আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। -ফাইল ছবি।
অতলান্ত মহাসাগর তাকে ডাকছে ‘আয় আয়’! কিন্তু পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করার ‘উৎসাহে’ তার ভাটা নেই। সূর্যের আলোই (সৌরশক্তি) তাকে সেই উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে। যাবেও।
তবে আজ না হোক, কাল বা পরশু সেই ডাকে সাড়া দিতেই হবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকে। সেটাই যে তার অনিবার্য পরিণতি!
দু’দশকেরও বেশি সময় কেটে গেল মহাকাশে।মহাকাশে গড়ে দিল সভ্যতার উজ্জ্বল ইতিহাস। অতলান্ত মহাসাগরে তাকে ছুড়ে ফেলার দিন যে ঘনিয়ে এল! তার পরেই সলিলসমাধি ঘটবে আন্তর্জাতিক ফুটবল মাঠের চেহারার মহাকাশ স্টেশনের। প্রশান্ত মহাসাগরেই হবে তার ‘শান্তির নির্বাণ’!
৬টি ঘরের স্টেশন গড়ার ৫ কারিগর!
৬টি ঘরের ওই মহাকাশ স্টেশনকে চালু রাখার খরচের বোঝা যে উত্তরোত্তর ভারী হয়ে চেপে বসছে নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইসা), জাপান স্পেস এজেন্সি (জাক্সা), রুশ মহাকাশ সংস্থা (রসকসমস) ও কানাডার মহাকাশ সংস্থার (সিএসএ) কাঁধে। আমেরিকা (পড়ুন, নাসা) যে বোঝাটা আর বইতে চাইছে না। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উপরে পৃথিবীর কক্ষপথে পাক মেরে চলার মোহ কাটিয়ে নাসা যে এ বার ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার দূরে চাঁদ-মুলুকে আস্তানা গাড়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। নাসা এ বার চাঁদের কক্ষপথে আস্তানা বানাবে। ‘লুনার স্টেশন’। প্রকল্পের নাম ‘আর্টেমিস’।
এই দৈত্যাকার মহাকাশ স্টেশন গড়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল আটের দশকে। লক্ষ্য, বাতাসহীন প্রায় শূন্য অভিকর্ষ বলে (মাইক্রোগ্র্যাভিটি) বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা, গবেষণা।
মহাকাশ স্টেশনে জন্মানো, বেড়ে ওঠা গাছ। ছবি- নাসার সৌজন্যে
নাসাকে প্রেসিডেন্ট রেগন সময় দিলেন ১০ বছর
সেটা ১৯৮৪-র ২৫ জানুয়ারি। তাঁর ‘স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণে তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন ১০ বছর সময় দিলেন নাসাকে, মহাকাশ স্টেশন বানানোর জন্য। বিপুল খরচের কথা মাথায় রেখে ঠিক হল, একা আমেরিকা নয়; আরও তিনটি দেশ- রাশিয়া (তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন), জাপান ও কানাডা হাত মেলাবে সেই স্টেশন বানানোর জন্য। সঙ্গে থাকবে ইউরোপ মহাদেশের মহাকাশ সংস্থা ‘ইসা’-ও।
আরও পড়ুন- ‘আমার তত্ত্বের ফাঁকফোকর খুঁজছি, তোমরাও খুঁজে দেখ’, এখনও বলেন জিম পিবল্স
আরও পড়ুন- মহাকাশে ইতিহাস গড়ে স্পেসওয়াকে ২ কন্যা
তার পর পৃথিবীর সবক’টি মহাসাগর দিয়েই অনেক জল গড়িয়ে গেল। ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ক্রেমলিনের গৌরব নিয়ে আলাদা দেশ হয়ে গেল রাশিয়া। ১৯৯৮-এর ২০ নভেম্বর। মহাকাশ স্টেশনের মালমশলা নিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে পাড়ি জমাল রুশ রকেট ‘জারিয়া’। দিনপনেরোর মধ্যেই ৪ ডিসেম্বর মালমশলা নিয়ে রওনা হল মার্কিন স্পেস শাটল।
মহাকাশ স্টেশনে গাছ জন্মানোর পরীক্ষানিরীক্ষা। ছবি- নাসার সৌজন্যে
২০০০-এ মহাকাশচারীরা প্রথম কাটালেন স্টেশনে
এত বড় চেহারার মহাকাশ স্টেশন গড়তে অন্তত দু’টো বছর তো লাগবেই। লাগলও। নতুন শতাব্দী এসে গেল। ২০০০ সালের ২ নভেম্বর। স্টেশনে কয়েক মাস থেকে গবেষণা চালানোর জন্য রওনা হলেন তিন মহাকাশচারী। দু’জন রুশ, এক জন মার্কিন। ইউরি গিদজেন্কো, সের্গেই ক্রিকালেভ ও বিল শেফার্ড। সেই প্রথম মহাকাশে গিয়ে অত দিন থাকা।
কিন্তু পুরোদস্তুর গবেষণার জন্য তো চাই আস্ত একটা গবেষণাগার। সেটা বানালো আমেরিকা। নাম- ‘ডেস্টিনি’। মহাকাশ স্টেশনে তা পাঠানো হল ২০০১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। ‘ডেস্টিনি’ এখনও আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে মার্কিন মহাকাশ গবেষণার ‘ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট ডেস্টিনেশন’। পরে সেখানেই আমেরিকা গড়ে তুলেছে মহাকাশে তাদের জাতীয় গ্রন্থাগারটি। ২০০৫-এ মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদনের পর।
অণুজীব নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা। ছবি- নাসার সৌজন্যে
রাশিয়া, আমেরিকায় ভাগাভাগি মহাকাশ স্টেশন!
তার মধ্যে মহাকাশ স্টেশনের দু’টি অংশ ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে কারিগর দেশগুলির মধ্যে, বোঝাপড়ার মাধ্যমে। একটি অংশ চালায় রাশিয়া। অন্যটি মূলত চালায় আমেরিকা। তবে সেই অংশে নাসা কাজ করতে দেয় ইসা, সিএসএ, জাক্সাকেও।
তার পর থেকেই ‘ফুলে ফুলে পল্লবিত’ হয়ে উঠতে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। গবেষণাগার বানায় ইসা। যার নাম- ‘কলম্বাস’। ২০০৮-এর ৭ ফেব্রুয়ারিতে। এক মাসের মধ্যেই গড়ে ওঠে জাপানের গবেষণাগার। ‘কিবো’। ১১ মার্চ।
২০১০-এর ২ নভেম্বর। দশম বার্ষিকী পালিত হয় মহাকাশ স্টেশনে। তত দিনে মহাকাশ স্টেশনে গিয়ে থাকা হয়ে গিয়েছে ২০২ জন মহাকাশচারীর। ২০১৩ থেকে মহাকাশ কেন্দ্রে প্রোটিন নিয়ে গবেষণা শুরু করে নাসা। যা চলছে এখনও।
মহাকাশ স্টেশনে ৬টি ঘরের একটি। ছবি- নাসার সৌজন্যে
নাসার লক্ষ্য এখন চাঁদ-মুলুকে আস্তানা গড়ে তোলা
পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির (জেপিএল) সিনিয়র সায়েন্টিস্ট গৌতম চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, শুধুই প্রোটিন নয়, অণুজীব, ক্যানসার-সহ বিভিন্ন রোগ আমাদের দেহে কী ভাবে জন্মায় ও ছড়িয়ে পড়ে তা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে মহাকাশ কেন্দ্র, গত দু’দশক ধরে। মাইক্রোগ্র্যাভিটিই ওই সব গবেষণার আদর্শ পরিবেশ। যেখানে বায়ুমণ্ডল নেই। নেই পৃথিবীর জোরালো অভিকর্ষ বলও। তাই বিভিন্ন ওষুধ আবিষ্কারেরও আদর্শ জায়গা আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রই।
তবে গৌতমের কথায়, ‘‘নাসার লক্ষ্য এখন চাঁদে আস্তানা গড়ে তোলা। চাঁদে ফের মানুষ নামানো। চাঁদের বুকে কিছু দিন ধরে মানুষকে রাখা। মঙ্গলে পাকাপাকি ভাবে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তুলতে হলে চাঁদই হবে আমাদের সেরা গবেষণাগার। তার জন্যই যাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বার বার চাঁদে নামা যায়, নাসার লক্ষ্য এখন সেটাই। তাই নাসা এখন পাকাপাকি ভাবে আস্তানা গড়ে তুলতে চাইছে চাঁদের কক্ষপথে। সেটাই নাসার ‘আর্টেমিস’ প্রকল্প। ফলে, মহাকাশ কেন্দ্রের পিছনে অর্থ ব্যয় আর করতে চাইছে না নাসা।’’
তবে চিন খুব শীঘ্রই মহাকাশ কেন্দ্র গড়ে তুলতে চলেছে। ইসরোও জানিয়েছে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে ভারতের মহাকাশ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। একই রকমের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে ইজরায়েলও।
মহাকাশ স্টেশনে ৬টি ঘরের আরও একটি। ছবি- নাসার সৌজন্যে
বরাবরই সৌর প্যানেলের ভরসায় চলেছে, এখনও চলছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র। দেড় ঘণ্টায় এক বার করে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীকে। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে। দিনে পৃথিবীকে প্রায় সাড়ে ১৫টি কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চলেছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র।
গৌতম জানাচ্ছেন, অচল হয়ে পড়লেও মহাকাশ কেন্দ্র পৃথিবীকে এই প্রদক্ষিণ করে চলতেই পারে, অন়ন্ত কাল ধরে। তবে তাতে অন্য মহাকাশযান পাঠাতে অসুবিধা হতে পারে। তাদের আসা-যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে মহাকাশ কেন্দ্র। আবর্জনা (স্পেস ডেব্রি) বাড়াতে পারে মহাকাশে। তাই তাকে নামিয়ে আনাটাই জরুরি। সেটা পাঁচ বছরের মধ্যে যদি না হয়, তা হলে তা অবশ্যই হবে ২০৩০-এর মধ্যে। হয়তো প্রশান্ত মহাসাগরেই নামিয়ে ফেলা হবে তাকে। তত দিনে চাঁদের কক্ষপথে পাকাপাকি ভাবে আস্তানা (আর্টেমিস) গড়ে তুলতে পারবে নাসা।’’
ফলে, অতলান্ত মহাসাগরের ডাকে এখন বলছে বটে, ‘কেন যাব?’, খুব বেশি হলে আর বছর দশকের মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রকে ছুড়ে ফেলতেই হবে মহাসাগরে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy