি ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন? বাঙালির বহু কল্পনায় ইন্ধন জোগানো শুকতারার বায়ুমণ্ডলে কি কোনও জীবাণু বাস করে? একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

তবে, জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরি হতে পারে, এমন একটি অণু পাওয়া মানেই এই নয় যে, শুক্রগ্রহে প্রাণ রয়েছে। সিগার যেমন জানাতে ভুললেন না, ‘‘আমরা কিন্তু এক বারও বলছি না যে, শুক্রে প্রাণ খুঁজে পেয়েছি।’’ তা বলেননি বটে, তবে, ওখানে কোন কোন অজৈব প্রক্রিয়ায় কী ভাবে কতটা ফসফিন তৈরি হতে পারে, এক এক করে তার বিশদ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে কতটা ফসফিন তৈরি হয়, মহাকাশ থেকে উল্কারা কতটা ফসফিন বয়ে আনতে পারে, বায়ুমণ্ডলে কোন কোন বিক্রিয়া সম্ভব, সূর্যকিরণের কী প্রভাব, শুক্রের ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপর দিকে ভেসে আসা ধুলোবালি, আগ্নেয়গিরির ছুড়ে দেওয়া খনিজ পদার্থ ইত্যাদি। সমস্তটা হিসেব করেও দেখা গিয়েছে, যতটা ফসফিন আছে, তা কোনও অজৈব পথ ধরে তৈরি হবে না। আর যদি তৈরি হয়ও, শুক্রের জারণ-পরিবেশে দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে।

বিজ্ঞানীরা প্রায় নিশ্চিত যে, ১০০ কোটি বছর আগে শুক্রের পরিবেশ আজকের মতো ভয়ানক ছিল না। জল ছিল। তার পর পরিবেশ পাল্টে যায়, বিলুপ্ত হয় প্রাণ। হয়তো যে কয়েকটি প্রজাতি বেঁচে রয়েছে, তারা এখন বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরের বাসিন্দা এবং তাদের কোষ থেকে নিঃসৃত ফসফিনই যন্ত্রে ধরা পড়েছে।

তবে, এই রহস্যের সমাধান করতে হলে শেষপর্যন্ত শুক্রতে মহাকাশযান পাঠাতেই হবে, যেটি নমুনা সংগ্রহ করবে। তার ফল পেতে তো প্রায় এক দশক। ২০১৮ সালে উৎক্ষেপণ করা একটি ইউরোপীয় ও একটি জাপানি মহাকাশযান এখন বুধের দিকে এগোচ্ছে। যাত্রাপথে সামনের মাসে প্রথমটি এবং আগামী বছর দ্বিতীয়টি শুক্রের পাশ দিয়ে উড়ে যাবে। চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন যদি কিছু পর্যবেক্ষণ চালানো যায়। সব মিলিয়ে অনেক বছর অবহেলিত থাকার পরে শুক্র নিয়ে কাহিনি আবার জমজমাট।

ইনস্টিটিউট অব জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কলকাতা

অন্য বিষয়গুলি:

Venus Life Phosphine Galileo Galilei
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy