সেই ‘রাক্ষসপুরী’। এনজিসি-৬৩৯৭ গ্লোবিউলার স্টার ক্লাস্টার। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
মহাকায় কোনও রাক্ষস নেই সেই তল্লাটে। শুধুই ছোট ছোট রাক্ষস আর খোক্কসে ভরে আছে সেই রাক্ষসপুরী।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম এমন একটি অদ্ভুতুড়ে ‘রাক্ষসপুরী’র হদিশ মিলল। যার পোশাকি নাম- ‘এনজিসি-৬৩৯৭’। সৌরমণ্ডলের কাছেপিঠে যে নক্ষত্রপুঞ্জগুলি রয়েছে, তারই একটিতে রয়েছে এই রাক্ষসপুরী। নক্ষত্রপুঞ্জটি একেবারেই গোলাকার (‘গ্লোবিউলার’)।
মহাকাশে থাকা হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপের চোখে ধরা পড়েছে সেই অদ্ভুত রাক্ষসপুরী। পৃথিবী থেকে ৭ হাজার ৮০০ আলোকবর্ষ (আলোর গতিতে ছুটলে এক বছরে যতটা দূরত্ব পেরনো যায়) দূরে। হাব্লের সেই দর্শন যে ভুল ছিল না তা পরে প্রমাণিত হয়েছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (এসা) মহাকাশে থাকা টেলিস্কোপ ‘গাইয়া’-র চোখেও। আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’-এ।
‘সবাই রাজা’র মুলুক!
সেই অবাক করা মুলুকে ‘আমরা সবাই রাজা’র মন্ত্রে বিশ্বাস করে রাক্ষস, খোক্কসেরা। সেই রাজত্বে ঠাঁই নেই তাই কোনও মহারাক্ষসের। কোনও ‘রাজাধিরাজ’ নেই, ‘সম্রাট’ নেই, নেই কোনও ‘কিং’। সেই মুলুক শুধু ছোটখাটো ‘সামন্ত প্রভু’দেরই! যেখানে এক-একটি রাক্ষস তার নিজের নিজের রাজত্ব (‘গড়’ও বলা যায়) সামলাচ্ছে।
হাব্লের এই আবিষ্কার আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রায় সাড়ে ৪০০ বছরের ইতিহাসের যাবতীয় ধ্যান, ধারণাকেই বদলে দিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এত দিনের ধারণায় জোর ধাক্কা?
এত দিন জানা ছিল, ছোট হোক বা বড়, সব গ্যালাক্সিরই কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকে একটি মহাদৈত্যাকার মহারাক্ষস। যার পোশাকি নাম ‘সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল’। মহাদৈত্যাকার কৃষ্ণগহ্বর। যাদের ভর সূর্যের ভরের এক কোটি থেকে ১০০ কোটি গুণ বা তারও বেশি হয়। এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে ভারী যে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের হদিশ মিলেছে (‘হোম-১৫এ’) এই সৌরমণ্ডলের কাছেপিঠের ব্রহ্মাণ্ডে, তার ভর সূর্যের ভরের ৪ হাজার কোটি গুণ বেশি। এরা গ্যালাক্সির কেন্দ্রে কাছেপিঠের গ্যাস আর পদার্থ গোগ্রাসে খেয়ে গড়ে ওঠে। তার পর নাগালে চলে আসা তারাদের চেটেপুটে খেয়ে গায়েগতরে মহাদৈত্যাকার হয়ে ওঠে। আলোও তাদের নাগপাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই এই রাক্ষসদের দেখাও যায় না।
এ ছাড়াও প্রচুর ছোটখাটো ব্ল্যাক হোলের খোঁজ মিলেছে। যেগুলি সূর্যের ভরের ৫/৬ গুণ থেকে শুরু করে ১০০ গুণ মতো ভারী হয়। এদের বলা হয় ‘স্টেলার মাস ব্ল্যাক হোল’। নক্ষত্রের মৃত্যু হলে এদের জন্ম হয়।
কিন্তু বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, এই ভাবে ছোট থেকে দুম্ করে মহাদৈত্যাকার ব্ল্যাক হোল তৈরি হতে পারে না। মধ্যবর্তী কোনও ধাপ রয়েছে নিশ্চয়ই। সেগুলি ছোট ছোট ব্ল্যাক হোলের থেকে ওজনে অনেক বেশি ভারী। আকারেও অনেক বড়। তাদের বলা হয় ‘ইন্টারমিডিয়েট ক্লাস ব্ল্যাক হোল’। এরা সূর্যের চেয়ে ১০০ থেকে ১ হাজার গুণ ভারী হয়। কোনও একটি বা সামান্য কয়েকটি তারার মৃত্যু হলে এগুলি তৈরি হতে পারে না। এদের জন্মানোর জন্য কম করে ১০০টি তারার মৃত্যু প্রয়োজন কাছেপিঠে। যাদের খেয়ে গড়ে উঠতে পারে এই ধরনের রাক্ষসগুলি।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বহু দিন ধরেই বলে আসছেন, এমন কোনও গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রপুঞ্জ পাওয়া যাবে যার কেন্দ্রে রয়েছে এমন ইন্টারমিডিয়েট ক্লাস-এর ব্ল্যাক হোল। যেগুলি মহাদৈত্যাকারও নয়, আবার ছোট ছোট স্টেলার মাস ব্ল্যাক হোলও নয়। এমন গোত্রের ব্ল্যাক হোলের হদিশ মিললে তাঁদের বোঝা সহজ হত কী ভাবে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল গড়ে ওঠে?
‘মুক্তো’ খুঁজতে গিয়ে ‘ঝিনুক’?
অন্যতম গবেষক ফ্রান্সের ‘প্যারিস ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্স' (আইএপি)-র জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক গ্যারি ম্যামন ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-কে ই-মেল জবাবে লিখেছেন, 'যেহেতু পুরোপুরি একটি গ্যালাক্সি নয়, এনজিসি-৬৩৯৭ আদতে একটি নক্ষত্রপুঞ্জ (যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা খুব জোরালো অভিকর্ষের টানে একটি কেন্দ্রে একে অন্যের গায়ে প্রায় লেগে আছে), তাই বিজ্ঞানীদের আশা ছিল এখানকার কেন্দ্রে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাস-এর ব্ল্যাক হোলের খোঁজ মিললেও মিলতে পারে। কিন্তু হাব্ল আমাদের চমকে দিয়েছে। দেখিয়েছে কোনও মহাদৈত্যাকার বা মাঝারি আকারের কোনও দৈত্যও সেই মুলুকে নেই। রয়েছে শুধুই ছোটখাটো রাক্ষস'।
এমন আবিষ্কারের কোনও তাত্ত্বিক পূর্বাভাস ছিল?
বেঙ্গালুরুর ‘রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউট' (আরআরআই)-এর অধ্যাপক জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিমান নাথ বলছেন, ‘‘এর কোনও তাত্ত্বিক পূর্বাভাস ছিল বলে আমার অন্তত জানা নেই। এই ভাবে আদৌ কেউ ভেবেছিলেন কি না, সেটাও খুঁজে দেখতে হবে। এমন কোনও ভাবনাচিন্তার কথা চোখে পড়েনি অন্তত।’’
এই অদ্ভুতুড়ে রাক্ষসপুরী তৈরি হল কী ভাবে?
নৈনিতালের ‘আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব অবজারভেশনাল সায়েন্স (এরিস)’-এর অধ্যাপক ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এই নক্ষত্রপুঞ্জে দেখা গিয়েছে তারাগুলি দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে যে দিকে খুশি (‘র্যান্ডম মোশন’) ছুটে বেড়াচ্ছে। কেন্দ্রে সুপারম্যাসিভ বা ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের ব্ল্যাক হোল থাকলে যেটা সম্ভই হত না। কারণ, ব্ল্যাক হোলের অভিকর্ষ বলের টান এতটাই জোরালো যে তারাগুলি যে দিকে খুশি ছোটাছুটি করতে পারতো না। এটা বেশ অবাক করা ঘটনাই।’’
বিমান জানাচ্ছেন, নক্ষত্রপুঞ্জে ভারী তারাগুলো ধীরে ধীরে অন্দরমহলে চলে আসে। সেগুলি যখন নিউট্রন নক্ষত্র বা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়, তখন এই রকম অবস্থা তৈরি হতে পারে, যা দেখা গিয়েছে। গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অন্য ধরনের পরিবেশ। সেখানে প্রচুর গ্যাস রয়েছে, যা শুষে নিয়ে কেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বর ক্রমাগত ভারী হয়ে উঠতে পারে। নক্ষত্রপুঞ্জে কিন্তু বিশেষ গ্যাস নেই। যেটুকু ছিল, তা নক্ষত্র সৃষ্টির কাজেই লেগে গিয়েছে। তাই সেখানে বিশাল বড় কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমই থাকে।
এর পরেই বিমান বললেন, ‘‘জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক অসাধারণ যুগ আমরা প্রত্যক্ষ করছি এখন। ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়! কার্ল সাগান স্কুলের ছাত্রদের একটা ক্লাসে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে হয়ত দূরের নক্ষত্রের চার দিকেই গ্রহ আবিষ্কৃত হবে। একেবারে মালার মতো। চল্লিশ বছর আগেকার কথা। এমন গ্রহ পরে শুধু আবিষ্কৃতই হয়নি, তার অস্তিত্বের হাজার হাজার উদাহরণ পাওয়া গিয়েছে। সেই আবিষ্কার নোবেল প্রাইজও পেয়েছে।’’
তবে ব্রহ্মাণ্ডে এমন ‘আমরা সবাই রাজা’র রাক্ষসপুরীর কথা সাগানও বলে যেতে পারেননি অন্তত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy