বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। -ফাইল ছবি।
১০০ বছর আগেকার কথা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লেডিজ গ্রুপ’-এর সদস্যদের একটি অত্যন্ত জটিল গোলকধাঁধা থেকে বের করে এনেছিলেন এক ‘কালা আদমি’ বাঙালি। তাঁর হাতে থাকা ‘জাদুদণ্ড’ দিয়ে! সেই বাঙালির জাদুকাঠির ছোঁয়া আর ‘খুল্ যা সিম সিম’ মন্ত্রেই ‘চিচিং ফাঁক’ হয়ে গিয়েছিল! গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন হার্ভার্ডের ‘লেডিজ গ্রুপ’-এর সদস্যরা।
তাতে যদিও সেই ‘কালা আদমি’ বাঙালির কপাল খোলেনি! পাননি বলব না। বলব, তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। নোবেল পুরস্কারের জন্য যদিও সেই ‘কালা আদমি’র নাম মনোনীত হয়েছিল পাঁচ বার। কিন্তু প্রতি বারই শেষ মুহূর্তে প্রাপকদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায় তাঁর নাম। প্রতি বারই সেই ‘মেঘনাদবধ’-এর কাব্য!
অথচ ‘মেঘের আড়াল’ থেকে ‘যুদ্ধ’ করা সেই মেঘনাদ সাহার অঙ্কই গত ১০০ বছর ধরে গোলকধাঁধার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ‘আলো’ দেখাচ্ছে।
মহিলারা তারাদের ‘গোষ্ঠী’ গড়লেন উজ্জ্বলতার নিরিখে
হার্ভাডের ওই মহিলা সহকারী বিজ্ঞানীরা তখন আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরের তারাগুলির দিকে তাকাতে শুরু করেছিলেন। সেই তারাগুলি কতটা উজ্জ্বল আর তাদের সেই উজ্জ্বলতায় কেন বাড়া-কমা হয়, তা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’র নক্ষত্রগুলিকে তাঁরা সাতটি দলে ভাগ করেছিলেন। ‘ও’, ‘বি’,‘এ’, ‘এফ’, ‘জি’, ‘কে’ এবং ‘এম’।
অ্যালবামের পাতা উল্টে: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ‘লেডিজ গ্রুপ’। -ফাইল ছবি
তবু গোলকধাঁধায় আটকে গেলেন হার্ভার্ডের মহিলারা!
সেই গোলকধাঁধাটা কী? হার্ভার্ডের মহিলা বিজ্ঞানীরা দেখলেন, শুধুই উজ্জ্বলতা দিয়ে কোনও তারার বাছবিচার করে তার ‘গোত্র’ ঠিক করতে গিয়ে অনেক সমস্যা হচ্ছে। তাঁরা দেখলেন, কোনও তারার উজ্জ্বলতার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন আলোক নির্গমনের (‘কনটিনিউয়্যাস এমিসন) সম্পর্ক থাকলেও সেই তারা থেকে বিচ্ছুরিত আলোক বর্ণালি রেখার (লাইন এমিসন) উজ্জ্বলতার কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা এও দেখলেন, কোনও তারার উজ্জ্বলতা বাড়লে বিচ্ছুরিত আলোক বর্ণালি রেখার উজ্জ্বলতা বাড়তেও পারে, আবার কমতেও পারে।
সেটা যে কেন হয়, সেই জটটাই খুলতে পারছিলেন না হার্ভার্ডের সহকারি বিজ্ঞানী মহিলাদের দলটি।
আরও পড়ুন- হকিংয়ের সন্দেহ কি অমূলকই? তার কোনও চুল নেই! জানাল ব্ল্যাক হোল
মহিলাদের উদ্ধারকর্তা হলেন ‘কালা আদমি’ বাঙালি!
সাহা সমীকরণ এর আবিস্কারের পর ওই মহিলা বিজ্ঞানীদের দলটি দেখলেন, যে তারাদের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস, তারাই হয় সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল। সেই তারার রয়েছে ‘ও’ দলে। আর ‘বি’, ‘এ’, ‘এফ’, ‘জি’, ‘কে’ হয়ে কমতে কমতে যে নক্ষত্রগুলির উজ্জ্বলতা সবচেয়ে কম, সেগুলি রয়েছে ‘এম’ দলে।
সেই তাপমাত্রাও তারা মেপে ফেললেন। সেই প্রথম। ‘এম’ দলে থাকা তারাদের তাপমাত্রা আমাদের সূর্যের পিঠের তাপমাত্রার তিন ভাগের এক ভাগ । মেরেকেটে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই তাপমাত্রার নিরিখে আমাদের সূর্য পড়ে ‘জি’ দলে। তার পিঠ বা ‘ফোটোস্ফিয়ার’-এর তাপমাত্রা ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। মনে রাখার সুবিধার জন্য ওই পাঁচটি দলের নক্ষত্রকে বলা হয়, ‘ওবিএ ফাইন গার্লস কিস মি’!
মেঘনাদের সমীকরণই দেখাল, তারাদের ‘গোত্র’ বিচারের ক্ষেত্রে বেশি জরুরি ওই ওই বিচ্ছুরিত আলোক বর্ণালি রেখাই।এই ‘লাইন এমিসন’ নির্ভর করে মৌলগুলির আয়নীভবনের উপর। বোলৎজম্যানের তত্ত্ব মানা হলে, আলোর বর্ণালি রেখার উজ্জ্বলতা তাপমাত্রার সঙ্গে বাড়ে। কিন্তু সাহার আয়নীভবনের তত্ত্ব বলছে, সেই উজ্জ্বলতা কমেও যেতে পারে, যদি কখনও মৌলটি আগেই আয়নীভুত হয়ে যায়।
সেই ‘সাহা সমীকরণে’র একাংশ। -ফাইল ছবি
এই ভাবেই ব্রহ্মাণ্ডে যে কোনও অজানা নক্ষত্রকে জানা বা অচেনা তারাকে চেনা-বোঝার রাস্তাটা খুলে দিলেন মেঘনাদ। আজ থেকে ৯৯ বছর আগে। ১৯২০ সালে। প্রকাশিত হল কিংবদন্তী বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সেই বিখ্যাত সমীকরণ। যার নাম- ‘সাহা আয়োনাইজেশন ইক্যুয়েশন’ বা ‘সাহা আয়নীভবন তত্ত্ব’।
ভিনগ্রহে জল বা মৌল খুঁজতে ভরসা এখনও মেঘনাদই
এখনও ভিনগ্রহের ভিন মুলুকে পৃথিবীর মতোই জল রয়েছে কি না, সেই জল তরল নাকি কঠিন বা গ্যাসীয় অবস্থায় রয়েছে, তা জানতে এখনও আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় সেই মেঘনাদের সমীকরণের কাছেই। কোন কোন মৌল দিয়ে গড়া সেই সব নক্ষত্রের শরীর আর তা রয়েছে কতটা পরিমাণে তা জানতে সেই লাইন এমিশনের উপরেই নজর রাখতে হয়। যেমনটি বলেছিলেন মেঘনাদ সাহা।
‘সাহা সমীকরণে’র একাংশ। -ফাইল ছবি
আর এই সন্ধান যেহেতু চলবে আর আগামী দিনে তা বাড়বে আরও কয়েক গুণ, তাই বলাই যায়, সভ্যতা যত দিন টিঁকে থাকবে, তত দিনই ভিনগ্রহের ভিন মুলুকে প্রাণ বা প্রাণ সৃষ্টির ‘বীজ’ মৌলগুলির খোঁজ করতে আমাদের বার বার দ্বারস্থ হতে হবে সেই মেঘনাদের কাছেই।
তবু ‘মেঘের আড়ালে’ই থেকে গেলেন মেঘনাদ!
মেঘনাদের ওই সমীকরণ নিয়ে তখন তোলপাড় হয়ে গেল গোটা বিশ্ব। দাবি উঠল তাঁকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করার।
নোবেল পুরস্কার কমিটির কাছে মেঘনাদ সাহার নাম প্রথম বার মনোনয়ন করে পাঠালেন আর্থার হোলি কম্পটনের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানী। সেটা ১৯৩৭ সাল। কিন্তু শেষ বিচারে মেঘনাদকে হিসেবের মধ্যেই রাখল না নোবেল কমিটি।
আরও পড়ুন- চাঁদ-বুধ-মঙ্গল-শনিতে ৬০ বছর ধরে চলছে ‘মৃত্যু’, ‘নিরুদ্দেশ’, ‘আত্মহত্যা’র মিছিল!
তার ঠিক তিন বছরের মাথায় ১৯৪০-এ আবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মেঘনাদকে মনোনয়ন দিলেন কম্পটন। না, সে বারও ‘মেঘের আড়ালে’ই থেকে গেলেন মেঘনাদ।
মেঘনাদকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য তার ঠিক আগের বছর, ১৯৩৯-এ নোবেল কমিটির কাছে সুপারিশ করেছিলেন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী শিশির কুমার মিত্র (যাঁর নামে চাঁদের একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয়েছে)। তাঁর কথাও কানে তোলেনি নোবেল কমিটি।
‘সাহা সমীকরণে’র একাংশ। -ফাইল ছবি
তার পরেও হাল ছাড়েননি অধ্যাপক মিত্র। ১৯৫১ এবং ১৯৫৫ সালে ফের নোবেল পুরস্কারের জন্য মেঘনাদ সাহার নাম সুপারিশ করেছিলেন অধ্যাপক মিত্র।
কিন্তু ‘কালা আদমি’কে মেঘের আড়াল থেকে বের করে আনতে সেই দু’টি বারেও এগিয়ে আসেনি নোবেল কমিটি! লেখা হয়েছিল ‘মেঘনাদবধ কাব্য’!
সারাটা জীবন ধরে মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন মেঘনাদ। আর সেই যুদ্ধে জিতেই সভ্যতার হাতে তুলে দিয়ে গেলেন অজানা, অচেনা ব্রহ্মাণ্ডকে জানা, চেনা ও বোঝার এক ব্রহ্মাস্ত্র!
লেখক কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-এর অধিকর্তা, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী
অনুলিখন: সুজয় চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy