Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Neuronal Interface

মস্তিষ্কে পাহারা বসাচ্ছে বিজ্ঞান

ডিজিটাল দুনিয়ায় আমাদের প্রত্যেকটি কাজকর্মেই নজর রাখা সম্ভব। কিন্তু ভাবনায় পাহারা? বাস্তবায়নের চেষ্টায় বিজ্ঞান।এ বার আর একটু এগিয়ে যাওয়া যাক। আমরা যা ভাবছি, সেটা মুখে না বললেও, অপরে যদি তা বুঝে যায়?

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

নির্মাল্য দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২০ ০৫:৩৭
Share: Save:

নজরদারি চালানো রাষ্ট্রের সাবেক প্রথা। আগে গোয়েন্দাবাহিনীর ওপর ভরসা করে নজরদারি চলত। এখন কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের জন্য নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্র আর কর্পোরেটের নজরদারি আরও সহজ আর বিস্তৃত হয়েছে। চিন আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। সেখানে আজকাল কিছু সংস্থা কর্মীদের হেলমেটের মধ্যে যন্ত্র বসিয়ে তাঁদের মেজাজের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে।

এ বার আর একটু এগিয়ে যাওয়া যাক। আমরা যা ভাবছি, সেটা মুখে না বললেও, অপরে যদি তা বুঝে যায়? আমাদের ভাবনা যদি জোড়া যায় কম্পিউটারের সঙ্গে? আমাদের স্মৃতিগুলোকে ইচ্ছেমতো কম্পিউটারের স্মৃতিভান্ডারে সঞ্চিত রেখে, সেই স্মৃতি আবার অন্য কারও মস্তিষ্কে যদি চালান করে দেওয়া যায়? কল্পবিজ্ঞান বা ডিসটোপিয়ান উপন্যাসের খসড়া মনে হচ্ছে? কয়েক সপ্তাহ আগে আমেরিকান ধনকুবের এলন মাস্ক তাঁর নিউরোনাল ইন্টারফেস (এনআই) ‘নিউরোলিঙ্ক’-এর প্রাথমিক সাফল্য প্রদর্শনের সময় ‘নিউরোলিঙ্ক’ কী কী করতে পারে ভবিষ্যতে, তা বলতে গিয়ে এ সমস্ত কথাই বলেছেন। তিনি শিল্পপতি, ব্যবসার স্বার্থে আপাতত অতিরঞ্জন করছেন ধরে নিলেও, দু’-তিন দশক বাদে এগুলো যে সত্যি হবে না, তা কিন্তু হলফ করে বলা যায় না। কারণ, এই নিউরোনাল ইন্টারফেস বা এনআই-এর পিছনে শুধু মাস্কই টাকা ঢালছেন না, বিভিন্ন দেশে সরকারি বেসরকারি বহু সংস্থাই টাকা ঢালছে।

এ বার জেনে নেওয়া যাক, এই নিউরোনাল ইন্টারফেস বা এনআই বস্তুটি কী। এনআই হল, মস্তিষ্ক বা স্নায়ুতন্ত্রকে কোনও যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করা। সেটা মস্তিষ্কের বা স্নায়ুতন্ত্রের কোনও ক্রিয়া বা সঙ্কেত নথিবদ্ধ করার জন্যে হতে পারে, বা তাদের উদ্দীপ্ত করার জন্যেও হতে পারে। যেমন, আমেরিকার প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সরকারি গবেষণা সংস্থা, যাঁদের হাত কোনও দুর্ঘটনায় কাটা পড়েছে, তাঁদের জন্য এক রকম কৃত্রিম হাত বানিয়েছে। এই নকল হাত দিয়ে ছোটখাটো কাজ, যেমন জলের গ্লাস তুলে জল খাওয়া, খাবার খাওয়া ইত্যাদি স্বাভাবিক ভাবেই করা যায়। নেপথ্যে এনআই। কী ভাবে সম্ভব হল এই আপাত অসাধ্য কাজ? মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ন’হাজার কোটি স্নায়ুকোষ বা নিউরন রয়েছে। প্রতিটা নিউরন আবার হাজার হাজার নিউরনের সঙ্গে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে তথ্য আদান-প্রদান করে। এ ভাবেই নিউরনগুলো প্রাণীদের ভাবা, শেখা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, কথা বলা, কাজকর্ম করা, চলাফেরা, সব নিয়ন্ত্রণ করে। মানব-মস্তিষ্কের কোন অংশ কোন কাজের সঙ্গে যুক্ত, তা মোটামুটি জানা আছে। যে অংশ হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে, বিজ্ঞানীরা বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তির মস্তিষ্কের সেই অঞ্চলে তড়িৎদ্বার বসিয়েছেন। সেখানকার স্নায়ুকোষ থেকে রাসায়নিক সঙ্কেত বৈদ্যুতিক সঙ্কেত হয়ে আসছে কৃত্রিম হাতে। ফলে, সেই ব্যক্তি নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী হাত নাড়াতে পারছেন।

আরও পড়ুন: ধেয়ে আসছে গ্রহাণু ‘অ্যাপোফিস’, ৪৮ বছর পর ধাক্কা লাগতে পারে পৃথিবীর সঙ্গে​

শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞানীরা সেই নকল হাতেও সংবেদী তড়িৎদ্বার বসিয়েছেন। ফলে, হাত থেকে বৈদ্যুতিক সঙ্কেত মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করে স্নায়ুকোষেও রাসায়নিক স্ফুলিঙ্গ তৈরি করছে। তাই সেই ব্যক্তি কৃত্রিম হাতেও আসল হাতের মতো কিছু কিছু অনুভূতি পাচ্ছেন, যেমন, কোনও কিছু ছোঁয়া, করমর্দন করা। এই হল এনআই-এর বর্তমানের রূপ, যা এখনও শৈশবেই আছে বলা যায়। দাবি করা হচ্ছে, এনআই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে বহু ধরনের রোগে ব্যবহৃত হবে। মস্তিষ্কের ভেতর তড়িৎদ্বার বসিয়ে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ উদ্দীপ্ত করে স্ট্রোক, পক্ষাঘাত, পার্কিনসন্স, অ্যালঝাইমার্স, অবসাদ ইত্যাদি রোগের চিকিৎসা সম্ভব হবে। এ জাতীয় কিছু চিকিৎসা অবশ্য বেশ কিছু সময় ধরেই হচ্ছে। যেমন, কানের ভিতর কৃত্রিম ভাবে ককলিয়ার শ্রবণযন্ত্রকে উদ্দীপ্ত করা, তা ছাড়া যাঁদের শিরদাঁড়ায় চোট লেগে সুষুম্নাকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁদের সুষুম্নাকাণ্ডে তড়িৎদ্বার বসিয়ে মস্তিষ্ক থেকে সঙ্কেত পাঠিয়ে আবার হাঁটাচলায় সহায়তা করা হচ্ছে। দৃষ্টিহীনদের জন্য রেটিনার স্নায়ুকোষ থেকে সঙ্কেত মস্তিষ্কে তড়িৎদ্বার বসিয়ে গ্রহণ করে দৃষ্টিশক্তি ফেরানোর গবেষণাও বেশ খানিকটা এগিয়েছে।

এনআই কি শুধুমাত্র চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ থাকবে? না, বিনিয়োগকারীরা মোটেই এখানে থামতে চাইবেন না। যেমন মাস্ক বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে ভাবে তার থাবা বিস্তার করছে, তা মানব-মস্তিষ্ক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। তাই মানুষের মস্তিষ্কে তড়িৎদ্বার বসিয়ে তাকে আরও উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী করতে হবে, এবং এই এনআই-এর মাধ্যমে মানব বুদ্ধিমত্তা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। খালি মাস্ক নন, অন্যান্য সংস্থার অনেক বিজ্ঞানীর মতেই, এনআই দিয়ে মানবিক বুদ্ধিমত্তা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একসঙ্গে জুড়লে, এক নতুন ধরনের বুদ্ধিমত্তা তৈরি হবে। এর ফলে মানুষে মানুষে যোগাযোগের জন্য হয়তো আর কথা বলতে হবে না। এক জন থেকে আর এক জনের অনুভূতি এনআই-এর মাধ্যমে অন্য জনের মধ্যে সঞ্চারিত হবে। পুলিশ, দমকলবাহিনী ও সেনাবাহিনী এনআই-এর মাধ্যমে আরও উন্নত হয়ে যাবে। এ সব সত্যিই কতটা সম্ভব, সেটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। কারণ, মস্তিষ্কের ন’হাজার কোটি নিউরনের প্রতিটি কী ভাবে অন্য হাজার হাজার নিউরনের সঙ্গে সংযোগ রেখে চেতনা, আবেগ, ধারণা তৈরি করে, তা জানা বাকি। যদিও আগে উল্লিখিত অনেকগুলো যন্ত্রই কাজ করছে, তাও তা কী ভাবে কাজ করছে, বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি নিঃসন্দেহ নন। বিজ্ঞানীদের কারও মতে, মস্তিষ্কের সব রহস্য সমাধান না করলে এনআই প্রত্যাশিত সাফল্য পাবে না। অন্য এক দল অবশ্য আশাবাদী যে, প্রযুক্তি যদি সাফল্য পায়, তবে অত রহস্য সমাধান না করলেও চলবে।

প্রযুক্তি যেমন অনেক সমস্যার সমাধান করে, সে রকম নতুনতর সমস্যা সৃষ্টিও করে। দার্শনিক পল ভিরিলিয়ো-র কথায়, “যে কোনও প্রযুক্তির আবিষ্কারের সঙ্গে তার খারাপ দিকটাও আবিষ্কৃত হয়।’’ এনআই-ও এর ব্যতিক্রম হবে না। আর এনআই-এর চ্যালেঞ্জ আরও জটিল। প্রথমত, এনআই-এর চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে সব ভবিষ্যৎ সুফল দাবি করা হচ্ছে, সেগুলো নিরাপদ হতে হবে। কারণ, তড়িৎদ্বার বসাতে গেলে মস্তিষ্কে ফুটো তো করতেই হবে। তার পর এনআই-কে সুলভ হতে হবে, যাতে সারা বিশ্বের কোটি কোটি রোগীর কাছে তা পৌঁছায়। দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, সামাজিক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ। এনআই যদি খোলা বাজারে মোবাইল বা কম্পিউটারের মতো যত দাম, তত উন্নত— বলে বিক্রি হতে থাকে, তবে এনআই দ্বারা বুদ্ধি তৈরি করবে অসাম্যের নতুন জায়গা। শিক্ষা-চিকিৎসা যেমন এখন কিনতে হয়, মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ানোর মতো ব্যবস্থাও তখন খোলা বাজারে কিনতে হবে। যারা কিনতে পারবে না, তাদের কী হবে? শিক্ষাক্ষেত্রে, চাকরিতে, ক্রীড়ায় তখন কি ব্যক্তির ‘মেধা’ ‘প্রতিভা’ বিচার্য হবে, নাকি তাদের মস্তিষ্কে বসানো চিপের ক্ষমতা বিচার্য হবে? একাধিক বিজ্ঞানীর মতে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো ভবিষ্যতে মানুষ মৌলিক অধিকার হিসেবে এনআই-এরও দাবি জানাবে।

আরও পড়ুন: চাঁদের আলোকিত অংশে মিলল জল, ভবিষ্যৎ মহাকাশ অভিযানে ঘাঁটি চাঁদ​

বিপদ এখানেই শেষ নয়! যে হেতু এনআই মস্তিষ্কের সঙ্কেত নথিবদ্ধ করবে, তাই সেটা হয়তো ভবিষ্যতে আমাদের চিন্তাভাবনাকে নথিবদ্ধ করবে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মস্তিষ্কে তড়িৎদ্বার বসিয়ে কথা বললে যে সঙ্কেত মস্তিষ্কে যায়, সেগুলো নথিবদ্ধ করলে তাকে পরে আবার ভাষার রূপ দেওয়া সম্ভব। ফেসবুক চেষ্টা করছে এমন চশমা বানাতে, যা পরলে নিজের ভাবনাকে কোনও কি বোর্ড ছাড়া, আঙুলের স্পর্শ ছাড়া সরাসরি কম্পিউটারে টাইপ করা যাবে।

অর্থাৎ, মাস্ক যা বলছেন, কল্পবিজ্ঞান নয়। সে ক্ষেত্রে চলে আসে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকারের প্রশ্ন। এক জনের চেতনা, ভাবনার মধ্যে অন্য কারও প্রবেশ হল মানবাধিকারের ওপর চরম আঘাত। বিভিন্ন সংস্থা যদি কর্মীদের মনের সমস্ত খবর রাখতে চায় বা রাষ্ট্র যদি নাগরিকের ভাবনা নথিবদ্ধ করতে চায়, তা হলে ব্যক্তিমানুষের স্বাধীন ভাবনার ক্ষমতা জলাঞ্জলি দিতে হবে। আমরা এখনই পুলিশ, রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের নজরদারির মধ্যে আছি। কিন্তু, আমাদের ঘিলুতে এনআই পাহারাদার বসানো হলে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। সেটা জেলে থাকার চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে।

(গবেষক, স্যানফোর্ড বার্নহ্যাম প্রেবিস মেডিক্যাল ডিসকভারি ইনস্টিটিউট, ক্যালিফর্নিয়া)

অন্য বিষয়গুলি:

Elon Musk Science Brain Neuronal Interface
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy