সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্ত থেকে দৌড়তে দৌড়তে সে আবার এসে পড়েছে আমাদের কাছাকাছি। সাড়ে ৬ হাজার বছর পর!
এতটাই কাছাকাছি যে, তাকে এ বার খালি চোখেও দেখা যাবে কলকাতা-সহ গোটা ভারতে। আগামী কাল মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) থেকে টানা ১৮ দিন তো বটেই। সূর্যাস্তের পরপরই। অন্তত ঘণ্টাখানেক ধরে। আকাশের উত্তর-পশ্চিম দিকে।
সে আবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে আসবে সাড়ে ৬ হাজার বছর পর।
এই বিরল মহাজাগতিক আগন্তুক আদতে একটি ধূমকেতু। যার বৈজ্ঞানিক নাম- ‘সি/২০২০-এফ-৩’। তবে ‘নিওওয়াইজ’ নামেই তার পরিচিতি বেশি। তার ডাক-নামও বলা যেতে পারে। মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে, গত ২৭ মার্চ এই আগন্তুকটি প্রথম নজরে পড়ে নাসার উপগ্রহ ‘নিওওয়াইজ’-এর। তাই আবিষ্কারের পর ডাক-নামেই সে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
১৪ থেকে ২২ জুলাই দেখা যাবে সবচেয়ে ভাল
কলকাতার বিড়লা তারামণ্ডলের অধিকর্তা দেবীপ্রসাদ দুয়ারি ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বলছেন, ‘‘এই বিরল ধূমকেতুটি সবচেয়ে উজ্জ্বল ভাবে দেখা যাবে ১৪ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত। সূর্যাস্তের ঠিক পরের এক ঘণ্টা ধরে। উত্তর-পশ্চিম আকাশে, দিকচক্রবালের কাছে। তা কলকাতা-সহ গোটা ভারতেই দৃশ্যমান হবে। আবিষ্কারের পর থেকে এত দিন নিওওয়াইজ-কে মোটামুটি উজ্জ্বল ভাবে দেখা যাচ্ছিল সূর্যোদয়ের ঘণ্টাখানেক আগে। উত্তর-পূর্বের আকাশে। তবে শহুরে আলোর রোশনাই, দূষণ ও দিকচক্রবালের কাছে বর্ষার মেঘের আনাগোনার ফলে ধূমকেতুটিকে ততটা উজ্জ্বল ভাবে যদি না-ও দেখা যায় শহর এলাকায়, শহরতলি ও গ্রামাঞ্চলে তাকে বেশ উজ্জ্বল ভাবে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই জোরালো। তার দু’টি লেজ দেখা যাবে।’’
এই শতাব্দীতে আর কোনও ধূমকেতুকে এর আগে এত উজ্জ্বল ভাবে দেখার সুযোগ মেলেনি আমাদের।
সূর্যপ্রণামে এলে চড়া দক্ষিণা দিতে হয় ধূমকেতুদের!
সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতেই সাড়ে ৬ হাজার বছর পর নিওওয়াইজ এসেছিল সৌরমণ্ডলের শেষ প্রান্তে থাকা ফুটবলের মতো বরফের পুরু আস্তরণ ‘ওরট্ ক্লাউড’ থেকে। ‘সূর্যপ্রণামে’ এলে (সূর্যকে প্রদক্ষিণ) সাধারণত, বড় ‘দক্ষিণা’ দিতে হয় ধূমকেতুদের। তাদের মাথার (‘নিউক্লিয়াস’) ধুলোবালি জমা পুরু বরফ গলতে শুরু করে সূর্যের ‘রোষে’। তখন সেই বরফকণা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে থাকে মহাকাশে। তার ফলেই পুচ্ছ বা লেজ (‘কামেট্স টেল’) তৈরি হয় ধূমকেতুর। এই লেজই আমাদের নজর কাড়ে। আমাদের অবাক করে দেয়।
কখনও এমন রঙেও দেখা যাবে ধূমকেতু নিওওয়াইজের লেজ। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
২২ জুলাই আসবে আমাদের সবচেয়ে কাছে!
ধূমকেতুটির ইতিমধ্যেই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা হয়ে গিয়েছে। এ বার সে ফিরে যাচ্ছে তার নিজের মুলুকে। সৌরমণ্ডলের শেষ প্রান্তে থাকা ওরট্ ক্লাউডে। নিজের মুলুকে ফেরার সেই পথেই আগামী ২২ জুলাই নিওওয়াইজ সবচেয়ে কাছে আসবে পৃথিবীর। সে দিন আমাদের থেকে নিওওয়াইজের দূরত্ব হবে মাত্র ১০ কোটি ৩০ লক্ষ কিলোমিটার।
৩০ জুলাই থাকবে সপ্তর্ষিমণ্ডলের নীচে
দেবীপ্রসাদ এও জানাচ্ছেন, ধূমকেতুটিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষণ ধরে দেখা যাবে আগামী ৩০ জুলাই। সপ্তর্ষি মণ্ডলের নীচে। ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় ধরে। তবে জুলাই শেষ হয়ে গেলে আর এই ধূমকেতুটিকে খালি চোখে দেখা যাবে না। তখন বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে হবে তাকে। সূর্যাস্তের পর মোটামুটি ভাবে উত্তর-পশ্চিম আকাশে ধূমকেতুটিকে টেলিস্কোপ বা বাইনোকুলার দিয়ে দেখা যাবে অগস্ট পর্যন্ত।
আরও পড়ুন- ব্ল্যাক হোল থেকে আলোর ঝলক দেখল নাসা, মিলল আরও এক বার্তাবাহক
আরও পড়ুন- ভারতে কেন কোভিড-মৃত্যু তুলনায় কম, আলো ফেলল ৪ বাঙালির গবেষণা
এর আগে যে আগন্তুকরা নজরে পড়েছিল
এর আগেও এমন আগন্তুকরা এসেছে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে। তাদের কেউ আমাদের নজরে পড়েছে, কেউ পড়েনি। কাউকে দেখা গিয়েছে শুধু টেলিস্কোপেই। আর কেউ বা দৃশ্যমান হয়েছে খালি চোখেও। ১৯৬৫ সালে দেখা গিয়েছিল ‘ইকেয়া সাকি’ ধূমকেতুটিকে। টেলিস্কোপে। তার পর খালি চোখে দেখা গিয়েছিল ‘হ্যালির ধূমকেতু’কে, ১৯৮৬-তে। ১০ বছর পর ১৯৯৬-তে টেলিস্কোপের নজরে ধরা দিয়েছিল ‘হায়াকাতুকে’। তার ১১ বছর পর ১৯৯৭ সালে খালি চোখে দেখা গিয়েছিল ‘হেল বপ’ ধূমকেতু। আর সাত বছর আগে টেলিস্কোপে ধরা দিয়েছিল ধূমকেতু ‘প্যান স্টার’। তবে ২০১৩ সালে ভারতের সব জায়গা থেকে উজ্জ্বল ভাবে দেখা যায়নি প্যান স্টার-কে।
কারও ঝাঁপ সূর্যে, মাথা কাটা যায় কারও, কেউ ফেরে নিজের মুলুকে
দেবীপ্রসাদ ও শিলচর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধূমকেতু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অশোক সেন জানাচ্ছেন, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ধূমকেতুগুলি আসে সাধারণত সৌরমণ্ডলের দু’টি এলাকা থেকে। একটি- ‘কুইপার বেল্ট’। ইউরেনাস, নেপটুন, প্লুটোর পর বরফের সাম্রাজ্য। সেখান থেকে যে ধূমকেতুগুলি আসে সেগুলি ‘অল্প পাল্লা (‘শর্ট রেঞ্জ’) -র। যার মানে, সেগুলি ২০০ বছরের মধ্যে আবার ফিরে আসে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে। আর ২০০ বছরেরও বেশি পরে যেগুলি ফিরে আসে সূর্যপ্রণাম সারতে সেগুলি আসে সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্তে থাকা সেই বরফের মহাসাম্রাজ্য ওরট্ ক্লাউড থেকে। এগুলি ‘দূর পাল্লা’ (‘লং রেঞ্জ’)-র। এগুলি আবার দু’ধরনের হয়। কেউ কেউ সূর্যকে ‘প্রণাম’ সারতে এসে এতটাই কাছাকাছি চলে আসে যে, তাদের জীবনটাই উৎসর্গ করতে হয় এই সৌরমণ্ডলের ‘কর্তা’ নক্ষত্রের কাছে। তারা ঝাপ মারে সূর্যে, বলা ভাল, আত্মঘাতী হয়। কারও আবার সূর্যের কাছে এসে সৌররোষে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায় তার বরফের মাথা (‘নিউক্লিয়াস’)। আবার কেউ ফিরে যায় তার নিজের মুলুক ওরট্ ক্লাউডেই।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে যে ভাবে দেখা গিয়েছে এই ধূমকেতুকে, দেখুন ভিডিয়ো
বরাত ভাল, বেঁচে গিয়েছে এই ধূমকেতু!
দেবীপ্রসাদের কথায়, ‘‘নিওওয়াইজের ভাগ্য কিছুটা ভালই বলতে হবে। হয়তো তার বরফের মাথাটাও অনেক বেশ শক্তপোক্ত। তাই এ বার প্রদক্ষিণ করতে এসে ধূমকেতুটি সূর্যের সাড়ে ৪ কোটি কিলোমিটারের মধ্যে চলে এলেও তাকে ঝাঁপ মারতে হয়নি। সূর্য খণ্ডবিখণ্ড করে দিতে পারেনি তার বরফের মাথা। কিছু ‘দক্ষিণা’ তো দিতে হয়েছেই, না হলে কোটি কোটি কিলোমিটার লম্বা তার বরফের লেজটা তৈরিই হত না যে! তবে বরাত ভাল নিওওয়াইজের, সূর্যের এতটা কাছে এসেও নিজের মুলুকে ফেরার পথ ধরতে পেরেছে সে।’’
ঘরে ফেরার পথে কি সভ্যতাকে শেষ বারের মতো দেখা দিয়ে গেল নিওওয়াইজ? আবার যে সে ফিরে আসবে সাড়ে ৬ হাজার বছর পর!
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
ছবি সৌজন্যে: নাসা।
ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy