সেই ‘শিশু চোর’ ভারতীয় কালো পিঁপড়েরা।
আর বলবেন না, আমাদের চেয়ে কোনও অংশে কম যায় না কালো পিঁপড়েরা!
আকছারই শিশু চুরি করে তারা।
শিশু চুরিতে আমাদের সঙ্গে রীতিমতো টক্কর দিতে পারে এই ‘পনেরিন’ গোত্রের কালো পিঁপড়েরাও!
কলকাতার মতো শহর এলাকাগুলিতে আমরা যে কালো পিঁপড়েদের দেখি, এরা আসলে তাদের ‘তুতো ভাই’। কালো পিঁপড়েই, তবে চেহারায় একটু বড়। লম্বায় ১ সেন্টিমিটার। শহরে থাকলেও, ভারতে গ্রামাঞ্চলেই এদের হদিশ মেলে বেশি। এদের বৈজ্ঞানিক নাম- ‘ডায়াকামা ইন্ডিকাম’।
এরা করে কী, জানেন?
কোনও সাড়াশব্দ না করে, গায়ের গন্ধটন্ধ (ফেরোমন) ঢেকেঢুকে রেখে তারা চুপচাপ ঢুকে পড়ে নিজেদের প্রজাতিরই পিঁপড়েদের অন্য একটি বসতি বা ‘কলোনি’তে। তার পর সেখান থেকে শিশু পিঁপড়ে (পিউপা)-দের চুরি করে নিয়ে আসে নিজেদের কলোনিতে। আর যেই না অন্য কলোনি থেকে চুরি করে আনা শিশু পিঁপড়েরা বড় (অ্যাডাল্ট) হয়ে ওঠে, তখনই তাদের ক্রীতদাসের মতো খাটাতে শুরু করে নিজেদের বসতিতে। ওই চুরি করে আনা শিশু পিঁপড়েদের তারা খাওয়ায়, পরায় না। বড় হয়ে ওঠার পর খেতেও দেয় না। বরং নিজেদের বসতির রোজকার কাজকম্মে তাদের খাটিয়ে নেয়। বলা ভাল, বিনে মজুরিতে! মন্ত্রটা হল- আমাদের বসতির জন্য গায়গতরে খেটে দাও। পরিশ্রমের যত কাজ আছে, সব করে দাও। আর খিদে পেলে নিজেরা জোগাড় করে যা পাও, খেয়ে নাও। অন্য বসতি থেকে চুরি করে আনা শিশু পিঁপড়ে বা তারা প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাদের জন্য খাওয়া-থাকা বাবদ কোনও ‘ইনভেস্টমেন্ট’-ই করে না ভারতের গ্রামাঞ্চলের এই কালো পিঁপড়েরা।
যে ভাবে অন্য বসতি থেকে শিশু চুরি করে কালো পিঁপড়েরা (লাল বৃত্ত দিয়ে ‘শিকার’ বোঝানো হয়েছে)
কালো পিঁপড়েদের এই শিশু চুরির অভ্যাস বা বদভ্যাসের প্রমাণ এই প্রথম পাওয়া গেল কলকাতার পতঙ্গবিজ্ঞানীদের গবেষণায়। যে গবেষকদলের নেতৃত্বে রয়েছেন মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ (আইআইএসইআর বা ‘আইসার-কলকাতা’)-র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সুমনা আন্নাগিরি। রয়েছেন বঙ্গতনয় বিশ্বরূপ পালও।
তাঁদের গবেষণাপত্রটি ফেব্রুয়ারির শেষে প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘প্লস-ওয়ান’-এ। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘ট্রিক্স অফ দ্য ট্রেড: মেকানিজম অফ ব্রুড থেফ্ট ইন অ্যান অ্যান্ট’।
এর আগে অন্য বসতি থেকে শিশুদের চুরি করে আনার বদভ্যাস ধরা পড়েছিল ইউরোপ ও আমেরিকার কালো পিঁপড়ের কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে। কিন্তু তারা সবাই শিশু চুরি করত পিঁপড়েদের অন্য একটি প্রজাতি থেকে।
কিন্তু কলকাতার পতঙ্গবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ভারতের মতো বিষূবরেখা অঞ্চলের (ট্রপিক্যাল) দেশগুলির এই কালো পিঁপড়েরা শিশু চুরি করে তাদেরই প্রজাতির অন্য একটি কলোনি থেকে।
কী ভাবে পরীক্ষা চালিয়েছেন গবেষকরা?
মূল গবেষক সুমনা আন্নাগিরি জানাচ্ছেন, তাঁরা ২ বছর ধরে পরীক্ষাটি চালিয়েছেন দু’টি ধাপে।
প্রথমত, গবেষণাগারেই ৯ সেন্টিমিটার ব্যাসের পেট্রি ডিশে তাঁরা একটু দূরত্বে রেখেছিলেন ওই ডায়াকামা ইন্ডিকাম প্রজাতির পিঁপড়েদের দু’টি কলোনিকে।
দ্বিতীয়ত, আশপাশের পরিবেশে থাকা ওই প্রজাতির দু’টি বসতি নিয়েও তাঁরা পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তার মানে, প্রাকৃতিক ভাবে ওই পিঁপড়েদের আচার-আচরণের উপর নজর রাখার পাশাপাশি তাঁরা কৃত্রিম পরিবেশেও নজর রেখেছিলেন ওই প্রজাতির পিঁপড়েদের মেজাজ-মর্জির উপর। (কোনও একটি বসতিতে বড়জোর ১০০টি পিঁপড়ে থাকে।)
কী দেখেছেন গবেষকরা? দেখুন ভিডিও
কী দেখেছেন গবেষকরা?
সুমনার বক্তব্য, অন্য বসতির শিশু চুরি করার জন্য এরা মূলত তিনটি কৌশল নেয়।
এক, আগেভাগে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখে, কোন কলোনি একটু অগোছালো হয়ে রয়েছে। পিঁপড়দের কলোনি অগোছালো হয় মূলত দু’টি কারণে। যদি সেই কলোনি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার হয়। বা বাসাগুলি সারানো, সরানোর প্রয়োজন হয়। অপহরণকারী পিঁপড়েরা যেই দেখে অন্য কলোনিটা অগোছালো হয়ে পড়েছে, তখনই বুঝে ফেলে, এ বার তাদের সামনে মওকা এসে গিয়েছে শিশু চুরির।
দুই, অন্য কলোনিতে ঢুকে খুবই অল্প সময় থাকে অপহরণকারী পিঁপড়েরা। বেশি ক্ষণ থাকলে তো মুশকিল। ধরা পড়ে যাবে। শরীরে একটি বিশেষ ধরনের রাসায়নিক তৈরি হয় বলে প্রত্যেকটি প্রজাতির পিঁপড়ের গায়ের গন্ধ আলাদা আলাদা হয়। তাই অন্য কলোনিতে ঢুকলে অপহরণকারী পিঁপড়েদের গায়ের গন্ধ টের পেয়ে যেতে পারে সেই কলোনির পিঁপড়েরা। তা হলে, সর্বনাশ! তখনই অপহরণকারীকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাদের কলোনি থেকে বের করে দেবে পিঁপড়েরা। টের যাতে না পায়, তারই জন্য ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের বেশি অন্য কলোনিতে গিয়ে থাকে না অপহরণকারী পিঁপড়েরা। শুধু তাই নয়, গবেষকরা দেখেছেন, সেই অপহরণকারীদের গায়ের গন্ধও অন্যদের চেয়ে অনেকটাই কম থাকে। ফলে, অন্য কলোনিতে ঢুকে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার সম্ভবনাটাও অনেক কম থাকে অপহরণকারী পিঁপড়েদের।
তিন, অপহরণকারীরা অন্য কলোনিতে ঢুকে তক্কে তক্কে থাকে অগোছালো বসতি বা বাসাবদলের কাজকর্ম চলার ফলে সেই কলোনিতে কোন কোন শিশু পিঁপড়েগুলি একটু কম নজরে রয়েছে। বা সেই কলোনির বড় পিঁপড়েদের চোখের আড়ালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। চুরি করার জন্য কম নজরে থাকা শিশু পিঁপড়েগুলিকেই (মূলত যেগুলি পড়ে থাকে বাসার নীচে) টার্গেট করে অপহরণকারীরা।
চার, কোনও বসতিতে মোট যতগুলি পিঁপড়ে থাকে, তাদের বড়জোর ৪ শতাংশ অপহরণকারী হয়।
পাঁচ, এক বার হানা দিয়ে অন্য বসতি থেকে বড়জোর ২৫/২৮টি শিশু চুরি করে আনতে পারে অপহরণকারী পিঁপড়েরা।
শিশু চুরি করে পালাচ্ছে অপহরণকারী কালো পিঁপড়ে!
গায়ের গন্ধই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়
অন্যতম গবেষক বঙ্গতনয় বিশ্বরূপ পাল জানাচ্ছেন, তাদের শরীরে থাকা নির্দিষ্ট কয়েকটি রাসায়নিকের জন্য একটি প্রজাতির পিঁপড়ের গায়ের গন্ধ অন্য প্রজাতির পিঁপড়ের চেয়ে আলাদা হয়। এমনকী, একই প্রজাতির পিঁপড়ে যদি আলাদা আলাদা বসতিতে থাকে, তা হলেও তাদের গায়ের গন্ধ কিছুটা হলেও আলাদা হয়। ফলে, অন্য বসতিতে ঢুকে পড়ে শিশু চুরির কাজটা বেশ কঠিন হয় পিঁপড়েদের। কারণ, গায়ের গন্ধ দিয়েই নিজেদের বসতিতে ঢুকে পড়া শিশু অপহরণকারীদের চিনে ফেলে পিঁপড়েরা। নিজেদের প্রজাতিরই আরেকটি বসতিতে ঢুকে পড়ে শিশু চুরিতে পিঁপড়েরা যে কম ওস্তাদ নয়, সেটাই দেখিয়েছে এই গবেষণা। এটাই এই গবেষণার অভিনবত্ব।
এই গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়?
মূল দুই গবেষক সুমনা আন্নাগিরি ও বিশ্বরূপ পাল (উপরে), সঙ্গে দুই বিশিষ্ট পতঙ্গবিদ পার্থিব বসু ও সমীরণ চক্রবর্তী (নীচে)
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার বিশিষ্ট অধ্যাপক পার্থিব বসুর বক্তব্য, বিশ্বে এর আগে কখনও এই ধরনের কালো পিঁপড়েদের মধ্যে শিশু চুরির এমন কৌশলের কথা জানা যায়নি। এরা যে কোনও প্রজাতিরই মানুষের অনেক আগে এসেছিল পৃথিবীতে। আমরা যে কালো পিঁপড়েদের যে প্রজাতির (ডায়াকামা ইন্ডিকাম) মধ্যে এই শিশু চুরির কৌশল জানতে পেরেছি, তাদের পূর্বপুরুষরা প্রথম পৃথিবীতে জন্মেছিল আজ থেকে অন্তত ১৫ কোটি বছর আগে। আর এরা (‘ডায়াকামা ইন্ডিকাম’) এসেছিল ৮/৯ কোটি বছর আগে। এর আগে ইউরোপ, আমেরিকার (যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, টেম্পারেট রিজিওন) যে লাল ও কালো পিঁপড়েদের (প্রজাতিদু’টির বৈজ্ঞানিক নাম- ‘পলিয়েরগাস রুফেসেন্স’ ও ‘ফরমিকা স্যাংগুইনিয়া’) মধ্যে এই শিশু চুরির অভ্যাস দেখা গিয়েছে, তারা পৃথিবীতে আসে আরও অনেক পরে। শুধু তাই নয়, তাদের কখনও নিজেদের প্রজাতির অন্য বসতি থেকে শিশু চুরি করতে দেখা যায়নি।
গায়ের গন্ধ কতটা মুশকিলে ফেলে অপহরণকারীদের?
অন্যতম গবেষক বিশ্বরূপ বলছেন, ‘‘এই গবেষণা এটাও দেখাল, গায়ের গন্ধ খুবই মুশকিলে ফেলে শিশু অপহরণকারী পিঁপড়েদের। অন্য বসতিতে ঢুকে শিশু অপহরণের বেশির ভাগ চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। অপহরণকারী পিঁপড়েরা সফল হয়েছে মাত্র ৩০ থেকে ৩৬ শতাংশ ক্ষেত্রে। আর অপহরণকারীদের চিনতে পারলে বেশ কড়া শাস্তিও দেয় পিঁপড়েরা। প্রথমে অপহরণকারীদের সবাই মিলে দৌড় করায়, কিছুতেই তাদের বসতি থেকে বেরতে দেয় না। তার পর তাদের এক জায়গায় ঘিরে ফেলে ভীষণ কামড়াতে থাকে। সে সব মিটলে যাকে বলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাদের বসতি থেকে অপহরণকারীদের বের করে দেয় পিঁপড়েরা।’’
কেন অন্য বসতি থেকে শিশু চুরি করে পিঁপড়েরা?
পার্থিব বলছেন, খরচ বাঁচাতে। কারণ, নিজেদের বসতির যাবতীয় কাজকর্ম কাচ্চাবাচ্চাদের দিয়ে করিয়ে নিতে হলে লার্ভা অবস্থায় তাদের খাওয়াতে হয়। লার্ভার উপর খোলস হলেই আমরা তাকে বলি পিউপা। পিউপাদের খাওয়াতে হয় না। লার্ভা অবস্থায় তাদের যা খাবারদাবার দেওয়া হয়েছিল, সেই সঞ্চয় ভেঙেই চালিয়ে দেয় পিউপারা। তারা বড় হলেই তাদের দিয়ে যাবতীয় কাজকর্ম করিয়ে নেওয়া যায়। আর তাদের বলা হয়- ‘আমাদের বসতির জন্য খাটো, আর নিজেদের খাবার নিজেরাই যেখান থেকে পার, জোগাড় করে নাও’! তাই অন্য কলোনি থেকে শিশু চুরি করে আনে অপহরণকারী পিঁপড়েরা, তাদের খাওয়াতে-পরাতে হবে না বলে।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘প্লস-ওয়ান’-এ প্রকাশিত সুমনা, বিশ্বরূপের সেই গবেষণাপত্র
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত, অধুনা ইউজিসি-র এমেরিটাস অধ্যাপক সমীরণ চক্রবর্তী বলছেন, এই ডায়াকামা ইন্ডিকাম প্রজাতির কালো পিঁপড়েরা খুব বেশি লার্ভার জন্ম দিতে পারে না। তাই এদের কলোনির পপুলেশন কম। সেই ফাঁক ভরাতেই অন্য নিজেদেরই অন্য কলোনি থেকে শিশু চুরি করার প্রয়োজন হয় এই কালো পিঁপড়েদের।
কোথায় সীমাবদ্ধতা এই গবেষণার?
সমীরণ বলছেন, এই গবেষণাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে আরও দু’টি বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এক, এই গবেষণায় বলা হয়েছে, কোনও কলোনিতে কত জন অ্যাডাল্ট রয়েছে, তার উপর নির্ভর করে না সেই কলোনির শিশু অপহরণকারীর সংখ্যা। এটা নিয়ে সংশয় রয়েছে কিছুটা।
যারা অন্য কলোনিতে গিয়ে শিশু চুরি করছে, তাদের নিজেদের কলোনিতে কত শিশু চুরি হচ্ছে, সে ব্যাপারেও কিছু বলা হয়নি এই গবেষণায়।
ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার-কলকাতা)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy