Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Environment

পবিত্র অরণ্য

বিশ্ব জুড়ে চলছে বনাঞ্চল ধ্বংসের কর্মকাণ্ড। অথচ, পরিবেশ রক্ষার প্রাচীন জ্ঞান জানা ছিল মানবজাতিরসেক্রেড গ্রুভস শুধু যে বাংলা বা ভারতের একটি ধারণা, এমন নয়।

ধনঞ্জয় ঘোষাল
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

বায়োস্ফিয়ার রিজ়ার্ভ, স্যাংচুয়ারি, বা ন্যাশনাল পার্কের মতো ‘সেক্রেড গ্রুভ’ শব্দটি এখনও ততখানি পরিচিত হয়ে ওঠেনি আমাদের সমাজে। অথচ, জীববৈচিত্র্য ধরে রাখার বিভিন্ন উপায়ের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন পদ্ধতিটি হল সেক্রেড গ্রুভের ধারণা।

নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পরিবেশকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে, এই ভাবনা প্রাচীন কালের মানুষ ভেবেছিল যখন, বিজ্ঞান দৈনন্দিন জীবনে ততখানি সহায়ক তখনও হয়ে ওঠেনি। তারা প্রথমেই ভেবেছিল যে, মানুষের হস্তক্ষেপ থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে পারলে তবেই গাছগাছালি রক্ষা পাবে। সাধারণ মানুষ অথবা গ্রামবাসীরা বিভিন্ন ধরনের গাছগাছালি যুক্ত বেশ কিছু স্থানের সঙ্গে লোককথা, জনশ্রুতি, মিথ ইত্যাদি জুড়ে দিয়ে জায়গাটিকে অবিকল রক্ষা করার উপায় বাতলে পরিবেশ ধরে রাখতে চেয়েছিলেন, আজকের পরিবেশবিজ্ঞান যাকে ‘সেক্রেড গ্রুভস’ অভিধায় ভূষিত করেছে। ‘সেক্রেড’ অর্থে পবিত্র বা শুদ্ধ, ‘গ্রুভ’ মানে গাছগাছালি যুক্ত খানিকটা উদ্যান বা ছোট অরণ্য।

পরাধীন ভারতে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের প্রথম জেনারেল ডিরেক্টর ছিলেন জার্মান বটানিস্ট ডিয়েট্রিচ ব্র্যান্ডিস, যিনি ভারতের অরণ্য সম্পদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেন এই ধরনের কিছু জায়গা, যা প্রাকৃতিক ভাবে রক্ষিত হয়ে আছে গ্রামবাসীদের দ্বারা, যুগ যুগ ধরে লোককথা, মিথ, বিভিন্ন বিশ্বাসের উপর ভর করে। ব্র্যান্ডিসের প্রচেষ্টায় ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট-এর সূত্রপাত হয়। ১৯০৬-এ প্রকাশিত ব্র্যান্ডিসের বিখ্যাত বই ইন্ডিয়ান ট্রিজ় আজও সমাদৃত। তিনি কেরল, কর্নাটক, খাসি হিলস ও রাজস্থানে অবস্থিত এই ধরনের গ্রুভগুলিকে চিহ্নিত করেন। পরবর্তী কালে ভারতের বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে অরণ্যবেষ্টিত এই ধরনের জায়গা চিহ্নিত হয়। সেক্রেড গ্রুভ প্রাচীন কাল থেকে রক্ষিত গাছপালা সম্বলিত ছোট-বড় খানিকটা জমি, কখনও সেখানে মন্দিরও থাকতে পারে, কখনও পুকুর অথবা ডোবা থাকে, কিংবা জায়গাটিকে দেবোত্তর সম্পত্তি বলেও চিহ্নিত করা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল, মানুষ যাতে নিজের প্রয়োজনে গাছপালা কেটে জায়গাটিকে নষ্ট করে না দেয়।

ধর্মের কোনও ভেদ থাকে না গ্রুভগুলিতে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে। সাধারণত বড় আয়তনের সেক্রেড গ্রুভগুলিতে একটি প্রবেশ-নিষিদ্ধ অংশ থাকতে পারে, আর একটি অংশ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত থাকে, সেখানে মন্দির থাকলে পুজো দেওয়ার বন্দোবস্ত থাকে, পুজো-পার্বণে স্থানীয় মেলা বসে বা গ্রামীণ মিটিং হয়। সামাজিক ভাবে গ্রুভগুলি বিরাট ভূমিকা পালন করে। বাংলায় এই পবিত্র অরণ্যে প্রধানত লতাজাতীয় গুল্মের সঙ্গে বট, অশ্বত্থ, আম, জাম, বাঁশ ইত্যাদি গাছ দেখা যায়।

জার্মান উদ্ভিদবিদ ডিয়েট্রিচ ব্র্যান্ডিস প্রথম একক প্রচেষ্টায় ভারতের সেক্রেড গ্রুভস নিয়ে সমীক্ষা শুরু করেন।

সেক্রেড গ্রুভস শুধু যে বাংলা বা ভারতের একটি ধারণা, এমন নয়। সারা পৃথিবীতে এমন অজস্র জায়গা আছে, যা বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবে এখন স্বীকৃত। এই সব জায়গায় গাছের পাতা ছেঁড়া, গাছের কাঠ কাটা নিষিদ্ধ। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন যে, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এই জায়গাগুলি হল সেখানকার এক-একটি ফুসফুস।

পরিমাণমতো অক্সিজেনের জোগান দেওয়া ছাড়াও সেক্রেড গ্রুভস ভূমিক্ষয় আটকে দেয়, আঞ্চলিক ভাবে জলচক্র নিয়ন্ত্রণ করে, বিভিন্ন প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করে ও জীববৈচিত্র্যের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায়। গবেষকদের মতে, এই ক্ষেত্রগুলি ভেষজ গাছের দুর্লভ সম্ভারও বটে। বর্তমানে ‘ইউনাইটেড নেশন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ আন্তর্জাতিক সংস্থা জানিয়েছে যে, সেক্রেড গ্রুভগুলির ভূমিকা বাতাসের কার্বন শোষক হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিন হাউস গ্যাস শুষে নেয় বলে স্থানীয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এই পবিত্র অরণ্য।

ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের প্রায় ২২ শতাংশ অঞ্চল অরণ্যবেষ্টিত। তার মধ্যে মিজোরাম, অরুণাচল ও মধ্যপ্রদেশে অরণ্যের পরিমাণ বেশি। তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল সামগ্রিক ভাবে সেক্রেড গ্রুভসের দখলে রয়েছে। কেরলে কাভু, ওড়িশায় জাহেরা, তামিলনাড়ুতে কইকাডু, উত্তরাখণ্ডে দেবভূমি নামে পরিচিত এই সব অরণ্যবেষ্টিত ক্ষেত্র। ভারতের মধ্যে হিমাচল প্রদেশে নথিভুক্ত গ্রুভসের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

বাংলার বিভিন্ন গ্রামে যে থান রয়েছে, সেগুলি সেক্রেড গ্রুভসের চরিত্র বহন করে কম-বেশি। মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়ায় এ রকম অজস্র জায়গা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে। মূলত সাবিত্রীথান, হরিথান, শিবথান, কালিথান, যুগীপুকুর ইত্যাদি নামেই পশ্চিমবঙ্গে সেক্রেড গ্রুভস পরিচিত। বাংলার সীমান্ত অঞ্চল মেদিনীপুরের চিল্কিগড়ে একটি উল্লেখযোগ্য সেক্রেড গ্রুভ রয়েছে ডুলুং নদীর ধারে। কনক-দুর্গার মন্দিরকে কেন্দ্র করেই চিল্কিগড়ের অরণ্যসম্ভার। জীববৈচিত্র্যের জন্য সারা পৃথিবীর কাছে উল্লেখযোগ্য চিল্কিগড়। এখানে অনেক ‘এনডেমিক স্পিসিস’ রয়েছে। অর্থাৎ, এমন সব গাছ অথবা প্রাণী আছে, যা অন্য কোথাও পাওয়ার সম্ভাবনা বিরল। কৈলাস মলহোত্র ও তাঁর সহযোগীদের অনুসন্ধান থেকে জানা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গে ৬৭০টি এই ধরনের থান রয়েছে। ভারত সরকারের মিনিস্ট্রি অব এনভায়রনমেন্ট ফরেস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সংখ্যাটি ৫৬২।

বর্তমানে বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবে সারা বিশ্বে ট্র্যাডিশনাল নলেজ বা পরম্পরাগত ধারণাকে রক্ষা করা ও নথিভুক্ত করার চেষ্টা চলেছে। সেক্রেড গ্রুভস-কে ট্র্যাডিশনাল নলেজের তেমনই একটি স্তম্ভ বলা যায়। ট্র্যাডিশনাল নলেজের প্রেক্ষিতে দেব-দেবীর ধারণা জুড়ে তুলসী, বট, অশ্বত্থ, অর্জুন, ধুতরা, নিম, বেল ইত্যাদি গাছের উপকারিতা বুঝে নির্বিচারে তাদের ছেদন আটকে রাখা গিয়েছিল। ট্র্যাডিশনাল নলেজের আর একটি দিক হল, বিভিন্ন পশু-পাখির সঙ্গে দেব-দেবীর বাহনের সম্পর্ক গড়ে তুলে সেই সব প্রাণীর হত্যা রদ করা ও জীববৈচিত্র্য ধরে রাখা।

১৯৯২-এ জীববৈচিত্র্য নিয়ে যে উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক অধিবেশন হয়েছিল, তা সিবিডি বা কনভেশন অন বায়োলজিক্যাল ডায়ভারসিটি নামে খ্যাত। সেখান থেকেই সেক্রেড গ্রুভসের ধারণা গুরুত্ব পেতে থাকে সারা পৃথিবীতে। ২০০২-এ ভারতে সেক্রেড গ্রুভসের ধারণা ১৯৭২-এর ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে এগুলি আর বিলুপ্ত না হয়ে যায়।

পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য গ্রুভসের মধ্যে অন্যতম গ্রিসের দোদোনা অঞ্চল। এটি মূলত ওক গাছের অরণ্য। এখানে সবুজ বাঁচানোর জন্য গ্রুভসের সঙ্গে জুড়ে আছে গ্রিসের উপকথা। ইতালিতেও রয়েছে একাধিক সেক্রেড গ্রুভ। জাপানের শিন্টো সম্প্রদায় লোকবিশ্বাস দিয়ে অরণ্যবেষ্টিত যে ভূমিকে রক্ষা করে এসেছে, আজকের প্রজন্মও যথাযথ নিষ্ঠায় সেগুলিকে প্রাকৃতিক সম্পদ মনে করে।

সেক্রেড গ্রুভসের তেমন কোনও বাংলা পরিভাষা এখনও প্রচলিত হয়নি। পবিত্র থান বললেই যেন একটি সেকেলে ধারণা আলগা ভাবে এসে হাজির হয়। লোকবিশ্বাস, মিথ, মন্দির, শেকড়-বাকড়, ঢিল-বাঁধা, মানত করা ইত্যাদি। এগুলো শুনলেই এর গুরুত্ব অনুধাবন না করে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যুগ যুগ ধরে মুখে মুখে প্রবাহিত এই সংস্কৃতি অবহেলিত থেকে গিয়েছে বিজ্ঞানমনস্কদের জন্যেই। বছর দুই আগে নেচার পত্রিকা গ্রুপের পপুলার ম্যাগাজিন সায়েন্টিফিক আমেরিকান সেক্রেড গ্রুভসের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এর পর আধুনিক পশ্চিমি বিজ্ঞান মহলের নজর পড়ে অরণ্য রক্ষার এই প্রাচীন পদ্ধতিতে। এক-একটি সেক্রেড গ্রুভ সেখানকার ফুসফুস, অক্সিজেনের জোগানদার। তাই সেক্রেড গ্রুভসকে যথাযথ আইনি আওতায় এনে বাঁচানোর চেষ্টা ও উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রয়োজন।

অন্য বিষয়গুলি:

Environment Scared Groves
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy