ছোট ছোট সৌরঝলক (সাদা দাগ)। ছবি- ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সৌজন্যে।
দেখা গেল, খুব ছোট ছোট ক্যাম্পফায়ারও হচ্ছে সূর্যের বায়ুমণ্ডল বা করোনায়। বিধ্বংসী আগুনের গোলা নয়, উঠে আসছে খুব ছোট ছোট আগুনের শিখা। যাকে ঝলকও বলা যায়। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম ‘ন্যানোফ্লেয়ার’।
এই প্রথম খুব ছোট ছোট সৌরঝলকের হদিশ মিলল সূর্যের বায়ুমণ্ডলে। তার ছবি তুলল ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ বা এসা)’-র ‘সোলার অরবিটার মিশন’। বিজ্ঞানীরা এদের ডাকছেন ‘ক্যাম্পফায়ার’ নামে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, সূর্যের বায়ুমণ্ডলের নানা অংশকে নানা রকম ভাবে তাতিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা থাকতে পারে এই খুব ছোট ছোট ক্যাম্পফায়ারগুলির।
এর আগে সূর্যের এত কাছে গিয়ে ক্যামেরা উঁচিয়ে ধরার সাহস পায়নি আর কোনও মহাকাশযান। ফলে, এই ধরনের ছোট ছোট সৌরঝলক আগে চাক্ষুষ করা সম্ভব হয়নি।
বড় বড় সৌরঝলকগুলিই (‘সোলার ফ্লেয়ার’) আমাদের পক্ষে, কৃত্রিম উপগ্রহগুলির পক্ষে ও মহাকাশের আবহাওয়ার পক্ষে হয়ে ওঠে খুব বিপজ্জনক। কারণ, তারাই হয় সৌরঝড় (‘সোলার স্টর্ম’) ও করোনাল মাস ইজেকশান (‘সিএমই’)-এর মতো সূর্য থেকে ছুটে আসা ভয়ঙ্কর হামলাবাজদের জন্মের অন্যতম কারণ। অন্য নক্ষত্রগুলিতে ‘সুপার ফ্লেয়ার’ও দেখা গিয়েছে। সেগুলি আরও ভয়ঙ্কর। তবে আমাদের সূর্যে এখনও এর হদিশ মেলেনি।
সূর্যের তেজ কমা-বাড়া নির্ভর করে তার সৌরচক্রের (সোলার সাইক্ল) উপর। যা সাধারণত, ১১ বছরের হয়। কখনও কখনও সৌরচক্রের আয়ু হয় ১৩/১৪ বছরও। সৌরচক্রেই সূর্যের পিঠে (‘ফোটোস্ফিয়ার’) তৈরি হয় একের পর এক সৌরকলঙ্ক বা ‘সানস্পট’। সৌরকলঙ্কের সংখ্যা যত বাড়ে ততই শক্তি বাড়ে সৌরচক্রের। ৩০০টি বা তারও বেশি সৌরকলঙ্ক তৈরি হলে সেই সৌরচক্রটি হয়ে ওঠে অত্যন্ত শক্তিশালী। যেমনটা হয়েছিল গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে। সংখ্যাটা ২০০ বা তার কম হলে সেই সৌরচক্রকে দুর্বল বলা হয়। আর সৌরকলঙ্কের সংখ্যা ২৫০ হলে সেই সৌরচক্রটি হয় মাঝারি শক্তির।
সৌরকলঙ্কের জন্মের পর পরই সূর্য থেকে বেরিয়ে আসে সৌরবায়ু (‘সোলার উইন্ড’), সৌরঝড় (‘সোলার স্টর্ম’), সৌরঝলক (‘সোলার ফ্লেয়ার’), করোনাল মাস ইজেকশান (‘সিএমই’)-এর মতো ভয়ঙ্কর হামলাবাজরা।
আরও পড়ুন- ভয়ঙ্কর স্মৃতি মুছে ফেলার পথ দেখালেন শান্তিনিকেতনের সোনা
আরও পড়ুন- আজীবন অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী
এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর করোনাল মাস ইজেকশান। যা একেবারেই আচমকা হয়। এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি করোনাল মাস ইজেকশানের পূর্বাভাস। সূর্যের বায়ুমণ্ডল বা করোনা থেকে অসম্ভব গরম আধান-যুক্ত (আয়ন) কণাস্রোত নিয়ে একেবারে সাপের ফণার মতো উঠে আসে সিএমই। আর তার পর তা ধেয়ে যায় পৃথিবী-সহ সৌরমণ্ডলের সবক’টি গ্রহ, উপগ্রহের দিকে।
সিএমই আদতে খুব শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের একটি স্তম্ভের মতো। যার ‘পা’ থাকে সূর্যের পিঠে গজিয়ে ওঠা সানস্পটেই। সিএমই হলে সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ কণার বিষের ছোবল আমাদের বায়ুমণ্ডলের পক্ষে হয়ে ওঠে অত্যন্ত বিপজ্জনক। তা অত্যন্ত ক্ষতিকারক হয় মহাকাশের আবহাওয়ার পক্ষেও। যা তছনছ করে দিতে পারে পৃথিবীর যাবতীয় বিদ্যুত সংযোগ, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে আকাশে থাকা বিমানের। নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলিকেও। সৌরঝড়ও তেমনই।
নৈনিতালের ‘আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ অবজারভেশনাল সায়েন্সেস (এরিস)’-এর অধিকর্তা বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এটা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। কারণ, সূর্যের এত কাছে গিয়ে এই ধরনের ছোট ছোট সৌরঝলকের ছবি তোলা এর আগে সম্ভব হয়নি। এমন ছোট ছোট সৌরঝলকের তাত্ত্বিক পূর্বাভাস প্রথম দিয়েছিলেন বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী ইউজিন পার্কার। এর আগে হাই-সি রকেট থেকে এই ধরনের ন্যানোফ্লেয়ার দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তা অতটা নজরকাড়া হয়ে উঠতে পারেনি, সেই ছবি পৃথিবী থেকেই তোলা হয়েছিল বলে। আরও ছোট সৌরঝলকেরও (পিকোফ্লেয়ার’) তাত্ত্বিক পূর্বাভাস রয়েছে। তবে সেগুলিরও হদিশ মেলেনি এখনও পর্যন্ত।’’
দীপঙ্কর এও জানাচ্ছেন, খুব সম্ভবত এই ছোট ছোট সৌরঝলকগুলি তৈরি হচ্ছে সানস্পট থেকে দূরের কোনও জায়গায়। যেখানে চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি ততটা শক্তিশালী নয়। তাই এই ছোট সৌরঝলকগুলির শক্তি কম। তবে বড় বড় সৌরঝলক ও এই ন্যানোফ্লেয়ারগুলি একই প্রক্রিয়ায় তৈরি হচ্ছে কি না, তা এখনও বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy