সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহে সার্নের বিজ্ঞানী জেমস বিচ্যাম। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র।
‘‘প্রথমে আপনি কিচ্ছু টের পাবেন না। তার পর হঠাৎ সব কিছু বদলে যাবে। ব্যাপক ভাবে, বীভৎস ভাবে।...’’ থমথমে প্রেক্ষাগৃহে কয়েকশো উদগ্রীব মুখ। বিজ্ঞানী বলে চললেন, ‘‘কল্পনা করুন, আজ থেকে পাঁচশো বছর পরের কথা। আপনি একটি মহাকাশযানে বসে আছেন। পৃথিবী থেকে অনেক দূরে এক প্রশান্ত মহাশূন্যের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে আপনার যান। মানব ইতিহাসে আপনিই প্রথম, কোনও ‘ব্ল্যাক হোল’ বা কৃষ্ণগহ্বর দর্শনে যাচ্ছেন। পৃথিবী থেকে কয়েকশো লক্ষ কয়েশো কোটি কিলোমিটার দূরে ওই জায়গায় পৌঁছনো, ব্যাপারটা ভাবলে অসম্ভব! তবু ধরা যাক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। তার হাত ধরেই আপনি ওই জায়গায়। কিন্তু তার পর কী হবে?... ভীষণ বড় ভুল করবেন আপনি!’’
মঙ্গলবার সকালে ভিড়ে ঠাসা কলকাতার সায়েন্স সিটি মিনি অডিটোরিয়ামে তখন নিশ্ছিদ্র নীরবতা। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ৮টি স্কুলের কমপক্ষে ৩৫০ পড়ুয়া দর্শকাসনে। মঞ্চে কৃষ্ণগহ্বরের গল্প বলছেন ‘সার্ন’-এর ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার’ (এলএইচসি)-এ গবেষণারত পার্টিকল ফিজিসিস্ট বা কণা পদার্থবিদ জেমস বিচ্যাম। এই গবেষণা সংস্থাই ২০১২ সালে যুগান্তকারী হিগস বোসন কণা আবিষ্কার করেছিল।
কৃষ্ণগহ্বর কী? মহাশূন্যে কী ভাবে এমন গহ্বর তৈরি হয়েছে, যা দিয়ে আলোও যেতে পারে না? মহাশূন্যই বা কী? সত্যিই শূন্য, নাকি সূর্য, পৃথিবী, চাঁদের মতো গ্রহ, নক্ষত্রের ‘ব্যাকগ্রাউন্ডে’ কোনও অদৃশ্য পর্দা বিছানো রয়েছে? এ দিন এমন অসংখ্য প্রশ্ন উঠেছে। কিছুর জবাব পাওয়া গিয়েছে, কিছুর উত্তর বিজ্ঞানীরাও জানেন না।
জেমসের কথায় উঠে এসেছে, কী ভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে জ্যোতির্বিজ্ঞান। যা আজ আমরা জানি, কয়েকশো বছর আগে তা জানা ছিল না। যা আজ জানি না, তা হয়তো কাল জানা যাবে। পৃথিবীর টানে চাঁদ তার চারপাশে ঘুরছে বা মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে প্রেক্ষাগৃহ উপস্থিত সকলে বসে বা দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ শূন্যে ভাসছেন না। কিন্তু কেন মাধ্যাকর্ষণ তৈরি হয়? বিজ্ঞানী আইজ়্যাক নিউটন গাছ থেকে আপেল পড়া দেখে মাধ্যাকর্ষণ বল আবিষ্কার করলেও কেন এটি তৈরি হয়, তার উত্তর দিতে পারেননি। জেমস জানান, ‘স্কলিউম জেনারেল’-এ নিউটন লিখেছিলেন, ‘আমি এখনও মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণ আবিষ্কার করতে পারিনি। কোনও তত্ত্ব অনুমান করব না।’ পরবর্তী কালে এর উত্তরের খোঁজ দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তিনি জানিয়েছিলেন, কী ভাবে মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে। ‘জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি’ আবিষ্কার করেছিলেন। আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন, মহাশূন্য বা স্পেসের একটি নির্দিষ্ট অংশে অনেক অনেক বস্তু রয়েছে। এগুলি একে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করছে। জেমস জানান, মহাশূন্যে কোনও নির্দিষ্ট অংশে কোনও ভারী বস্তু (যেমন সূর্য) যদি রাখা হয়, স্পেস সেই জায়গায় তুবড়ে যায় বা দেবে যায়। গর্ত তৈরি হয় ওই জায়গায়। একই সঙ্গে, স্পেস বইতেও পারে। ভারী জিনিসটি যেখানে রয়েছে, সেই গর্তের দিকে বয়ে যায় স্পেস। যদি ওই স্পেসের নির্দিষ্ট অংশে প্রবল ভারী, ঘনত্বযুক্ত, শক্তিশালী কোনও বস্তু থাকে, তা হলে সেটি অনেকটা বেঁকে প্রকাণ্ড গহ্বরের মতো হয়ে যায়। তার ভিতরে স্পেস এত দ্রুত গতিতে বইতে থাকে, যে আলোও পারাপার করতে পারে না। কারণ ওই জায়গায় আলোর গতির থেকে বেশি স্পেসের গতি। এই হল কৃষ্ণগহ্বর। ভারী বস্তুটি কেমন বোঝাতে গিয়ে জেমস জানিয়েছেন, পৃথিবীকে যদি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত করতে হয়, তা হলে সেটিকে চেপেচুপে একটি ব্লু-বেরির মধ্যে ঢোকাতে হবে। সূর্যকে ধরাতে হবে সায়েন্স সিটি থেকে ভিক্টোরিয়ার দূরত্বের মধ্যে।
জেমস বলেন, ‘‘আমরা কৃষ্ণগহ্বরের থেকে অনেক দূরে আছি, তাই বিপদ নেই। কিন্তু যদি ওই গহ্বরের নির্দিষ্ট পরিধি (ইভেন্ট হরাইজ়ন)-র ভিতরে ঢুকে যাই, কৃষ্ণগহ্বর
আমাদের টেনে নেবে। আমরা আর কখনওই বেরোতে পারব না।’’ ঠিক এই কারণেই কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে কী আছে, কী হয় সেখানে, তা অজানাই রয়েছে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতেও অজানা-ই থাকবে। কারণ, ইভেন্ট হরাইজ়ন পেরিয়ে কেউ কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে ঢুকে পড়লে, তিনি আর বেরোতে পারবেন না। সেখান থেকে কোনও তথ্যও বাইরে পাঠাতে পারবেন না। কারণ কোনও কিছুর গতি-ই স্পেসের ওই অসীম গতিকে হারাতে পারবে না। তা ছাড়া, অস্তিত্ব সঙ্কটও ঘটবে। পদার্থবিদ্যার হিসাব বলছে, কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে মানুষের মাথার কাছে যে মাধ্যাকর্ষণ থাকবে, পায়ের কাছে তা থাকবে না। মানুষের শরীরে স্প্যাগেটির মতো হয়ে যাবে। হাসতে হাসতে জেমস জানিয়েছেন, কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে কী আছে বলতে পারলে কেউ আট-ন’টা নোবেলও পেয়ে যেতে পারেন।
সায়েন্স সিটির ডিরেক্টর অনুরাগ কুমার বলেন, ‘‘জেমস নিজেকে গল্পকার বলেন। গল্পের মাধ্যমে কত কঠিন বিষয়কে সহজ করে বোঝালেন। আশা করি, দর্শকাসনে উপস্থিত ছোটদের মনে বিজ্ঞান নিয়ে কৌতূহল ও ভালবাসা আরও বাড়বে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy