বিজ্ঞানী কাতালিন কারিকো (ডান দিকে) এবং ড্রু ওয়েজ়ম্যান। —ফাইল চিত্র।
মা প্রতি বছরই নজর রাখতেন, কারা নোবেল পাচ্ছেন। মেয়েকে এসে বলতেন, তুমিও হয়তো এক দিন নোবেল পাবে। সে কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়তেন বিজ্ঞানী মেয়ে। বলতেন, ‘‘কী যে বলো!’’ মেয়ের বিস্ময় দেখে হতবাক মায়ের প্রশ্ন ছিল, ‘‘কেন? তুমি যে এত পরিশ্রম করছ দিনরাত। পেতেই পারো।’’ মেয়ে বলতেন, সব বিজ্ঞানীরাই অনেক পরিশ্রম করেন। মেয়ের নিজের কৃতিত্বের প্রতি সন্দেহ থাকলেও মায়ের হয়তো ছিল না। এ বছর শারীরবিদ্যা তথা চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জিতে নিলেন সেই মেয়ে— হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী কাতালিন কারিকো। ১৯০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত, তিনি ১৩তম মহিলা বিজ্ঞানী, যিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পেলেন। তাঁর সঙ্গে যুগ্ম ভাবে জয়ী হয়েছেন আমেরিকার ড্রু ওয়েজ়ম্যান। কোভিড অতিমারির সময়ে তাঁদের আবিষ্কৃত প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এমআরএনএ ভ্যাকসিন তৈরি সম্ভব হয়েছিল।
কারিকো এবং ওয়েজ়ম্যান দীর্ঘদিনের সহকর্মী। দু’জনেই পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। যে গবেষণার জন্য তাঁরা পুরস্কৃত হলেন, তা কিন্তু প্রায় দু’দশক আগের কাজ। অনেকেই বলছেন, এই দু’জনের কর্মকাণ্ডকে সম্মান জানাতে স্টকহলম নোবেল কমিটি তাদের চিরন্তন প্রথা ভেঙে ফেলেছে। ২০০৫ সালে যে এমআরএনএ প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরা, ২০১৯ সালের শেষ লগ্নে শুরু হওয়া কোভিড অতিমারিকে ঠেকাতে সাহায্য করেছে তা-ই। ওষুধপ্রস্তুতকারী সংস্থা ফাইজ়ার/বায়োএনটেক এবং মডার্না সেই এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোভিডের টিকা তৈরি করে। কলেরা, টাইফয়েড, এমন বহু মহামারি এসেছে, কিন্তু যে দ্রুততার সঙ্গে এ বারে টিকা তৈরি হয়েছিল, ইতিহাসে তা বেনজির। এই কৃতিত্বের অন্যতম অংশীদার কারিকো এবং ওয়েজ়ম্যান।
১৯৯০-এর দশকেই বায়োকেমিস্ট কারিকো বুঝতে পেরেছিলেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমআরএনএ-র ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি ও তাঁর সহকর্মী, ইমিউনোলজিস্ট ড্রু ওয়েজ়ম্যানের গবেষণা সাফল্যের মুখ দেখে ২০০৫ সালে এসে। তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখানো হয়, নিউক্লিওসাইডের মডিফিকেশন বা পরিবর্তনের ফল ও মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনো সিস্টেমে তার প্রভাব। তবে বিষয়টা খুব সহজ হয়নি। ‘সায়েন্স’ ও ‘নেচার’, দু’টি জার্নালই তাঁদের গবেষণাপত্র খারিজ করে দেয়। পরে ‘ইমিউনিটি’ নামক একটি জার্নালে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। এর পরে ২০০৮ সাল ও ২০১০ সালে আরও দু’টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তাঁরা। তাতে আরও বিশদে ও স্পষ্ট ভাবে এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যাখ্যা করা হয়।
কারিকো জানান, তাঁর কাছে যখন নোবেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ফোন আসে, তিনি ঘুমোচ্ছিলেন। ঘুম চোখে ভেবেছিলেন, কেউ মজা করছে। কারিকোই পরে ওয়েজ়ম্যানকে ফোন করে জানান, তাঁদের নোবেল-জয়ের খবর। ওয়েজ়ম্যান জানিয়েছেন, ব্যক্তিত্বের দিক থেকে তাঁরা দু’জনে একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির। কিন্তু বিজ্ঞানের দিক থেকে তাঁদের খুব মিল। হঠাৎ কোনও কিছু মাথায় এলে রাত তিনটেতেও ইমেল করেছেন কাটিকে (কাতালিন কারিকোকে এই নামেই ডাকেন তিনি)।
নোবেল কমিটির জুরির তরফে বলা হয়েছে, ‘‘আজকের আধুনিক যুগে মানব সমাজ এক মারণ সংক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিল। নজিরবিহীন গতিতে তার প্রতিষেধক তৈরি করা হয়েছে। আর সেই কাজে এই দুই বিজ্ঞানীর অবদান অনস্বীকার্য। তাই এই দু’জনকে আমরা সবচেয়ে যোগ্য হিসেবে বেছে নিয়েছি।’’ এই নিয়ে অবশ্য বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ফাইজ়ার বা মডার্নার টিকা ছাড়াও আরও বেশ কিছু কোভিড প্রতিষেধক তৈরি হয়েছিল। সেগুলি অন্য প্রযুক্তিতে তৈরি। যেমন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রতিষেধকটি অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিন। কার্যকারিতার দিক থেকে এগুলি পিছিয়ে ছিল না। বরং ফাইজ়ার ও মডার্নার টিকার দাম বেশি। ধনী দেশগুলি ছাড়া বাকিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ যোগীরাজ রায় বলেন, ‘‘এমআরএনএ-ভ্যাকসিনকে ওঁরা স্বীকৃতি দিয়েছেন। আরও অনেক ভ্যাকসিন কিন্তু বেরিয়েছিল। আবার, এমআরএনএ-ভ্যাকসিন এতটাই দামি ছিল যে প্রথম বিশ্বের দেশ ছাড়া বাকি সব দেশের সেটি কেনার সামর্থ্য ছিল না। যদি, বৈজ্ঞানিক দিকের কথা ধরে এই স্বীকৃতি হয়, তা হলে বলতে হয়, এটি যে অন্যদের তুলনায় মৃত্যুহার কমাতে বিরাট কিছু করেছে, তা-ও নয়।’’ যোগীরাজের আক্ষেপ, ‘‘আসলে নোবেল কমিটির কাছে তৃতীয় বিশ্বের দেশের গবেষক-চিকিৎসকেরা স্বীকৃতি পাবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।’’
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি-র চিকিৎসক গবেষক দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য এটা ভেবে খুশি যে, টিকা তৈরি নয়, টিকা তৈরির পিছনে যে প্রযুক্তি রয়েছে, নোবেল কমিটি সেটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এই স্বীকৃতির মাধ্যমে নোবেল কমিটি বুঝিয়ে দিল যে, একটি ভ্যাকসিন তৈরির নেপথ্যে বেসিক-সায়েন্স কতটা জরুরি। তাই তারা, এমআরএনএ ভ্যাকসিন যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁদের না দিয়ে বরং যাঁরা এই ভ্যাকসিন তৈরির বিজ্ঞানকে বুঝতে সাহায্য করেছেন, তাঁদের সম্মান জানিয়েছে।’’
কারিকোর বাবা ছিলেন মাংসের ব্যাপারী। মেয়ে বড় হয়ে হলেন এমআরএনএ বিশেষজ্ঞ। ওয়েজ়ম্যান হলেন ইমিউনোলজিস্ট ও ভাইরোলজিস্ট। এইচআইভি-র প্রতিষেধক খুঁজছিলেন তিনি। ১৯৯৮ সালে এক দিন পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কপি-মেশিনের সামনে দু’জনের পরিচয় হয়। এর বছর দুয়েক আগে হাঙ্গেরি থেকে আমেরিকা চলে এসেছিলেন কারিকো। সে দেশে অর্থের অভাবে তাঁর গবেষণা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ও দিকে, ওয়েজ়ম্যান এইচআইভি গবেষণায় এক জন সঙ্গী খুঁজছিলেন। দু’জনে এক সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তার পর... বাধা এসেছে। তবে সাফল্যও মিলেছে শেষমেশ। কয়েক বছরের মধ্যে তাঁরা তৈরি করে ফেলেন এক দুর্মূল্য ভ্যাকসিন-টেকনোলজি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy