Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Mount Everest

পাহাড় চূড়ায় বিষের কণা

পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে আগেই পড়েছে মানুষের পা। এ বার সেখানে পৌঁছে গেল মাইক্রোপ্লাস্টিক নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকলেও মোটামুটি ৫ মিলিমিটারের নীচের প্লাস্টিকগুলিকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়।

অরিন্দম রায়
শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২০ ০৭:৩৭
Share: Save:

বিন্দু বিন্দুতে সিন্ধু হয়, তা শুনেছেন। কিন্তু দেখেছেন কি? এই বিন্দু বিন্দুতে সিন্ধু হওয়ার উদাহরণ বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন। বড় প্লাস্টিকের পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যগত বিপদ সম্পর্কে আমরা সবাই অবহিত, কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক কণা নাজেহাল করে ছাড়ছে বিজ্ঞানীদের। তাঁদের মতে, প্লাস্টিকের ছোট ভাই কালে কালে ছাড়িয়ে যাবে বড় ভাইকেও। সম্প্রতি সেই মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেল মাউন্ট এভারেস্টের চুড়োয়। ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক সোসাইটি-র উদ্যোগে হওয়া ২০১৯ সালের অভিযান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এ বার প্লাস্টিক দূষণের কবলে।

কাকে বলে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকাণু? নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকলেও মোটামুটি ৫ মিলিমিটারের নীচের প্লাস্টিকগুলিকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। প্রাইমারি মাইক্রোপ্লাস্টিক হল সেই সব প্লাস্টিকের কণা, যারা উৎপাদনের সময় থেকেই পাঁচ মিলিমিটারের তলায়। এদের উদাহরণ হল, কাপড়ের প্লাস্টিক তন্তু এবং প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র প্যালেট। সেকেন্ডারি মাইক্রোপ্লাস্টিক আবার বড় প্লাস্টিক সামগ্রী, যেমন— বোতল, মাছ ধরার জাল, ক্যারিব্যাগ ইত্যাদি থেকে দীর্ঘ দিন ধরে প্রাকৃতিক কারণে ক্ষয়ের ফলে তৈরি হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিক নানা ভাবে পরিবেশে মিশে যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কাপড় কাচার ফলে এই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক, জলের সঙ্গে নিকাশি নালার মাধ্যমে মিশে যায় পরিবেশে, আবার রাস্তায় টায়ারের ঘর্ষণের ফলেও তৈরি হয়। যে কোনও প্রসাধন সামগ্রীতেও থাকে ছোট্ট প্লাস্টিকের কণা।

প্লাস্টিকাণু বা মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন আকাশে বাতাসে জলে খাবারে। দক্ষিণ ফ্রান্সের পিরেনিজ় পর্বতমালায় পাঁচ মাসের জন্য ঘাঁটি গেড়েছিলেন এক বৈজ্ঞানিক দল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৪০০ মিটার উপরে অবস্থিত এই নির্জন গবেষণাগারের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও জনবসতি নেই। সেখানে ৩০০ ন্যানোমিটার ফাঁকের ছাঁকনি দিয়ে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করেন তাঁরা। দীর্ঘ পাঁচ মাসের বৃষ্টির জল পরীক্ষা করে প্রতি বর্গমিটার এলাকায় ৩০০-রও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন তাঁরা। জনমানবশূন্য এই জায়গায় কোথা থেকে এল এই প্লাস্টিক? এক বিশেষ বায়ুমণ্ডলীয় ট্রান্সপোর্ট মডেল ব্যবহার করে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান যে, পাঁচশো কিলোমিটারেরও বেশি দূর থেকে বাতাসে ভাসমান অবস্থায় প্লাস্টিক কণা এসে পড়েছে এই অঞ্চলে। সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় এই গবেষণাপত্র প্রকাশ করে তাঁরা বলেন, “এই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক কণার গতিপথ রুদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব।”

নিউকাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রকাশ, মানুষের শরীরে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ গ্রাম মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন উপায়ে প্রবেশ করে। নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, জাপান, ইংল্যান্ড-সহ সাতটি দেশের মানুষের মল পরীক্ষা করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলির প্লাস্টিকে মোড়া বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি প্রমাণিত। ন’টি দেশের দুশোরও বেশি বোতলজাত পানীয় জলের মধ্যে এর অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে।

তা বলে এভারেস্ট? খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু নেই। এভারেস্টকে এমনিও বলা হয় বিশ্বের উচ্চতম আঁস্তাকুড়। গত বছরে নেপালের সেনাবাহিনী এভারেস্টের ট্রেকিং রুটে দশ হাজার কিলোগ্রামের কাছাকাছি জঞ্জাল পরিষ্কার করে, যার মধ্যে প্লাস্টিকের প্রাধান্য লক্ষণীয়। ট্রেকিং করার সময় ব্যবহৃত তাঁবু, খাবার, পোশাক, জুতো, দড়ি ইত্যাদি প্লাস্টিকের অন্যতম উৎস। এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে সারা বছর ধরে পর্বতারোহীদের ভিড় লেগেই থাকে। এ বারের অভিযানে বরফ এবং জলের ধারা থেকে ১৯টি নমুনা গবেষণাগারে পাঠানো হয় এবং এর মধ্যে সব ক’টিতেই যথেষ্ট পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে। গবেষণায় আরও জানা গিয়েছে যে, প্রতি বর্গমিটার জায়গায় গড়ে ৩০টিরও বেশি প্লাস্টিক কণা বরফের উপর জমা হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮,৪৪০ মিটার উচ্চতায় পাওয়া এই বিপুল পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক বিজ্ঞানীদের মতে, অতি বিরল এবং অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। মূলত পলিয়েস্টার এবং অ্যাক্রিলিক জাতীয় প্লাস্টিকের তন্তু পাওয়া গিয়েছে এভারেস্টের চুড়োয়, যা এসেছে সিন্থেটিক জামাকাপড় থেকে। এক কিলোগ্রাম ওজনের একটি সিন্থেটিক কোট বা জ্যাকেট কাচা এবং ঝাড়ার ফলে এক বছরে দশ লক্ষ মাইক্রোপ্লাস্টিক অণু তৈরি হয়।

প্ল্যাঙ্কটন ও জলজ পোকা থেকে ছোট মাছ, আর ছোট মাছ থেকে বড় মাছের দেহে জমা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক।

পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে প্লাস্টিকের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ষাট এবং সত্তরের দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা কিছু কিছু সামুদ্রিক জীব এবং পাখির পৌষ্টিকতন্ত্রে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা খুঁজে পেতে শুরু করেন। টনক নড়ল যখন ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রিচার্ড টমসন সামুদ্রিক জীবের উপর প্লাস্টিকাণুর প্রভাব সংক্রান্ত ফলাফল সারা পৃথিবীর সামনে প্রকাশ করেন।

প্ল্যাঙ্কটন বা আণুবীক্ষণিক জীবকে খায় জলজ পোকারা, জলজ পোকাকে খায় ছোট মাছ, ছোট মাছকে খায় বড় মাছ। মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার আয়তন তাদের খাবারের মতো হওয়ায় প্ল্যাঙ্কটনরা তাদেরকেই খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। আর সেই মাছ যখন আমরা খাই, তখন মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।

কী ঘটে যখন প্লাস্টিক কণা প্রবেশ করে মানবশরীরে? খাবারের মধ্যে দিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের পাকস্থলীতে ঢোকে। কিছু প্লাস্টিক কণা ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র হয়ে আমাদের শরীর থেকে মলের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। বাকি অংশের কিছু ভাগ পাকস্থলী বা অন্ত্রের ভিতর জমা হতে থাকে এবং রক্তে মিশে দেহের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।

সম্প্রতি ভেলোর ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর এবং তাঁর সহকর্মীরা এক সাঙ্ঘাতিক পর্যবেক্ষণের কথা জানান। তাঁরা দেখেন যে, মাইক্রোপ্লাস্টিক রক্তে প্রবেশের পর রক্তের বিভিন্ন প্রোটিনের সঙ্গে মিশে প্লাস্টিক-প্রোটিন কমপ্লেক্স তৈরি করছে। আকারে বড় কমপ্লেক্সগুলি একে অপরের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে শিরা এবং ধমনীর মধ্যে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে। গোদের উপর বিষফোড়া হিসেবে এই অতিকায় কমপ্লেক্সগুলি লোহিত রক্ত কণিকা এবং শ্বেত রক্ত কণিকাগুলিকে আস্তে আস্তে মেরে ফেলছে। ফলস্বরূপ, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং রক্ত তঞ্চন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বাসা বাঁধছে রোগ।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এভারেস্টে যে পৌঁছে গেল প্লাস্টিক দূষণ, দায়ী কে? বিজ্ঞানীদের মতে, মাইক্রোপ্লাস্টিকের বাতাসের সাহায্যে কয়েকশো কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া কোনও ব্যাপারই না। ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও বড় জনপদ না থাকলেও, বহু দূর থেকে ভেসে আসা মাইক্রোপ্লাস্টিক অন্যতম কারণ হতে পারে পৃথিবীর উচ্চতম প্রান্তে প্লাস্টিক দূষণের। নাসা এবং কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিত ভাবে একটি মডেল তৈরি করেছে, যা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বায়ুর বেগ এবং গতিপথ নির্ভুল ভাবে নির্ধারণ করে অঙ্ক কষে বলে দিতে পারে কোন জায়গার বাতাস কোথা থেকে আসছে। এই মডেলটি ব্যবহার করে দেখা গিয়েছে, এভারেস্টের চুড়োয় আসা বাতাস বেশির ভাগ সময় আসে সিন্ধু-গাঙ্গেয় অববাহিকা থেকে, যা পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল এলাকা। কাজেই পৃথিবী জুড়ে হওয়া প্লাস্টিক দূষণ বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে দুর্গমতম প্রান্তে।

পরিবেশ বিজ্ঞানী, সুইস ফেডারাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, সুইৎজ়ারল্যান্ড

অন্য বিষয়গুলি:

Mount Everest Micro Plastic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy