গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
বড় একটা ‘চোখ’ বসানো হচ্ছে দেবস্থলে। মহাকাশ থেকে আমাদের সব রকমের সম্ভাব্য বিপদ-আপদগুলির উপর সব সময় নজর রাখার জন্য। সেই সব আচমকা বিপদ, যেগুলি মুহূর্তের মধ্যে তছনছ করে দিতে পারে আমাদের যাবতীয় যোগাযোগব্যবস্থা, ইন্টারনেট, টেলিভিশন সম্প্রচার। বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের সর্বাধুনিক ব্যবস্থাও। ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে মহাকাশে এমন নজরদারি এই প্রথম।
যাতে আচমকা অসম্ভব গতিবেগে আমাদের দিকে ধেয়ে আসা গ্রহাণুগুলি (অ্যাস্টারয়েডস বা ‘নিয়ার-আর্থ অবজেক্টস বা এনইও’)-র খবর আমরা আগেভাগেই জানতে পারি। কোনটা আমাদের কতটা কাছে আসছে, সেগুলি চেহারায় কতটা বড় বা তা আমাদের উপর হামলে পড়বে কি না, বুঝতে পারি।
দেবস্থলের নজর কার দিকে?
দেবস্থলের 'চোখ'-এ ধরা পড়বে মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন উপগ্রহ, মহাকাশযান বা তাদের বিভিন্ন অংশের অসংখ্য ধ্বংসাবশেষও (স্পেস ডেব্রি বা স্পেস জাঙ্ক)। নজরে থাকবে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে দীর্ঘ দিন ধরে প্রদক্ষিণরত সেই কৃত্রিম উপগ্রহগুলিও, যেগুলি এখন অচল। মহাকাশে পাড়ি জমানোর পথে তারা যাতে আমাদের পাঠানো উপগ্রহ, মহাকাশযান বা মহাকাশচারীদের কোনও ক্ষতি না করতে পারে।
তার জন্য নৈনিতালের অদূরে দেবস্থলে বসানো হচ্ছে একটি অপটিকাল টেলিস্কোপ। নৈনিতালের ‘আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ অবজারভেশনাল সায়েন্সেস (অ্যারিস)’-এর সঙ্গে সম্প্রতি সমঝোতাপত্র (‘মউ’) স্বাক্ষরিত হয়েছে ইসরোর। লকডাউনের সময়েই। ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে।
সমঝোতাপত্রে সই করছে ইসরো ও অ্যারিস। বেঙ্গালুরু থেকে নৈনিতাল। ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে।
এই প্রথম ভারত থেকেই এই সবের উপর নজর রাখতে শুরু করবে ইসরো। তার জন্য ইসরোয় ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে একটি বিশেষ বিভাগ। ‘নেত্র’।
আরও একটি 'চোখ' বসবে হানলে-তে
‘অ্যারিস’-এর অধিকর্তা সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দীপঙ্কর বন্দোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এই বছরেই দেবস্থলে শুরু হচ্ছে ওই অপটিকাল টেলিস্কোপ বসানোর কাজ। টেলিস্কোপের লেন্সের ব্যাস হবে ৫০ সেন্টিমিটার। এমন ধরনের আরও একটি ‘চোখ’, আরও একটি অপটিকাল টেলিস্কোপ বসানো হবে হানলে-তেও। তার লেন্সের ব্যাস ১ মিটার হওয়ার কথা। ইসরো দেবস্থলে টেলিস্কোপটি বসাচ্ছে অ্যারিস-এর হাতে হাত মিলিয়ে। আর হানলে-র টেলিস্কোপটি ইসরো বসাবে বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইআইএ)’-এর সহযোগিতায়।
দেখুন কী পরিমাণে আবর্জনা জমেছে মহাকাশে!
এই ভাবে আগামী দিনে দু’টি চোখ দিয়ে মহাকাশ থেকে আমাদের সম্ভাব্য বিপদআপদগুলির উপর নজর রাখা হবে। ভারত থেকেই। তার ভিত্তিতে আমাদের নিরাপত্তা ও মহাকাশের আবহাওয়াকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপ হবে। এখন আমাদের যাবতীয় যোগাযোগব্যবস্থা, ইন্টারনেট, টেলিভিশন সম্প্রচার, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের সর্বাধুনিক ব্যবস্থা, সব কিছুই কক্ষপথে থাকা উপগ্রহগুলির উপর নির্ভরশীল। তাই মহাকাশের আবর্জনার ফলে সেই উপগ্রহগুলির ক্ষয়-ক্ষতি হলে আমরা দারুণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব।
কেন ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই স্পেস ডেব্রি?
মহাকাশে পা়ড়ি জমানোর দৌড় শুরু হওয়ার পর থেকে গত ৫০/৬০ বছরে যে পরিমাণে ধ্বংসাবশেষ বা আবর্জনা জমা হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে, তা খুব কম তো নয়ই, বরং তা দিনে দিনে আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন- নিজের ছোড়া ‘বাণ’ থেকে আমাদের বাঁচায় সূর্যই! দেখালেন মেদিনীপুরের সঞ্চিতা
আরও পড়ুন- কোনও অদৃশ্য শক্তি আছে কি ব্রহ্মাণ্ডে? নোবেলজয়ীদের তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ অক্সফোর্ডের বাঙালির
আমাদের পাঠানো অসংখ্য উপগ্রহ তাদের মেয়াদ ফুরনোর পর কক্ষপথেই অচল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার কোনও ব্যবস্থা না থাকার ফলে সেগুলি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেই চলেছে। এগুলিই মহাকাশে আবর্জনা হয়ে উঠেছে। মহাকাশযাত্রার সময় রকেট যে খোলস ও পে-লোডগুলি ছেড়ে এগিয়ে যায় ধাপে ধাপে, তাদের জন্য যেমন এই আবর্জনা জমে, তেমনই তা জমে দীর্ঘ দিন ধরে অচল হয়ে কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চলা কৃত্রিম উপগ্রহগুলির জন্যও। তাদের চেহারা কয়েক সেন্টিমিটার থেকে কয়েক মিটারও হতে পারে।
দীপঙ্কর বলছেন, “পৃথিবীর কক্ষপথে এই সব ধ্বংসাবশেষ বা আবর্জনার সংখ্যা বা পরিমাণ যত বাড়বে, ততই বাড়বে তাদের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনাও। সেই সংঘর্ষের ফলে সেগুলি আরও টুকরো টুকরো হবে। ফলে, আরও বাড়বে ধবংসাবশেষ বা আবর্জনার পরিমাণ। এগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা সক্রিয় উপগ্রহ বা মহাকাশযান অথবা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকা মহাকাশচারীদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।’’
স্পেস ডেব্রি কতটা বিপজ্জনক? আমাদের কী করণীয়? দেখুন ভিডিয়ো
হলিউডের বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন ফিল্ম ‘গ্র্যাভিটি’-তে তেমনটাই দেখেছিলেন নাসার স্পেস শাটল ‘এক্সপ্লোরার’-এ থাকা মহাকাশচারী রায়ান স্টোন।
পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে এই সব ধ্বংসাবশেষ বা আবর্জনার পরিমাণ খুব বেশি বেড়ে গেলে ভয়াবহ সংঘর্ষের আশঙ্কায় সেই কক্ষপথগুলিতে আর নতুন উপগ্রহ পাঠানো যায় না।
একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ‘ফেঙইউন-ওয়ানসি’ উপগ্রহটি পৃথিবীর কক্ষপথে ধ্বংস হওয়ার পর যে পরিমাণে ধ্বংসাবশেষ জমা হয়েছিল আমাদের থেকে ৮০০ কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে, তা ওই কক্ষপথে আগে জমা আবর্জনার পরিমাণের দ্বিগুণেরও বেশি। আর এত দিনে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে এই সব ধ্বংসাবশেষ বা আবর্জনা যে পরিমাণে জমা হয়েছে, তার ৩০ শতাংশই জমা করেছিল ফেঙইউন-ওয়ানসি উপগ্রহের ধ্বংসাবশেষ।
আরও পড়ুন- ফের মিলল বাঙালির পূর্বাভাস, লকডাউনেও সৌরমণ্ডলে ঢুকল ভিন্ মুলুকের ‘রাজহাঁস’
আরও পড়ুন- এ বার ফিরতে পারে হাম, পোলিও, রুবেলার মহামারি, বিপন্ন আট কোটি শিশু, হুঁশিয়ারি হু, ইউনিসেফের
কী বলছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির রিপোর্ট?
দীপঙ্কর জানাচ্ছেন, সে জন্যই ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (‘ইসা’) ২০০৯ সালের রিপোর্টে এই সব আবর্জনা কমানোর জন্য কয়েকটি ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিল। সেগুলির মধ্যে রয়েছে, কোনও দেশের কোনও মহাকাশ সংস্থাই যেন আর নতুন করে মহাকাশে এই আবর্জনার পরিমাণ না বাড়ায়। পৃথিবীর কাছের কক্ষপথগুলিতে থাকা উপগ্রহগুলিকে ২৫ বছরের মধ্যে কক্ষপথ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে (‘ডি-অরবিট’)। মেয়াদ ফুরনোর পর জিওস্টেশনারি কক্ষপথে থাকা উপগ্রহগুলিকে আরও উপরের কক্ষপথে পাঠিয়ে দিতে হবে। অচল হয়ে পড়া উপগ্রহগুলিকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা যায় কি না, তার পরীক্ষানিরীক্ষাও শুরু করতে হবে।
ছবি সৌজন্যে: আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ অবজারভেশনাল সায়েন্সেস (অ্যারিস), নৈনিতাল।
ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ('ইসা')।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy